অস্ট্রেলিয়ায় কাজের খোঁজ

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর নিজের পড়াশোনা বা পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কিত কাজ খুঁজে পাওয়া অনেকটা সোনার হরিণ পাওয়ার মতো কঠিন ব্যাপার। তবে একটু চোখ কান খোলা রাখলে আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত কাজ পেয়েও যেতে পারেন। সেটা কীভাবে সম্ভব সেই বিষয়েই আজ আলোচনা করার চেষ্টা করব।

প্রথমেই আসে আপনি কীভাবে কাজের খোঁজ পাবেন? সে জন্য আপনাকে ইন্টারনেটের ওপরে নির্ভর করতে হবে। অস্ট্রেলিয়ায় সব ধরনের কাজের সার্কুলারই হয় অনলাইনে। তাই আপনি যদি প্রতিদিন ফলোআপ করেন তাহলে নতুন নতুন যে সার্কুলারগুলো আসবে সেগুলোর খবর পেয়ে যাবেন। অনেকগুলো জবসাইট আছে এখানে। এর মধ্যে সিক (www.seek.com.au/) সবচেয়ে বিখ্যাত। গামট্রি থেকে শুরু করে সিক যেকোনো ওয়েবসাইটেই আপনি কাজের খোঁজ পেতে পারেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, গামট্রিতে যে কাজেরও খোঁজ থাকে, সেটা অনেকেই জানেন না। কারণ এটা আসলে জিনিসপত্র কেনাবেচার একটা সাইট। বিশেষ করে পুরোনো জিনিসপত্র এখানে সুলভে পাওয়া যায়। কিন্তু গামট্রিতেও কাজের সার্কুলার থাকে।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

যে কোম্পানিগুলো সবে তৈরি হয়েছে তাদের জব সার্কুলারগুলো এখানে থাকে প্রাইভেট অ্যাডভারটাইজার হিসেবে। কারণ জব সাইটে বিজ্ঞাপন দেওয়া, সেখান থেকে সিভি বাছাই করে লোক নিয়োগ দেওয়ার মতো জনবল বা সেটআপ এই কোম্পানিগুলোর থাকে না। তাই তারা গামট্রিতে বিনা মূল্যে বিজ্ঞাপন দেয়। অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর একেবারে শুরুতে কাজ পাওয়ার জন্য গামট্রি তাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে কাজ বাছাই করার ক্ষেত্রে একটু সময় দিতে হবে। আপনি যে ধরনের কাজ করতে চান, সেই অনুযায়ী ফিল্টার করে কাজ খুঁজতে হবে। সার্কুলার খুঁজে পাওয়ার পর যে কাজটাতে সবচেয়ে বেশি সময় দিতে হবে সেটা হলো একটা ভালো সিভি তৈরি।
অবশ্য ভালো সিভি না বলে কাজের উপযোগী সিভি বলাই ভালো। তার জন্য আপনাকে সার্কুলারটা একেবারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে হবে। বিশেষ করে কাজের সিলেকশন ক্রাইটেরিয়া। সেই সঙ্গে কোম্পানির বা সরকারি চাকরি হলে সেই সংস্থার ওয়েবসাইট থেকেও একটু ঢুঁ মেরে আসতে পারেন। যেটা আপনাকে সিভি তৈরিতে সাহায্য করবে। আর কাজের জন্য অ্যাপ্লাই করাটাকেও একটা কাজ হিসেবেই দেখতে হবে। তা না হলে মনযোগ দিয়ে অ্যাপ্লাই করতে পারবেন না। কাজের সিলেকশন ক্রাইটেরিয়া লেখাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটা লেখার সময় মোটেও তাড়াহুড়া করা যাবে না। কারণ সিলেকশন ক্রাইটেরিয়া পূরণ করার মতো পূর্ব অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আপনি ইন্টারভিউয়ের জন্য কল পাবেন না, যদি সেটা আপনি আপনার সিলেকশন ক্রাইটেরিয়াতে ঠিকমতো তুলে ধরতে না পারেন।
দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে হয়তো আপনি একই জবে অনেক কাজ করতেন। কিন্তু এখানে আপনাকে ওরা হয়তো শুধুই একটি কাজের জন্য চাইছে। তাই সিভিতে বাড়তি কাজগুলোর কথা না লিখে সার্কুলারে উল্লেখ করা কাজগুলোকেই আপনি কীভাবে আগের কাজগুলোতে করেছেন সেটা উল্লেখ করতে পারলে আপনার সিভি অনেক বেশি প্রায়োরিটি পাবে। আর সিভিতে আপনার নাম, ঠিকানা ও ভিসার ক্রাইটেরিয়া উল্লেখ করতে ভুলবেন না। আর রেফারেন্স থাকলে দিতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে, সেটা যদি যাচাই করতে যায় তাহলে যেন পজিটিভ ফিডব্যাক দেয়। আর রেফারেন্স না থাকলে বানানো রেফারেন্স না দেওয়াই ভালো। সিভিটা যতটুকু সম্ভব সংক্ষিপ্ত ও টু দ্য পয়েন্ট রাখতে হবে।
এরপর একটা কাজ করতে হয় যেটা আমরা সাধারণত একেবারেই করি না। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, কাজ পাওয়ার জন্য এটাই সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র। সেটা হলো কাজের অ্যাপ্লাই করার পর সেটা নিয়মিত ফলোআপ করা। বিশেষ করে আপনি যদি প্রাইভেট কোম্পানিগুলোতে অ্যাপ্লাই করে থাকেন। কারণ তাদের কাছে শত শত অ্যাপ্লিকেশন আসবে। তার মধ্যে থেকে আগ্রহী ও দক্ষ লোক খুঁজে বের করা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আপনি অ্যাপ্লাই করার পর যদি তাদের ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেন যে, আপনি অমুক পোস্টের জন্য অ্যাপ্লাই করেছেন, তারা সিভিটা ঠিকঠাক মতো পেয়েছে কিনা, তাহলে কোম্পানি বুঝে যাবে আপনার আগ্রহ আছে। সেই সঙ্গে তাদের সঙ্গে কথাবার্তায় তারা বুঝে যাবে আপনার কমিউনিকেশনটা কত ভালো।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

এভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলে যদি আপনি কোনোভাবে একটা ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করে ফেলতে পারেন, তাহলে আপনি ধরে নিতেই পারেন আপনার কাজটা পাওয়ার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ। বাকিটা আপনার ইন্টারভিউয়ের সময় তাদের কনভিন্স করার ওপর নির্ভর করছে। তবে একটা ব্যাপার এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ইন্টারভিউয়ের সময় আপনাকে এমন কোনো প্রশ্ন করা হবে না যেটার উত্তর আপনার জানা নেই। আপনাকে খুব কম ক্ষেত্রেই আপনার কাজের ক্ষেত্র সম্পর্কিত প্রশ্ন করা হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ সব প্রশ্ন করা হয়। আসলে তারা যাচাই করতে চায় আপনি এই কাজ বা কোম্পানির প্রতি ঠিক কতটা আগ্রহী।
তাই কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় মোটেই তাড়াহুড়া না করে খুবই শান্তভাবে উত্তর দিয়ে যেতে হবে। সাধারণ ইংরেজি আর অস্ট্রেলিয়ার ইংরেজির মধ্যে কিন্তু অনেক তফাৎ বিশেষকরে স্পিকিং ও লিসেনিংয়ে। অস্ট্রেলিয়ানদের ইংরেজি যেমন আপনি একটু কম বুঝবেন, তারাও কিন্তু আপনার স্পিকিং কম বুঝবে। তাই আপনি যদি ধীরে ধীরে বলেন এবং শব্দগুলো আলাদাভাবে উচ্চারণ করতে পারেন, তাহলে সেটা বুঝে নেওয়াটা ওদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। আর উত্তর সব সময় একেবারে টু দ্য পয়েন্টে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। কারণ বড় উত্তর দিতে গেলে বেশি শব্দ বলতে হবে এবং ভুল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে। আর ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার জন্য বাড়তি ঝকমকে পোশাক পরার দরকার নেই। পোশাকটা মার্জিত হলেই হলো ও যেটাতে আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। এখানে আপনি অফিসে শার্ট প্যান্ট ইন করে আসতে পারবেন তবে প্যান্টটা জিনস হলেও সমস্যা নেই।
আপনি কাজের জন্য অ্যাপ্লাই করে সফলভাবে ইন্টারভিউ দিয়ে একটা কাজ পেয়ে যেতেই পারেন। কিন্তু সমস্যা হয়ে যায় কাজ পাওয়ার পর যদি আপনি নিজেকে কাজের পরিবেশের সঙ্গে সহজেই মানিয়ে নিতে না পারেন। অনেকেই এখানে আসার পরপরই কাজ পেয়ে যান। কিন্তু সেটা আর বেশি দিন ধরে রাখতে পারেন না। অফিসে সবার সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারাটা কাজটা সঙ্গে হওয়ার পূর্বশর্ত। আপনি শুরুতেই হয়তো বা অনেক কিছুই পারবেন না। সেটা আপনার অফিসও জানে। আপনাকে শুরুতে এরা কাজ শিখিয়ে দেবে, এমনকি সেখানে মাসখানেক লাগলেও আপত্তি নেই। কিন্তু কলিগ ও রিপোর্টিং বস সবার সঙ্গে সদ্ভাব রাখাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর কোনো কিছু না বুঝলে লজ্জা ভেঙে সেটা যদি বলতে পারেন, তাহলে তারা আপনাকে সাহায্য করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে।
আর অফিসে নিজের কাজের বাইরে আরও কিছু কাজে নিজেকে সহজেই অভ্যস্ত করে নিতে হবে। যেমন নিজের চা-কফি অফিসের কিচেনে গিয়ে নিজেকেই বানিয়ে নিতে হবে। খাওয়া শেষ হলে আবার কাপটাকে আপনার নিজেকেই পরিষ্কার করে নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে হবে অথবা অফিসে ডিশ ক্লিনার থাকলে সেখানে রেখে দিতে হবে। টয়লেট ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আপনি যদি টয়লেট নোংরা করেন তাহলে সেটা আপনার নিজেরই পরিষ্কার করে দেওয়া উত্তম। আর টয়লেটে এখানে পানির ব্যবহার হয় না। তাই টিস্যু পেপারে নিজেকে অভ্যস্ত করাতে হবে। টিস্যু পেপার ব্যবহার করলেও টয়লেট শেষে তরল সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া বাধ্যতামূলক। হাত ধোয়ার পর অনেক অফিসেই হাত শুকানোর জন্য বাতাসের যন্ত্র আছে। সেটাতে হাত শুকিয়ে নিতে পারেন অথবা টিস্যু দিয়েও শুকিয়ে নিতে পারেন।
অস্ট্রেলিয়ার মানুষদের খাদ্যাভ্যাস আমাদের চেয়ে আলাদা। তাই শুরুতেই আপনি যদি বলে দেন আপনি কোনটা খান আর কোনটা খান না, তাহলে তারা সব সময়ই সেটা মনে রাখবে এবং যখনই অফিস থেকে কোনো পার্টির আয়োজন করবে আপনার জন্য আলাদাভাবে খাবারের ব্যবস্থা রাখবে। পানীয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আর পার্টিতে গিয়ে আপনি আপনার মতো থাকতে পারেন। সেখানেও কোনো সমস্যা নেই। তবে আমরা যেমন বন্ধুরা এক জায়গায় হলে অনেক আড্ডা দিই এরাও কিন্তু সেইরকম আড্ডা দিতে ভালোবাসে। তাই আপনিও সেখানে যোগ দিতে পারেন। সেখানে অফিশিয়াল ব্যাপার থেকে শুরু করে পারিবারিক সামাজিক ও বৈশ্বিক তাবৎ বিষয় নিয়েই আলাপ হয়। আপনি আপনার পরিবারের সমস্যাও ওদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তারা আপনাকে সবচেয়ে ভালো সাজেশনটাই দেবে।
এতক্ষণ আমি অফিশিয়াল কাজের কথা বললাম। যেটাকে এখানকার বাংলাদেশিরা বলেন লাইনের কাজ। মানে যার যে ফিল্ডে অভিজ্ঞতা বা পড়াশোনা আছে সেটার কথা। এর বাইরে এখানে আসার পরপরই আপনাকে বিভিন্ন অড কাজ করা লাগতে পারে, যত দিন না আপনি লাইনের জব পাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে ক্লিনিং, হোটেলের বয় থেকে রাঁধুনি, বিভিন্ন দোকানের সেলসম্যান সব কাজকেই কাজ হিসেবে দেখার মানসিকতা থাকতে হবে। কারণ এখানে সব কাজেই সমান সম্মান। আমরা বাংলাদেশিরাই শুধু যারা এই সব কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে তাদের সম্মান দিতে কুণ্ঠাবোধ করি। এমনও দেখা গেছে একই দাওয়াতে লাইনের জব পাওয়ার আগে ও পরে আলাদাভাবে সম্মান করা হচ্ছে অনেকটা শেখ সাদীর সুন্দর পোশাকের গল্পের মতো। অস্ট্রেলিয়ায় আসার পরপরই বাংলাদেশিদের কাছ থেকে এমন আচরণ পাওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। তাই সেটা নিয়ে মন খারাপ না করে এই সব ক্যাজুয়াল জব করার পাশাপাশি দিনের বাকি সময় লাইনের কাজের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে।
তবে শুরুতে এসে এই অড কাজগুলোও পাওয়া অনেকটা কঠিন। সে ক্ষেত্রে আপনার পূর্ব পরিচিতদের সাহায্য নিতে পারেন। কারণ কোনোরকম একটা আয়ের উৎস থাকলে আপনার মস্তিষ্ক ঠিকভাবে কাজ করবে। কিন্তু যদি আয়ের কোনোই উৎস না থাকে তাহলে আপনি অনেক টেনশনে থাকবেন এবং লাইনের কাজে অ্যাপ্লাই করতে গিয়ে ভুল করে বসতে পারেন। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ায় সব কাজকেই কাজ হিসেবে দেখা হয়। এর মধ্যে ছোটবড় নেই। এই আমরাই ছোটবড়, লাইনের কাজ, অড কাজ শব্দগুলো তৈরি করেছি। তবে একটা কথা বলে লেখাটা শেষ করতে চাই। বাংলাদেশে আমরা মেথর সম্প্রদায়কে ঘৃণা করলেও এখানে কিন্তু টয়লেট মিস্ত্রিদের আয়ই সবচেয়ে বেশি।

মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।