মেঘ শুধু মেঘ

আম্মা বসে আছে অথচ ওই রকম সরে যাচ্ছে কীভাবে! আশ্চর্য তো! হ্যাঁ, আম্মাই তো বসে আছে। অর্ধেকটা ঘোমটা টানা মাথায়, সেই পরিচিত শাড়িটি পরা। কী করছে বসে? তরকারি কাটছে, না হাতপাখা বানাচ্ছে সুতা দিয়ে? না না, এমনি বসে আমাকে দেখছে আর আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। কিন্তু দূরে সরে যাচ্ছে খুব ধীরে ধীরে। নিচে নেমে আসছে না কেন? খুব অভিমান হচ্ছে আম্মার ওপর, কিছুটা রাগও।

আশপাশের কারও কথা কানে যাচ্ছে না। আম্মার এই দুষ্টুমিও ভালো লাগছে না, অমন মেঘের মধ্যে বসে আমার সঙ্গে এ রকম করার কী কারণ! নাকি ওটা আসলে মেঘ! কই, না তো, মেঘ তো মনে হচ্ছে না, স্পষ্ট তো আম্মাই ওটা, একদম পরিষ্কার দেখছি। আমার মুখে হাসি ফুটে উঠল, আম্মা আসলে আমাকে দেখতে এসেছে, আমিও দেখে ফেলেছি তোমাকে। দেখছি, দেখছি অপলক তাকিয়ে থেকে আম্মাকেই দেখে চলেছি। ধীরে ধীরে মেঘের সঙ্গে আম্মা দূরে বহুদূরে মিলিয়ে যাচ্ছে, আবার যেন আরেকটা মেঘের সঙ্গে ফিরে আসছে আমার দৃষ্টির সীমায়।

কোনো একটা জোরালো শব্দে ধ্যান ভঙ্গ হলো। আকাশে শুধুই মেঘ, আম্মাকে আর খুঁজে পাচ্ছি না। আমার চোখ ভরে উঠল জলে। নানিবাড়ির মাটির ঘরের মেঝের পাটিতে শুয়ে শুয়ে এতক্ষণ আম্মা আমাকে দেখছে ভেবে ভালোই লাগছিল। এমনিতেই মনে হয়, কেমন করে আম্মা যেন সব জেনে ফেলে, সব বুঝে ফেলে। আমার যে আম্মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে, তা জেনেই বুঝি আম্মা ওই মেঘে চড়ে দেখা দিয়ে গেল। কিন্তু কেমন করে এখন সব মেঘগুলো মেঘ হয়ে গেল। এই মনে হচ্ছে ওই তো আমার মা, আবার দেখি না এ তো মেঘ।

জীবনে প্রথমবারের মতো আম্মাকে ছাড়া এত দূর এসেছি, যদিও ঢাকা থেকে আমার নানিবাড়ির গ্রাম বেশি দূর নয়। দাদাবাড়িও একই জেলায়। আব্বা আমাকে নিয়ে এসেছেন, এক রাতের জন্য। সকাল থেকে সময়টা যেন কীভাবে কেটে গেল। বাস জার্নির ধকল, বাস থেকে নেমেই আব্বার সঙ্গে এর ওর সঙ্গে দেখা করা। সবার একটু বাড়তি আদর আগ্রহ, এই প্রথম আম্মাকে ছাড়া আমি একা এসেছি আব্বার সঙ্গে। এখন এ দুপুরের পরে ক্লান্তি আর অবসাদে মন ছেয়ে যাচ্ছে, রাত কীভাবে পার করব। আম্মা কেন আমায় আসতে দিল। তা-ও যা মেঘের সঙ্গে দেখতে এসেছিল, তবে কেন চলে গেল! শুয়ে শুয়ে চেষ্টা করছি, আবার যদি দেখা পাই, তীব্র মন খারাপ হচ্ছে। মেঘগুলোও পাঁজি, কেমন যেন বেশি জোরে চলে যাচ্ছে এখন।

বাড়ি ফিরে পরে শুনেছিলাম, আম্মাও নাকি অস্থির হয়েছিলেন, আমরা কখন ফিরব, আমি কেমন আছি, কান্নাকাটি করে আব্বাকে বিরক্ত করে ফেলেছিলাম কি না—এসব চিন্তায়। সবাই আমাকে নিয়ে হাসবে এই ভেবে কাউকে বলতে পারিনি, আম্মাকে মেঘের সঙ্গে দেখার কথাটা। কিন্তু বহুদিন এ বিষয়টি আমাকে ভাবিয়েছে, মনে হয়েছে আম্মাকে জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি কি সত্যিই মেঘের সঙ্গে ভেসে ভেসে আমাকে দেখতে গিয়েছিলে?’ ছোট্ট মনে ভীষণ এক রহস্য হয়ে রয়ে গিয়েছিল সেই মেঘ। এরপর মাঝেমধ্যে মেঘের মাঝে আম্মাকে খুঁজেছি, আকাশ থেকে আমায় দেখছে কি না, তাই দেখতে। নিজে নিজে আম্মার অবয়ব আঁকতে চেয়েছি মেঘে, ঠিক ওই রকম আর হয়নি। ওই দিনের মতো এত স্পষ্ট করে মেঘে আর আম্মাকে দেখিনি।

এখন এই পরিণত বয়সে, ছোটবেলার কিছু কিছু স্মৃতি হঠাৎ কেমন পরিষ্কার করে মনে চলে আসে। যেমন এই মেঘ মায়ের স্মৃতি, এ নিয়ে এখন কত যুক্তি, কত কারণ ভাবতে পারি। তবুও ছোট বেলার সেই অপার রহস্যের ভালো লাগা টুকুও অনুভব করি এখনো। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে, আম্মার কাছ থেকে কত দূরে! ইন্টারনেটের কল্যাণে কথা বলা, দেখা তেমন কোনো বিষয় নয়। তবু মনে হয়, মেঘের সঙ্গে আম্মাকে যত কাছ থেকে দেখেছিলাম, সে রকম আর দেখতে পাই না। মনে হয়, সেই আস্থা, সেই বিশ্বাস যদি ফিরে পেতাম যে ‘আমার কোনো ভয় নেই, আম্মা আমায় ঠিক দেখে রাখছে, ঠিক সেই ছোটবেলার মতো।’

কিন্তু বাস্তবে যখন আকাশে তাকাই, এখন সেখানে দেখি শুধুই মেঘ! আর কে যেন ভেতরে আলোড়ন তোলে আমার সন্তান আর আমার মায়েরও এখন একজন মেঘ-মা দরকার।

*আফরিন জাহান হাসি, ক্যালগেরি, কানাডা