রুয়ান্ডা 'র' উমুগান্ধা'য় সম্প্রীতির সেতুবন্ধ!

ছোটবেলায় বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে একটা বিষয় খুবই নজরে আসত, যা সত্যিকারভাবেই এক অনন্য নজির ছিল। এটা অনেকটা এমন ছিল যে পাশের বাড়ির কোনো কাজ যেমন ঘরবাড়ি সংস্কার বা নতুন করে নির্মাণ হবে আর সেখানে পাড়া প্রতিবেশীদের স্বতঃস্ফূর্ত বা স্বেচ্ছা অংশগ্রহণ থাকবে না, তা যেন হতোই না। যদিও চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক থাকতেন কিন্তু এই যে অংশগ্রহণ সেটা ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আনন্দের। গল্প করছেন, চা খাচ্ছেন আর প্রতিবেশীকে তাঁর কাজে সহযোগিতা করছেন এ যেন এক অলিখিত রীতি হিসেবেই বিবেচিত হতো। মানুষের নানাবিধ সমস্যা থাকায় যদিও এখন আর তেমন একটা দেখা যায় না।

কিন্তু পূর্ব আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডাতে যেন নতুন করে এর আবার দেখা পেলাম, যা অনেকটা ঘটা করেই দীর্ঘদিন থেকে পালিত হয়ে আসছে। প্রতি মাসের শেষ শনিবার রুয়ান্ডা সমাজের জন্য যেন এক অতি আনন্দের দিন। না, এ আনন্দ কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য নয় বরং সামাজিক কাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে পরস্পরকে সহযোগিতার আনন্দ, যা বহুদিন থেকে চলে আসছে এবং সময়ের চাহিদা অনুযায়ী কালক্রমে এটা এখন একেবারেই নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে।

কী সেই উমুগান্ধা (UMUGANDA)? উমুগান্ধা শব্দটির অনুবাদ করা যেতে পারে এভাবে, ‘একটা যৌথ উদ্দেশ্য নিয়ে একত্রভাবে কাজ করে কোনো বিশেষ সফলতা অর্জন।’ গতানুগতিক রুয়ান্ডার সংস্কৃতিতে উমুগান্ধাকে প্রত্যেক পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধব এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের সমন্বয়ে কোন একটা জটিল কাজকে সম্পন্ন করাকে বুঝিয়ে থাকে। সহজ কথায় বলা যেতে পারে যে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কোনো একটা কাজকে যৌথভাবে সম্পন্ন করা, যা মূলত সামাজিক কাজ হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে।

আধুনিককালে উমুগান্ধাকে একেবারে সামাজিক কাজ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে এবং এতে দেশের ১৮ থেকে ৬৫ বছরের সকলকে অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবেই অংশগ্রহণ করতে হয়। এ দিনে মূলত বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং পরিবেশবিষয়ক কাজকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, উমুগান্ধার দিনে অর্থাৎ মাসের শেষ শনিবারে এ দেশে কাজে নিয়োজিত থাকা বিদেশি লোকজনকেও এ কাজে অংশগ্রহণ করতে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়ে থাকে, যদিও বাধ্যতামূলক নয়।

আসলে উমুগান্ধা এ দেশের মানুষের জীবনে এক স্থায়ী দায়িত্বের অংশ হয়ে গেছে অনেক দিন থেকেই। মাসের শেষ শনিবারে রাস্তায় বের হলে তেমন গাড়ি পাওয়া যাবে না, কারণ সবাই ব্যস্ত হয়ে আছে সামাজিক কাজে অর্থাৎ উমুগান্ধায়। এদিনে যার যে সামর্থ্য আছে, সে অনুযায়ী সবাই সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করে থাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই।

এই উমুগান্ধা কর্মসূচিতে দেশের প্রায় ৮০ ভাগের বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকে যেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিদ্যালয় নির্মাণ, চিকিৎসাকেন্দ্র নির্মাণসহ বিভিন্ন কৃষিজাতীয় কাজে এ অংশ নিয়ে থাকে। ২০০৭-২০১০ সময়কাল পর্যন্ত এ কাজের মূল্য গণনা করলে যা ৬০ মিলিয়ন ডলারের বেশি হবে বলে অনুমান করা হয়ে থাকে।

রুয়ান্ডার স্বাধীনতা অর্জনের সময়কালে অর্থাৎ ’৬২ সালের দিকে উমুগান্ধা কেবলই বিশেষ পরিস্থিতিতে আয়োজন করা হতো এবং জাতিগঠনে ব্যক্তিকেন্দ্রিক অবদান হিসেবেই বিবেচনা করা হতো কিন্তু বর্তমানে উমুগান্ধাকে ‘উমুবি’জি (UMUBYZI) অর্থাৎ বন্ধু, পরিবারকে সময় দেওয়ার পাশাপাশি সমাজের আওতাধীন একে অন্যকে সহযোগিতার জন্য এক বিশেষ দিন হিসেবেই নির্ধারণ করা হয়েছে।

যদিও উমুগান্ধাকে একসময় (৭৪ সালের দিকে) খুব বেশি পরিমাণে আয়োজন করা হতো, এমনকি যা ছিল প্রতি সপ্তাহে একদিন কিন্তু পর্যায়ক্রমে তা পরিবর্তন হয়ে এখন শুধু মাসে একবারই হয়ে থাকে। রুয়ান্ডার ‘জেলা উন্নয়ন মন্ত্রণালয়’ এ কর্মসূচিকে দেখভাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল এবং সে অনুসারে জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারাই এর আয়োজন করে থাকত যাতে জনগণের তেমন কিছু একটা বলার থাকত না। এমনকি এতে অংশগ্রহণ না করলে সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজনকে জরিমানাও করা হতো যার কারণে অনেকেই এটাকে ‘অনেকটা ফোর্স’ লেবার হিসেবেও বিবেচনা করে থাকত।

এমনকি ১৯৯৪ সালে গণহত্যার সময়কালে উমুগান্ধাকে এক পাক্ষিকভাবে অনেকে তুতসিদের খুঁজে বের করার কর্মসূচি হিসেবেও বিবেচনা করা শুরু করেছিল, যদিও এ ধারণা খুব তাড়াতাড়িই মানুষের মন থেকে দূরীভূত করা সম্ভব হয়েছিল এবং এটাকে দেশ পুনর্গঠনের অংশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে কর্তৃপক্ষ সক্ষম হয়েছিল। উল্লেখ্য, উমুগান্ধা বর্তমান সময়ে একেবারেই সামাজিক কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবেই সবাই অংশ নিয়ে থাকে।

যাই হোক, এ কর্মসূচিতে অধিক সংখ্যায় অংশগ্রহণ এবং ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে রুয়ান্ডা সরকার ২০০৯ সাল থেকে উমুগান্ধা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে। এ প্রতিযোগিতার মূল লক্ষ্য হলো জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, অধিক পরিমাণে ভালো কাজের অন্তর্ভুক্তির অভ্যাস করা এবং এ জন্য কমিউনিটিকে পুরস্কৃত করা, যা পর্যায়ক্রমে জাতীয় উন্নয়নেও সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এসব কাজের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো বিভিন্ন স্কুল-কলেজ নির্মাণে ভূমিকা রাখা, চিকিৎসাকেন্দ্র নির্মাণে সহযোগিতা করা এবং সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ ইত্যাদি।

মোদ্দা কথা, এই কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, এটা যে রুয়ান্ডার সামাজিক জীবনে এক অসাধারণ সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করেছে, তা আসলে কোনো মূল্যেই মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। এটা একদিকে যেমন সামাজিক বন্ধন দৃঢ় বা পোক্ত করতে ভূমিকা রাখছে, ঠিক তেমনি গ্রাম থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত উন্নয়নে নিঃসন্দেহে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। সম্ভবত এর কারণেই রুয়ান্ডাতে মানুষে মানুষে এক অভূতপূর্ব সম্পর্ক বিদ্যমান, নেই কোনো হানাহানি, নেই কোনো বিদ্বেষ এবং সর্বত্রই থাকছে বিশেষ আন্তরিক পরিবেশ; যা অনেক দেশের জন্যই এক অনুকরণীয় উদাহরণ হিসেবেই বিবেচিত হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।

*জামিলূর রহমান চৌধুরী, কিগালি, রুয়ান্ডা থেকে