যদি আমাদের ছাত্রাবাসগুলোও এমন হতো!

পরিচয়পত্র পাঞ্চ করে খাবার রিজার্ভ করা হয়। ছবি: মুমিত আল রশিদ
পরিচয়পত্র পাঞ্চ করে খাবার রিজার্ভ করা হয়। ছবি: মুমিত আল রশিদ

আমাদের দেশের বর্তমান ছাত্ররাজনীতি কেমন হওয়া উচিত বা কোন পথে যাচ্ছে, সেটা ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসে অনেকটা বুঝতে পারছি। আশা করছি শুধু আমি নই, আমার মতো যাঁরাই প্রবাসের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করছেন, তাঁরাও তা উপলব্ধি করছেন। ফাউ খাওয়া, হলের ক্যানটিন বয় থেকে শুরু করে দারোয়ান পর্যন্ত সবাইকে কারণে-অকারণে মারধর করা, একাধিক কক্ষ দখলে রাখা, টেন্ডারবাজি করা, হলের কর্তৃত্ব দখলে রাখতে রাতভর জুনিয়রদের দিয়ে মহড়া দেওয়ানো, ছিনতাই নামক ভাইভার সবক দেওয়া, নিজের পালিত বাহিনী বা এলাকাকেন্দ্রিক ছোট ভাইদের দিয়ে নিজের গুণকীর্তন করে (যেমন: সময়ের অহংকার, বিপ্লবী ছাত্রনেতা, বিরোধী দলের আতঙ্ক, রাজপথের লড়াকু সৈনিক, মেধাবী ছাত্রনেতা) পোস্টার ও দেয়াল লিখনে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও রাজপথগুলো মিছে স্লোগানে ভরিয়ে ফেলা! নেতার ছবির চাইতে নিজের ছবিকে প্রাধান্য দিয়ে বড় করে দেয়ালে সেঁটে দেওয়া। ছাত্র সংগঠনগুলোর জাতীয় সম্মেলনের নামে ক্লাস চলাকালীন মাইক বাজিয়ে গলাবাজি করা (অনেক বিজ্ঞ কলামিস্ট, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতাও এদের সঙ্গে শামিল হন)। আবার নতুন উপদ্রব যোগ হয়েছে ফেসবুকে বড় ভাইদের গুণকীর্তন করে ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া। এই হচ্ছে আমাদের ছাত্ররাজনীতির বর্তমান স্বরূপ।

অথচ আমাদের মেধাবী ও তুখোড় ছাত্রনেতাদের সংগ্রাম-আন্দোলনের ফসল ছিল ১৯৫২, ৬৯, ৭১, ৯০-এর অসামান্য সব কীর্তি। তাঁদের আত্মত্যাগেই আজ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারছি। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন দেশে বসবাস করছি। স্বৈরাচার হটিয়ে গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শিখেছি। কিন্তু বর্তমানের ছাত্ররাজনীতি আমাদের উপরোক্ত নেতিবাচক দিকগুলোকেই বেশি স্মরণ করিয়ে দেয়। শিক্ষকেরাও এর ব্যতিক্রম নই। আমরা কিছু শিক্ষক নির্ধারিত পাঠ্যসূচিও ঠিকমতো না পড়িয়ে অন্যের নেতিবাচক দিক তুলে ধরার চেষ্টা করি। নিজের ক্লাসগুলো আকর্ষণীয়ভাবে তুলে না ধরে কোনো রকমে সেমিস্টার পার করে দেওয়ার ফন্দি-ফিকির করি। একই পাঠ বছরের পর বছর একই স্টাইলে তুলে ধরি। শুধু নিজের গুণগান করা ছাত্রছাত্রীর নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা যায়।

ইরান আসার পর এখন পর্যন্ত যা সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে, তা হলো, ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন প্রকার লোভ-লালসা থেকে দূরে থাকা। প্রতিহিংসাপরায়ণ বা মারামারিতে জড়িত না হওয়া। ফাউ খাওয়ার প্রবণতা থেকে দূরে থাকা। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ে শিক্ষার্থীদের একটি রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেওয়া হয়, যা তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচয়পত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ছাত্রাবাসের আসনসংখ্যা অনুসারে ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়। একটি ছাত্রাবাসে কমপক্ষে ১২০ শিক্ষার্থী বসবাস করতে পারেন। রান্নাঘর, ইন্টারনেট কক্ষ, টেলিভিশন কক্ষ, রিডিং রুম, গোসলখানা—সব আলাদা।

ক্যানটিনে একসঙ্গে পাঁচ শ শিক্ষার্থীর খাবারের ব্যবস্থা আছে। ছবি: মুমিত আল রশিদ
ক্যানটিনে একসঙ্গে পাঁচ শ শিক্ষার্থীর খাবারের ব্যবস্থা আছে। ছবি: মুমিত আল রশিদ

ছাত্রাবাসগুলোতে আমাদের দেশের মতো প্রভোস্ট বা আবাসিক শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে শিক্ষার্থীদের দিয়ে পরিচালনা করা হয়। যেমন একজনের দায়িত্ব হচ্ছে ছাত্রাবাসের কোথায় কোন কক্ষ খালি রয়েছে, সেটা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ছাত্রাবাসে বসবাসের অনুমোদনপ্রাপ্ত ছাত্রকে কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া। আট, ছয়, চার, তিন, দুই ও একজন বসবাসযোগ্য কক্ষগুলো সিনিয়র ও জুনিয়র অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয়। শোয়ার খাটগুলো দোতলাবিশিষ্ট। প্রতি বেডে একজন বিশ্রাম নেবেন। নিয়মের ব্যতয় হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। ছাত্রাবাসের এই পরিচালককে ফারসিতে বলা হয় মাসউলে খা’বগা’হ। প্রতি মাসে একজন ছাত্র দুই রাতের বেশি কোনো অতিথি রাখতে পারবেন না। প্রতিটি ছাত্রাবাসে নিরাপত্তারক্ষী নিয়ন্ত্রিত প্রবেশব্যবস্থা রয়েছে। আবাসিক শিক্ষার্থী ছাড়া যে কেউ প্রবেশ করতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র বা জাতীয় পরিচয়পত্র নিরাপত্তারক্ষীর কাছে জমা দিয়ে ও কার কাছে যাবেন, তাঁর নাম লিখে প্রবেশ করতে হবে। এখানে ছাত্রাবাসের পরিচালকের কোনো ভূমিকা নেই, পুরোটাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রেরিত নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে।

মাসউলে ভারজেশ বা খেলাধুলা পরিচালক হিসেবে একজন ছাত্রকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁর কাজ হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার খেলায় ছাত্রদের উৎসাহ প্রদান করা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সবাইকে নিয়ে অংশগ্রহণ করা। প্রতিটি ছাত্রাবাসের জন্য সপ্তাহে এক দিন নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। তবে শরীরচর্চার জিম শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন খোলা রাখা হয়। সুইমিংপুল সপ্তাহের তিন দিন ছাত্রীদের ও চার দিন ছেলেদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া। চারপাশে উদ্ধারকারী দল সদা প্রস্তুত থাকে।

মাসউলে ফারহাঙ্গি বা সাংস্কৃতিক পরিচালকের কাজ হচ্ছে বিভিন্ন ধর্মীয় দিবস, জাতীয় দিবস, উৎসব পার্বণে ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন কক্ষে মিষ্টি ও লিফলেট বিতরণ করা। বিভিন্ন সময়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা ও পুরস্কার বিতরণ করা।

মেরামত পরিচালকের কাজ হচ্ছে কোন কক্ষে কী সমস্যা! কোন আসবাব নেই! বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ সঠিকভাবে পাওয়া যাচ্ছে কি না, বৈদ্যুতিক বাল্ব, শীতকালীন শোপাজ বা তাপমাত্রা গরমকারী যন্ত্র ও গ্রীষ্মকালীন কক্ষ শীতলকারী যন্ত্র প্রতি কক্ষে ঠিক আছে কি না; সেটা মেরামতে যথাযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া। কক্ষগুলো রং করা, কার্পেট কেনা ইত্যাদি কাজ নিয়ন্ত্রণ করা।

স্বাস্থ্যবিধি পরিচালকের কাজ হচ্ছে হলের ছারপোকাসহ উপদ্রবকারী পোকামাকড় নিধনে প্রতি কক্ষে স্প্রে করা। রান্নাঘর, বাথরুম, পাঠকক্ষ, কম্পিউটার কক্ষ, টিভিরুমসহ বিভিন্ন কক্ষে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে নজরদারি করা।

তবে সবচেয়ে কষ্টকর কাজ হচ্ছে খাদ্য পরিচালকের! শুক্রবার ও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকেল পাঁচটায় প্রতিটি হলের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় সবার খাবার বিতরণ করা। সবাই নিজের পাত্রে রুম নম্বর লিখে হলের নিচতলা বা দোতলায় রেখে দেন। খাদ্য পরিচালক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত তালিকা দেখে রাতের খাবার ও সকালের নাশতা নির্দিষ্ট পাত্রে রেখে দেন। যদি কেউ ভুলবশত পাত্র না রাখেন, তবে খাদ্য পরিচালকের কক্ষ থেকে পরবর্তী সময়ে সংগ্রহ করতে পারেন।
ছাত্রাবাস পরিচালক, খেলাধুলা পরিচালক, সাংস্কৃতিক পরিচালক, মেরামত পরিচালক, স্বাস্থ্যবিধি পরিচালক—সবাই নিজ হাতে খাবার নিতে বাধ্য হন। আমাদের দেশের ছাত্রনেতাদের মতো তাঁদের কক্ষে খাবার পৌঁছে দেওয়া বা ফ্রি খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। এমনকি পরবর্তী দিন বাইরে থেকে এসেও নিজের খাবার, ফলমূল কাউকে স্পর্শ পর্যন্ত করতে দেখিনি!

নিজের জন্য বরাদ্দকৃত খাবার ছাড়া অন্যের খাবার কেউ নেন না। ছবি: মুমিত আল রশিদ
নিজের জন্য বরাদ্দকৃত খাবার ছাড়া অন্যের খাবার কেউ নেন না। ছবি: মুমিত আল রশিদ

বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশমুখে ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে পরিচয়পত্র দেখিয়ে প্রবেশ করতে হয়। পুরোপুরি ধূমপানমুক্ত ক্যাম্পাস। নিরাপত্তা ক্যামেরা দ্বারা সব অনুষদ ও অফিস নিয়ন্ত্রিত। সকাল আটটা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত অফিস সময় নির্ধারিত। দুপুরের খাবার সবাই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যানটিনে সেরে নেন। সবাই নিজ নিজ পরিচয়পত্র পাঞ্চ করে নেন এবং সেখানে সবার নাম শনাক্ত করা হয়। শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে সবাই নিজ হাতে বরাদ্দকৃত খাবার তুলে নেন। এখন পর্যন্ত কাউকে বরাদ্দের বাইরে একটি ফাউ নিতে দেখিনি, যা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কল্পনাও করা যায় না। মেয়েদের জন্য রয়েছে আলাদা ক্যানটিন। প্রতিনিয়ত দেখি আর আফসোস করি। কবে পাব কুসুম কুমারী দাসের কবিতার সেই ছেলে? ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে ?/ মুখে হাসি, বুকে বল তেজে ভরা মন/ “মানুষ হইতে হবে”—এই তার পণ,/ বিপদ আসিলে কাছে হও আগুয়ান,/ নাই কি শরীরে তব রক্ত মাংস প্রাণ ?/ হাত, পা সবারই আছে মিছে কেন ভয়,/ চেতনা রয়েছে যার সে কি পড়ে রয় ?/ সে ছেলে কে চায় বল কথায়-কথায়,/ আসে যার চোখে জল মাথা ঘুরে যায় |/ সাদা প্রাণে হাসি মুখে কর এই পণ—/ “মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন” |/ কৃষকের শিশু কিংবা রাজার কুমার/ সবারি রয়েছে কাজ এ বিশ্ব মাঝার,/ হাতে প্রাণে খাট সবে শক্তি কর দান/ তোমরা মানুষ হলে দেশের কল্যাণ।’

*সহকারী অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে পিএইচডি গবেষক, তারবিয়্যাত মোদাররেস বিশ্ববিদ্যালয়, তেহরান, ইরান