বেলা যে যায় সাঁঝ বেলাতে...

লেখিকা
লেখিকা

দেশ ছেড়ে বাইরে বসবাস না করলে পরবাসের আনন্দ কেবল শুনে উপলব্ধি করা যায় না। হায় অভিবাসী জীবন! এ যেন নাড়িছেঁড়া বেদন। ফেলে এলেও পুরোনো ক্ষতই ভালোবাসে মন। যা কিছু ভালো লাগে, যা কিছু সুন্দর, অমনি ভাবি আহা। আমাদেরও হতো যদি তাহা।

জুলাই ২০১৪। গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে সব্বাই ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়েছে, বহু কাঙ্ক্ষিত ‘সামার’ উপভোগের লক্ষ্যে। এখানকার গ্রীষ্মের ছুটিতে সকলেরই দূরে বেড়ানোর পরিকল্পনা থাকে। সারা বছর ধরে বেড়ানোর জন্য পয়সা জমায় এরা বাড়তি কাজ করে। ছুটিও জমায় দূরে যাবে বলে। অনেকের আত্মীয়-পরিজন-বন্ধু-স্বজন বিভিন্ন দেশে থাকে। তা ছাড়াও বছরের প্রায় আট মাস বরফের চাদরে মুড়িয়ে থেকে মানুষের মনও বিষণ্নতার মোড়কে পুরে থাকে। তাই ঝলমলে রোদ, স্বচ্ছ নীলাকাশ, হালকা-মিষ্টি হিমেল বাতাস; সব মিলিয়ে প্রকৃতির কোমল ছায়া, সবুজের মায়া আর বসন্তের বর্ণিল উপাখ্যান উপেক্ষা করার সাধ্য কারই বা হয়। প্রকৃতির অমোঘ টানে তাই ঘর ছেড়ে বাইরে আসে কপোত-কপোতী, চাতক-চাতকী, কিশোর-যুবাসহ আবালবৃদ্ধবনিতা। আমরাও নতুন দেশে, নতুন আবাসের আশপাশ ঘুরে দেখছি। সামর্থ্য নেই খুব দূরে যাওয়ার। অগত্যা শহরকেন্দ্রিক দর্শনীয় জায়গায়ই সীমাবদ্ধ থাকছে আমাদের ঘোরাফেরা।
সেবারই পরবাসে প্রথম গ্রীষ্মযাপন। মেয়ের স্কুল লম্বা ছুটি। বছর শেষের এই দীর্ঘমেয়াদি ছুটিতে বাচ্চারা খুবই বিরক্ত হয়। বন্ধুদের মিস করে, খেলার সাথি স্কুলের বাইরে খুব বেশি একটা থাকে না এদের। আমার কন্যারও একই দশা। এখানকার স্কুলের নতুন বছর শুরু হয় সেপ্টেম্বরে, শেষ হয় জুনে। অতঃপর জুলাই-আগস্ট দুই মাস গ্রীষ্মকালীন ছুটি। যাতে করে পরিবারের সবাই মিলে গ্রীষ্মকালটাকে চমৎকারভাবে উপভোগ করা যায় সে জন্যই এই ব্যবস্থা! প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়েই তো চলতে হয় আমাদের। গ্রীষ্মের এই দুটো মাসই তো। এর পরে আবার হিমশীতল নীরবতায় ঢেকে যাবে গোটা পৃথিবী। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতেই পাতা ঝরার ঘণ্টা নিয়ে আসবে শীতের আগমনী সংগীত। তারপরে সখ্য হবে কনকনে হাড় কাঁপানো শীতের সঙ্গে; যে কেবল শুভ্র বরফের চাদরে আদর মাখিয়ে রাখবে আটটি মাস। তাই এই ছুটি যতটুকু সম্ভব উপভোগ করে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। সিদ্ধান্ত হলো আমরা চিড়িয়াখানা দেখতে যাব।
সপরিবারে একদিন সকালে চিড়িয়াখানার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। বাসার গেটের ঠিক লাগোয়াই বাসস্টপেজ। মাত্র ৩০ মিনিটেই আমরা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। চিড়িয়াখানার গেটেই নামলাম। উল্লেখ করা দরকার, এ দেশে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে কোথাও যেতে হলে গন্তব্যের ঠিক প্রবেশ মুখেই পেয়ে যাবেন বাস স্টপেজ কিংবা রেল স্টেশন। এখানকার নগর-পরিকল্পনা এমনই সুষ্ঠু আর নিখুঁতভাবে করা যে, সকল পাবলিক কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল ও দর্শনীয় স্থানগুলোতে আপনি হয় বাস স্টপেজ কিংবা রেল স্টেশন পাবেনই, একেবারে নির্ধারিত স্থানের প্রধান ফটকে না হলেও দুই–তিন মিনিট হাঁটলেই পাবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আপনাকে অনেক যন্ত্রণা করে বহুদূর হেঁটে, নিজের বাহনে অথবা ভাড়া বাহনে চড়তে হবে না। এতে করে সাধারণ যাত্রীদের যেমন সুবিধে তেমনই এসব সেবা খাত থেকে সরকারের আয়ের ধারাও থাকে প্রবহমান। যা আমাদের দেশের ক্ষেত্রে একেবারেই বিপরীত। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অগাধ ভান্ডার থাকা সত্ত্বেও কেবল সরকারি উদাসীনতা আর অবহেলায় পর্যটন খাতের মতো বিশাল সম্ভাবনাময় খাতের আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার নিজেই। কোনো সরকারই পর্যটন খাতে বিনিয়োগের কথা ভাবেনি, সেই সঙ্গে দর্শনীয় স্থানগুলোতে মানুষের পৌঁছানোর উপযোগী রাস্তাঘাট নির্মাণের ভাবনাও রয়ে গেল নীতিনির্ধারকদের ঔদাসীন্যে মোড়ানো। যদিও আজকের গল্প এই পর্যটনকে ঘিরে নয়, এবার যাচ্ছি মূল প্রসঙ্গে।
চিড়িয়াখানায় ঢুকতেই বিশাল সুদৃশ্য মনোরম গেট। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে নানা পোজে সবাই ছবি তুলছে। আমরাও বা বাদ যাই কেন? শুরু হলো নানা ঢংয়ে-রূপে আমাদের মা-মেয়েতে, বাবা-মেয়েতে ছবি তোলার পর্ব। সেই পর্ব শেষ হতেই শুরু হলো ভেতরে প্রবেশের জন্য টিকিট ক্রয় পর্ব। সেখানে বেশ লম্বা লাইন। আমরা লাইনের শেষে দাঁড়িয়ে টিকিট প্রাপ্তির অপেক্ষায় আছি। টিকিট মিললে অতঃপর ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরে ঢুকেই বাম হাতে দেখছি এক সুসজ্জিত ছোট্ট ট্রেন। সুন্দর শিশুতোষ চিত্রাঙ্কিত স্টেশন দাঁড়িয়ে আছে আমাদেরই অপেক্ষায়। তাকে হতাশ করতে মন চাইল না, ছেলেবেলার মতো হইহই আনন্দে ট্রেনে চড়তে ইচ্ছে হলো। সুতরাং আবারও লাইন। তিনজনে বেশ মজা করে প্রথমবার সেই ঢাকা শিশুপার্কের ট্রেনে চড়ার মতো অতি আনন্দে ট্রেনে চাপলাম। ট্রেনটি আমাদের গোটা চিড়িয়াখানা এক নজরে ঘুরিয়ে নিয়ে এল। ট্রেন থেকে নেমে এবার হাঁটছি; তখনই মূলত আমাদের চিড়িয়াখানা দর্শন শুরু; বিশাল প্রান্তর।
বলা বাহুল্য, এই চিড়িয়াখানায় যত না পশু-পাখি-প্রাণী রয়েছে তার থেকে অধিক সুন্দর করে তৈরি করা হয়েছে বিস্তীর্ণ বনভূমি, যা পশু-পাখিদের অভয়ারণ্য। আবার দর্শক যারা আসবেন তারাও যেন সময় কাটাতে পারেন স্বাচ্ছন্দ্যে সেই উদ্দেশ্যেই এটি সজ্জিত হয়েছে। আমাদের দেশের মতো বিশাল বিশাল খাঁচায় হিংস্র প্রাণীদের বন্দী করে রাখেনি এরা। কানাডায় এসে এই প্রথম প্রকৃতির কাছাকাছি এলাম। সবুজের এমন মায়াময় হাতছানি, আহ! সবুজ ছুঁয়ে দেখার কী নরম আনন্দ! কেমন যেন মুক্ত বিহঙ্গের মতো লাগল নিজেকে, ডানা মেলে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল দূর নীলিমার সুদূর প্রান্তরে। এখানে যে সবকিছুরই অভয়ারণ্য; বন্যপ্রাণী, হাতি, হরিণ, মানুষ যে কেউই উড়তে চাইলে নেই মানা!
হাঁটতে হাঁটতে এবার চলে এলাম চিলড্রেন ওয়াটার পার্ক নামে একটি গ্যালারিতে। যেখানে পাকা মেঝেতেই মাটির তলা থেকে উঠে আসা ফোয়ারার পিছলে যাওয়া জলের মধ্যে সব শিশুরা খেলা করছে, কেউবা স্নান করছে। কেউ কেউ মনোরম সাজে সজ্জিত কৃত্রিম ঝরনায় স্নান করছে। ঝরনার ওপরের দিকে রয়েছে ওয়াটার স্লাইডিং, সেখানেও কেউ কেউ সুইং করে ঝপাৎ করে নিচে পড়ছে, একে অন্যকে পানি ছুড়ে দিচ্ছে; এটা শিশুদের জন্য এক অবিরল আনন্দ ধাম। সেখানে ঢুকতে নতুন করে টিকিটও কাটতে হলো আবার। আমাদের মেয়ে এতক্ষণ হেঁটে হেঁটে একেবারেই ক্লান্ত। তার ওপরে দিনটি ছিল খোশমেজাজের চাপা গরম আর রোদেলা ঝাঁঝে ভরা। তাই এই ফোয়ারা দেখেই সে দৌড় দিল জলকেলির জন্য। সঙ্গে করে বাড়তি কাপড় নিয়ে যাওয়াতে কোনো অসুবিধে হয়নি। ওয়াটার পার্কে খেলতে নামবে যারা, সেসব ছেলে-মেয়ের আলাদা আলাদা সুন্দর চেঞ্জ রুমও রয়েছে সেখানে।
মেয়ে যখন মনের আনন্দে পার্কের ফোয়ারায় গোসল করছে, আমি পাশেই দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ্য রাখছি। হঠাৎই কন্যার পিতা চোখের আড়াল হলে আমি তাঁকে কল দেব ভেবে ফোন খুঁজতে পকেটে হাত ঢুকালাম। ওমা! সেখানে ফোন নেই, আমার হাতব্যাগেও নেই। কখন যে কোথায় পড়ে গেছে আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না। ভীষণ খারাপ হলো মনটা। বেড়াতে এসে অবশেষে ফোনটা খোয়া গেল। একেতো কন্যার পিতার যত্সামান্য আয়! তখনো দেশ থেকে নিয়ে আসা জমানো টাকাই গিলছি বসে বসে। সবেমাত্র পড়াশোনা শেষ করে চাকরির ধান্দায় প্রমাদ গুনছি সেই মাহেন্দ্রক্ষণের! এরই মাঝে ফোন হারানো মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। এসব ভেবে মনটা খারাপ হচ্ছে যারপরনাই। তবু এই বেড়ানোর আনন্দটা মাটি করতে চাইনি বলে মনকে প্রবোধ দিলাম, এখন তো বেড়াই, পরে না হয় ভাবা যাবে ফোন নিয়ে। এভাবে মনের মধ্যে নিদারুণ খচখচানি নিয়ে আমাদের চিড়িয়াখানা ভ্রমণ পর্ব সারলাম। এবার ফেরার পালা।
দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। এরই ফাঁকে আমরা মধ্যাহ্নভোজন সেরে নিয়েছি বাসা থেকে সঙ্গে নেওয়া খাবারে। এখন ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে বাসার পথে রওনা হলাম। ফোন ফিরে পেতে পারি এমন প্রত্যাশা ভুলেও করিনি। সুতরাং, বিরস বদনে ফোনবিহীন ভারাক্রান্ত একরাশ দুঃখ বুকে নিয়ে, বেড়ানোর আনন্দ জলাঞ্জলি দিয়ে আমাকে ঘরে ফিরতেই হচ্ছে। ফেরার সময়ে হঠাৎ মনে হলো, একবার বলেই দেখি না কর্তৃপক্ষকে, যদি তাঁরা কোনো সন্ধান দিতে পারেন; তাই অতিথি সার্ভিস সেন্টারে গিয়ে জানালাম, আমার ফোনটি হারিয়ে গেছে। আমার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা আমার ফোনের বিস্তারিত বিবরণ জানতে চাইলেন এবং কখন, কোথায়, কীভাবে হারিয়েছি সে বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। আমি যথারীতি উত্তর দিয়েই যাচ্ছি কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামির মতন। অবশেষে ফোন নম্বর প্রমাণের জন্য আমার নম্বরে আমাকে কল দিতে বললেন। সকল জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রমাণ সাপেক্ষে আমি আমার হারিয়ে যাওয়া ফোনটি তৎক্ষণাৎ ফিরে পেলাম! যা আমার কাছে ছিল রীতিমতো অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর!
ভুলোমনা এই আমি আমার নিজ দেশে সেলফোন হারিয়েছি বহুবার। চলতি পথেই আমার হাতব্যাগ থেকে আমার সুহৃদেরা হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দিয়েছে, কখনো বা ঘর থেকেই চুরি হয়েছে, আবার অফিসের ডেস্ক থেকেও, এভাবে মাত্র ছয়খানা ফোন হারিয়েছি ইতিপূর্বে। আর সেখানে এই ভিনদেশে এসে ফোন হারিয়ে আবার সঙ্গে সঙ্গে তা ফিরে পাব এমন ধারণা ভুলেও করিনি। এবার নিশ্চয়ই পাঠকের জানতে ইচ্ছে করছে এটা সম্ভব হলো কীভাবে? চলুন জেনে নেই এর পেছনের রহস্যখানা!
প্রথমত, এ দেশের পাবলিক প্লেসগুলোতে, যেমন হাসপাতাল, স্কুল কলেজ, ক্লিনিক কিংবা অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি-প্রাইভেট অফিস, যেখানে প্রতিনিয়ত অনেক মানুষের আনাগোনা; নানাবিধ সেবা নিতে যায় মানুষ সেসব জায়গায় একটি করে ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড বক্স’ থাকে। ভুল করে ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র কিংবা পড়ে পাওয়া দ্রব্যাদি সযত্নে তুলে রাখা হয় সেই বাক্সে। যখন কেউ কোনো হারানো জিনিস খুঁজতে আসে তখন সেই বাক্সেই সেসব খোঁজা হয় এবং প্রমাণ সাপেক্ষে মালিককে তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আর খুব ছোটবেলা থেকেই এ দেশের শিশুরাও এই লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড বক্সের ব্যবহারবিধি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, সুতরাং সে অনুযায়ী তারাও আচরণ করে। পড়ে পাওয়া জিনিস নিজের ভেবে বাড়ি নিয়ে যাওয়া অথবা কেউ দেখেনি ভেবে নিজেরই ব্যাগে ঢোকানোর কথা কারও মাথাতেই আসে না সচরাচর। আর এ দেশের এই সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা শিশুরাই তো বড় হয়ে এই চিড়িয়াখানায় চাকরি করছে, সুতরাং পড়ে পাওয়া জিনিস মালিককে ফিরিয়ে দেওয়াই ওদের কাজ। আর একেই বলে সভ্যতা!
দ্বিতীয়ত, এখানে সেল ফোনগুলির আলাদাভাবে সিম কিনতে পাওয়া যায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সিম ও ফোনসেট একই সঙ্গে সার্ভিস অপারেটরের কাছ থেকে কিনতে হয়; যার ফলে শুধুমাত্র সেট নিয়ে কেউ বিশেষ সুবিধা করতে পারে না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে রিমসম্বলিত নেটওয়ার্ক ফোন রয়েছে; সুতরাং সেটি মূল মালিক ব্যতীত আর কারও পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। প্রিপেইড ফোন ব্যবহারেরও কোনো ব্যবস্থা নেই এখানে। ল্যান্ড লাইনের মতো মাস শেষে বিল চলে আসে নির্ধারিত ঠিকানায়। আর বিল না দিতে পারলে লাইন কেটে দেওয়া হয়। ফোন কোম্পানির এই বিশেষ ব্যবস্থাও প্রকারান্তরে ফোন চুরির প্রলোভনকে রোধ করেছে অনেকাংশে।
ফোনটি ফিরে পেয়ে যত না আনন্দিত হয়েছিলাম তার থেকে অধিক ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়েছিল মন আমার এই ভেবে যে কী করে সম্ভব! প্রতিদিন হাজার হাজার লোকের সমাগম যেখানে, সেখানে জঙ্গলে পড়ে থাকতে দেখেও একটি ফোন কারও নিয়ে যেতে ইচ্ছে হলো না! অথচ, আমাদের প্রায় ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে কমদামি জুতো খুলেও মুসল্লিরা নিশ্চিন্তে নামাজ পড়তে পারেন না। মসজিদের এই চুরি পবিত্র জুম্মাবার, ঈদের জামাত এমনকি তারাবির জামাত কোনো কিছুকেই পরোয়া করে না। আর এসব চোর আমাদের ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের মধ্যেই মিশে থাকে। ভাবলে সত্যিই আশ্চর্য হই, আমাদের শ্রেষ্ঠ ধর্ম নিয়ে কত-না অহংকার আমাদের! অন্য ধর্মাবলম্বীদের বলি বিধর্মী; মনে মনে ঘৃণাও করি তাঁদের! অন্যের জিনিস না বলে নেওয়া যে চুরি আমাদের কোনো শিশু শৈশবে-কৈশোরে শোনেনি এমন কথা? পুকুর চুরি না হলেও চুরি চুরিই! আমাদের ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের দেশে রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে প্রতিনিয়ত চুরি যায় জনগণের সম্পদ, প্রতিদিন লুট হয় নিরীহ মানুষের আর্থিক-সামাজিক সম্পদ!
বছর তিনেক আগে জাতীয় শিক্ষাক্রমের তৃতীয় শ্রেণিতে ‘ধর্ম’ বাধ্যতামূলক বিষয় থাকা-না থাকাকে কেন্দ্র করে আমাদের ইসলামি চিন্তাবিদ-শিক্ষাবিদেরা আন্দোলন করেছিলেন। অবশেষে ইসলামি সমাজসেবকেরাই জয়ী হলেন। তৃতীয় শ্রেণিতে, কোমলমতি শিশুরা ধর্মের সুবিশাল জ্ঞানভান্ডার লইয়া আদর্শ মানুষ হইবেন; এমন চাওয়া দেশের সকল বাবা-মায়েরই ছিল। অতএব, আমরা যারপরনাই খুশি! শেষতক ধর্ম তো রক্ষা হলো!
অথচ, এই বিধর্মীদের দেশে পাবলিক স্কুলে ধর্ম নামক কোনো বিষয় বাধ্যতামূলক পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হয় না। এরা ধর্মের পরিচর্যায় খুব সময় ব্যয় করে বলেও মনে হয় না। তবে, এদের সামাজিক রীতি-নীতি, মূল্যবোধগুলো সমান তালে সমাজের সকল প্রতিষ্ঠানেই কঠোরভাবে চর্চা করা হয়। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেই এদের সামাজিক রীতি সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা হতে পারে; নিজের বাড়ি থেকে শুরু করে যেখানেই যাবেন, শিশুরা বড়দের পথ ছেড়ে দেয়, দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে, বাসে-ট্রেনে, এলিভেটরে নিজেরা আগে না উঠে বয়স্ক, প্রতিবন্ধী কিংবা গর্ভবতী মাকে আগে ওঠানামার সুযোগ করে দেয়। একই আচরণ বড়রাও করেন, মূলত শিশুরা বড়দেরই অনুসারী। এই চর্চা কেবল একদিনের নয়, কোনো নির্দিষ্ট স্থানেরও নয়। পরিবার, স্কুল, চার্চসহ কমিউনিটির অন্য সব প্রতিষ্ঠানে সামাজিক নীতিশিক্ষার এই চর্চাগুলো হাজার বছরের অনুশীলন! আমাদের মতো কেবল জিপিএর পেছনে ছোটে না এরা।
খুব ছোটবেলায়ই এরা শিখে ফেলে অন্যের বিপদে কীভাবে পাশে দাঁড়াতে হয়, আবার অন্যে না চাইলে কীভাবে তাঁর প্রাইভেসিকে সম্মান করতে হয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মিথ্যা না বলা, কথা-কাজ-আচরণ দ্বারা অন্যের ক্ষতি না করা, সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব, দলগত লাভালাভের চিন্তা শৈশবেই এদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কে কতটা বেশি-ভালো গুণাবলি রপ্ত করতে পারে তার জন্য তারা অভিনন্দিত হয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক অর্জনের খাতায় সেই সঞ্চয় সম্মিলিতভাবে যোগ হয়।
আপাতদৃষ্টিতে ফোনের গল্পটি একটি সমাজের পুরো চিত্র তুলে ধরতে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে নাও হতে পারে পাঠকের কাছে। তবে, আমি এই সামান্য বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করতে চাই, কারণ, যে সমাজ অতি সামান্য (আমাদের দৃষ্টিতে) বিষয়কেও অতি সুশৃঙ্খল ও সুসংহতভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম, তাঁদের সামাজিক দক্ষতা উচ্চতর পর্যায়ের এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সমাজের অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যে পুষ্প পল্লবে বিকশিত হয়ে আছে তা আমরা প্রতিদিনের এরূপ তুচ্ছাতিতুচ্ছ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই উপলব্ধি করতে পারি। একটি সমাজ তার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় যেসব অনুষঙ্গ নিয়ে চলে, সময়ে সেসবই প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা লাভ করে। আর প্রতিদিনের জীবনাচরণের মাঝেই তার সুশ্রী স্বাক্ষর রাখে।
এমন একটি সুন্দর সমাজ, সুন্দর আগামী কল্পনা করতে পারি আমরা? যেদিন আমাদের সন্তানেরাও কারও হারিয়ে যাওয়া জিনিস প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দেবে! দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকবে অন্যের জন্য! যেদিন বিদেশি পর্যটক সর্বস্ব হারিয়েও ফিরে পাবে আবার! আর এভাবেই কেউ না কেউ লিখবেন আমাদের সভ্য সমাজের গল্পকথন? জানি, আমার জীবদ্দশায় এমন বাংলাদেশের সঙ্গে দেখা হবে না, তবু স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নেই!

সঙ্গীতা ইয়াসমিন: টরন্টো, কানাডা।

ধারাবাহিক এ রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন