ঢাকাইয়া রিকশার পীঠস্থান দর্শন

হোক্কাইডো হিস্টরিকাল ভিলেজের জাদুঘরে রক্ষিত প্রাচীন রিকশা
হোক্কাইডো হিস্টরিকাল ভিলেজের জাদুঘরে রক্ষিত প্রাচীন রিকশা

রিকশার জন্ম জাপানে কিন্তু আমাদের ঢাকা হলো রিকশার শহর। বহুকাল ধরে চলাচলের আধিক্য বুঝি ঢাকাকে দিয়েছে রিকশার শহরের এই যথার্থ তকমা। ঢাকাসহ সারা বাংলার মানুষের প্রাত্যহিক জীবনজীবিকা ও যাতায়াতের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো এই রিকশা। জাপানি শব্দ জিনরিকিশা (জিন—মানুষ, রিকি—শক্তি, শা—বাহন) থেকে এই রিকশা শব্দের উৎপত্তি। যার আভিধানিক অর্থ মনুষ্যবাহিত বাহন। ১৮৬৮-৭০ সালের দিকে জাপানের ইয়াকোহামায় জনাথন স্কোবি নামে একজন মার্কিন মিশনারি তাঁর চলৎশক্তিহীন স্ত্রীর চলাচলের সুবিধার্থে এই বিশেষ যান তৈরি করেন বলে জানা যায়। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ত্রিচক্রযানের কাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর ব্যাপক প্রসার পরিলক্ষিত হতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় ১৮৮০ সালে ভারত ও ১৯০০ সালে কলকাতা হয়ে ১৯১৫ সালের দিকে তৎকালীন বঙ্গ প্রদেশে এর প্রচলন বাড়তে থাকে।

বলা যায়, সুদূর জাপান এই রিকশার জন্মস্থান হলেও আজ তা বাংলা ও বাঙালির অর্থনীতি, সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক অপরিহার্য উপকরণ। আজকের আধুনিক জাপানে এই বিশেষ ত্রিচক্রযানের বর্তমানে কোনো প্রচলন নেই। প্রাচীন জাপানি সংস্কৃতির এক অনন্য উপকরণ হিসেবে এখনো ঐতিহাসিক জাদুঘরগুলোতে এটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত হয়ে থাকে। জাপানে অধ্যয়ন করার পাশাপাশি প্রাচীন জাপানিজ সংস্কৃতির সব ঐতিহাসিক ও অমূল্য সংগ্রহ দেখার অভিপ্রায় নিয়ে গিয়েছিলাম জাপানের সর্ব উত্তরের হোক্কাইডো দ্বীপে অবস্থিত হিস্টরিকাল ভিলেজ (জাপানি ভাষায় বলা হয় ‘কাইতাকু নো মুরা’) দর্শনে। পুরো মিউজিয়ামটাই যেন এক প্রাচীন গ্রামের প্রতিচ্ছবি। হিস্টরিকাল ভিলেজ দর্শনের ক্ষেত্রে বিদেশি দর্শনার্থীদের উচ্চ প্রবেশমূল্য থাকলেও জাপানিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার সুবাদে খুবই নামমাত্র মূল্যে সস্ত্রীক প্রবেশের সুযোগ হলো। প্রবেশমাত্রই এই ঐতিহাসিক জাদুঘরের গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি ও তার অবকাঠামোগত অবয়ব দেখে বিশ্বাসই হচ্ছিল না, আজকের আধুনিক জাপানের ভিত্তিমূলে আছে এমন সমৃদ্ধ গ্রামীণ অর্থনীতির এক বিরাট অবদান।

প্রায় এক শ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত পুরো মিউজিয়ামটাই যেন একটা জীবন্ত গ্রাম। ১৮৬৮ সালে মেইজি ও তার পরবর্তী তেইশো শাসনামলের সময়ে গড়ে ওঠে এ ঐতিহাসিক গ্রাম জাদুঘর। অধিকাংশ ঘরবাড়ি বা অবকাঠামো গ্রামীণ আবহে কাঠ দিয়ে তৈরি। পৃথক পৃথকভাবে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের ধারক হয়ে এখানে আছে প্রায় ৬০ ধরনের প্রাচীন গ্রাম্য স্থাপনার বাস্তব অবয়ব। তার মধ্যে প্রাচীন উন্নত গ্রাম, মৎস্যজীবীদের গ্রাম, কৃষকদের গ্রাম ও পাহাড়িদের গ্রাম উল্লেখযোগ্য। উল্লেখ্য, এ গ্রামগুলোতে আজও বিশেষ ব্যবস্থায় জীবন্ত করে রাখা হয়েছে বিভিন্ন প্রাচীন উপকরণ ও তাদের ব্যবহার সময়কার উদ্ভূত বিশেষ শব্দ ও সুরের মাধ্যমে। উন্নত গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবিকে উপস্থাপন করা হয়েছে রিকশা, সাইকেল, পানি সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা, পাদুকার ব্যবহার ও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে। জাদুঘরে রক্ষিত প্রাচীন রিকশার অবয়বটা একটু ভিন্ন। আমাদের দেশের তিন চাকার রিকশার মতো নয়। এটির পেছনে দুটি চাকা এবং সামনে কোনো চাকা নেই। আছে বাহক কর্তৃক টানার জন্য বিশেষ ধরনের হাতলের ব্যবস্থা। কিন্তু মজার বিষয় হলো এর ওপরের ছাউনিটা (হুড) অনেকটা আমাদের দেশের আধুনিক রিকশার মতো। বাংলার বহুল প্রচলিত এই বিশেষ যানটিকে তার আদি জন্মস্থানে দেখার অনুভূতি সত্যিই রোমাঞ্চকর।

এই হিস্টরিকাল মিউজিয়ামের আরও অন্যান্য গ্রামগুলোর মধ্যে মৎস্য গ্রামের প্রাচীন সংগ্রহশালাও বেশ সমৃদ্ধ। এখানে আছে জাপানের আদিকালের মানুষের মৎস্য আহরণের বিভিন্ন কৌশল ও উপকরণের এক নান্দনিক উপস্থাপন। মৎস্য গ্রামে প্রবেশ মাত্রই কানে এল পানির ঝিরঝির ও মাছের লাফালাফির শব্দ। মৎস্য আহরণের বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে মাছ ধরার পুরো ঐতিহ্যকে জীবন্ত করে রাখা হয়েছে। সংগ্রহের মধ্যে আরও আছে জেলেদের ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরার জাল, বড়শি, মাছ ধরার বিশেষ ফাঁদ, ছোট নৌকা ও মাছ রাখার পাত্রসহ আনুষঙ্গিক নানা দুর্লভ উপকরণ।

হিস্টরিকাল ভিলেজের সামনে সস্ত্রীক লেখক
হিস্টরিকাল ভিলেজের সামনে সস্ত্রীক লেখক

জাপানের কৃষিভিত্তিক আদিম সমাজের মানুষ কীভাবে তাদের সাংসারিক বা পারিবারিক জীবন অতিবাহিত করত তার বাস্তব উপস্থাপন আছে কৃষক গ্রামে। এখানের ছোট ছোট কাঠের ঘরের মধ্যে পুরো একটি জাপানিজ পরিবার ব্যবস্থার অলংকরণ তুলে ধরা হয়েছে। অধিকাংশ ঘরে সাধারণত আমাদের বাসার মতো খাট, চেয়ার, টেবিল বা সোফা নেই। খাওয়া, ঘুম ও বসা সবকিছু হয় ঘরের মেঝেতেই। মজার বিষয় হলো প্রতি ঘরের মেঝেতে আছে একটি করে চুলা, যার চারপাশে বসে সবাই রান্নাবাড়া করে খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে। পাশাপাশি এই চুলাগুলো ঘর গরম রাখতেও ব্যবহৃত হতো। খাওয়ার ঘর ও খাওয়া-দাওয়ার উপকরণ দেখলে মনে হবে অনেকটা আমাদের দেশের রসুইখানার মতো। এখানকার প্রাচীন কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার বিভিন্ন সংগ্রহের মধ্যে সবচেয়ে অভিভূত হলাম রেশম চাষিদের জীবন ব্যবস্থার সচিত্র উপস্থাপন দেখে। তুঁত গাছ, রেশম মথ থেকে কীভাবে সুতা তৈরি করে, চরকায় সেই সুতা কেটে কীভাবে কাপড় হতো প্রাচীন জাপানের সেই সমৃদ্ধ শিল্পকে খুবই প্রাসঙ্গিক ও জীবন্তভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

এটা দেখে প্রিয় স্বদেশের এক সময়কার সমৃদ্ধিশালী মসলিন তথা রেশম শিল্পের কথা খুব মনে পড়ে গেল। খড়-কুটা দিয়ে খুব সুন্দর করে প্রাচীন জাপানিদের বানানো বিশেষ ধরনের জুতা ও তা বানানোর কৌশল আসলে সত্যিই কৌতূহলোদ্দীপক। জুতা বানানোর এই সুনিপুণ আদিম কৌশল দেখে মনে হলো আধুনিক জুতার সূতিকাগার বুঝি জাপানের এই সব প্রাচীন গ্রামগুলো। জাদুঘরের ভেতরে পুরো গ্রামগুলো ঘুরে দেখার জন্য আছে বিশেষ ঘোড়ার গাড়ি। এগুলো দিয়ে যাতায়াতের সুবিধার পাশাপাশি আদিম ঘোড়া গাড়ির প্রচলন ব্যবস্থাকে বেশ সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এখানকার ঘোড়ার গাড়িতে ওঠার পরে প্রিয় স্বদেশের ঘোড়ার গাড়িতে চড়তে না পারার আক্ষেপ খুব পোড়াচ্ছিল। যদিও জাপানে এটার প্রচলন শুধুমাত্র এ ধরনের জাদুঘরগুলোতেই দেখা যায়। এই গ্রামীণ জাদুঘরের অন্যতম আরেকটা শিক্ষণীয় বিষয় হলো, এখানে প্রাচীন জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এক ঐতিহাসিক ও শৈল্পিক সৌন্দর্য দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। যা এখানকার নতুন প্রজন্মকে অতীতের এই সমৃদ্ধ ইতিহাস মনে করিয়ে দেবে।

সর্বোপরি এটা বলা যায়, এই বিশাল হিস্টরিকাল ভিলেজটা শুধু একটা জাদুঘর নয়, এটা একটি বিরাট শিক্ষালয়। যেখানে জাপানের বর্তমান প্রজন্ম জানতে বা শিখতে পারবে তাদের সমৃদ্ধ অতীত সম্পর্কে। নিশ্চয়ই অতীত ইতিহাস জানা বা শেখার এই চর্চা আজকের এই জাপানকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। পাশাপাশি এই আশাবাদ ব্যক্ত রাখি, আমার প্রিয় স্বদেশে যদি এমন করে গ্রামীণ ইতিহাস ও ঐতিহ্য নির্ভর এক জাদুঘর বা শিক্ষালয় গড়ে তোলা যায় তাহলে সেটাও হতে পারে বাংলার হিস্টরিকাল ভিলেজ। যা বর্তমান তথা আগামী প্রজন্মকে আমাদের সমৃদ্ধ অতীত সম্পর্কে জানতে বা শিখতে সহায়তা করবে। যে প্রজন্মের চেতনা ও শ্রমে গড়ে উঠবে আগামীর স্বপ্নের সোনার বাংলা, এই আশাবাদ সর্বক্ষণ।

মো. আনোয়ারুল ইসলাম: গবেষক, হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান।