গোল্ডকোস্টে ইফতার
বিশ্বজুড়ে বর্তমানে ১৪৩৯ হিজরি সনের রমজান মাস পালিত হচ্ছে। ১৭ মে থেকে সারা অস্ট্রেলিয়া জুড়ে পালিত হচ্ছে পবিত্র রমজান। রমজান মাস মুসলমানদের জন্য বিশেষ ইবাদতের মাস। সারা বছর ধরে মুসলিম সমাজ অপেক্ষা করে থাকেন এই মাসের জন্য। ইসলামি ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের এক অনন্য নিদর্শন হলো এই মাস।
প্রবাসে নেই সাইরেনের শব্দ। গভীর রাতে ঘুমন্ত মানুষদের সাহ্রিতে জাগাতে পথে পথে নেই কোনো হাঁকডাক। নেই রমজান মাসের অফিস আর স্কুলের বিশেষ সময়সূচি। তাই ডিজিটাল পদ্ধতিই আমাদের প্রবাসীদের ভরসা। সেল ফোন বা আইপ্যাডে নানা ধরনের অ্যাপ ব্যবহার করে আজান আর সাহ্রি-ইফতারের সময় নির্ধারণ করেই আমাদের চলতে হয়। দেশের মতো সুস্বাদু ইফতারের পসরা সাজিয়ে দিন শেষে সপরিবারে ইফতার বেশির ভাগের জন্যই এক দুর্লভ ব্যাপার। এমন পরিস্থিতিতে সেই সপ্তাহ শেষে কোথাও ইফতারির দাওয়াত ভ্রাতৃত্ব বোধে উজ্জীবিত হওয়ার এক অনন্য নিয়ামক।
সাধারণত প্রবাসী মুসলমানদের বিভিন্ন সংগঠনগুলো এই ইফতার দাওয়াতের আয়োজন করে থাকে। দেশ ভেদে আয়োজনে থাকে ভিন্নতা। এই আয়োজনের মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা আমাদের শিশুরা একদিকে যেমন ইসলামি দীক্ষার সাহচর্য পাচ্ছে তেমনি তাদের পূর্বসূরিদের ধর্মীয় রীতি পালনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবগত হচ্ছে। এ ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বী লোকদের জন্য এসব অনুষ্ঠান উন্মুক্ত হওয়ায়, তারা ইসলামের ভ্রাতৃত্ব বোধ ও সোহাগকে নতুনভাবে দেখতে পাচ্ছেন।
গত শনিবার (২৬ মে) বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব গোল্ডকোস্টের উদ্যোগে গোল্ডকোস্টপ্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ইফতারের আয়োজন করা হয়। দাওয়াতে আগত অতিথিদের মাঝে ছিলেন বাংলাদেশের বাগেরহাট থেকে আগত ইমাম সাহেব, যিনি এ বছর গোল্ডকোস্টের মসজিদে তারাবির নামাজের ইমামতি করছেন। ইফতারের আগে তাঁর কিছু বক্তব্য ও ইফতার পূর্ববর্তী মোনাজাত আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিল শৈশবে মনে গ্রথিত হওয়া ইসলামি অনুশাসনগুলো। যেগুলো এখনো আমাদের নাড়া দেয়। এরপর ইফতারের শেষে সকলে জামাতে নামাজ আদায় করেন।
সবশেষে প্রতিদিনের সহজে প্রস্তুতকৃত নুডলস, পাস্তা আর খিচুড়ির পরিবর্তে সবাই মিলে একসঙ্গে তৈরি করা বেগুনি, ছোলা, পেঁয়াজি আর হালিমসহ আরও নানা দেশীয় ইফতারের সেই আয়োজনটি সত্যিই অতুলনীয় ছিল। সম্প্রতি মালয়েশিয়ান মুসলমানদের ইফতারের দাওয়াতে নানা ধরনের নুডলসের তৈরি ইফতার দেখে মনে হলো, সারা বিশ্বে একই ধর্মের মানুষ ধর্মীয় অনুভূতিতে যেমন অভিন্ন ততটাই ভিন্ন রীতিনীতির চর্চায়। দেশ ভেদে মানুষের খাদ্যাভ্যাস আর পোশাকে তা প্রতীয়মান হয়। একেকটি ভৌগোলিক সীমারেখায় ধর্মপ্রাণ মানুষদের ধর্মীয় ও সামাজিক আচারের এই মিলন আমাদের প্রবাস জীবনেই সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিগোচর হয়।
বাংলাদেশে বহুযুগ ধরে নানা ধর্মের মানুষের বসবাস। জনসংখ্যার বিস্ফোরণে মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিনিয়ত যেখানে খর্ব হয়, সেখানে মানবিক অধিকারের চিন্তা অবাস্তব। কিন্তু সেই শৈশব থেকে দেখে আসা, অন্যান্য বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় উৎসবেও বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ছুটি থাকা, আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় মানবিকতা। মানুষ যেমন নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা পাচ্ছেন, তেমনি রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসব পালিত হওয়ায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি সম্মান প্রদর্শিত হয়। তাই প্রবাসে সপ্তাহের শেষে ঈদের দিন পালন করা অথবা ঈদের দিনে অফিস কিংবা স্কুল থেকে ছুটি নেওয়া আমার প্রবাসের প্রথম দিককার জীবনের আশ্চর্যের ঘটনাই বটে! শৈশবের সময়গুলোতে রোজার মাসে স্কুল ছুটি, গভীর রাতে সাইরেনের শব্দে ঘুম থেকে জেগে সকলে সাহ্রি করা আর দিন শেষে পরিবারের সবাই মিলে ইফতার করা এসবই তাই প্রবাসে আসার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতি হয়ে যায়। যদিও আমার ও আমার পরিবারের প্রবাস জীবনের শুরু দশ বছর আগে। মাঝে বেশ কিছু সময় বাংলাদেশে থাকা আর প্রায়শই যাতায়াতের কল্যাণে সবকিছু এখনো স্মৃতির পাতায় বিলীন হয়নি।
রাকিয়া হোসাইন: গোল্ডকোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া।