সবুজ বনাম সভ্যতা

নিউইয়র্কের একটি সড়ক। সংগৃহীত
নিউইয়র্কের একটি সড়ক। সংগৃহীত

সময়টা খুব সম্ভব ২০০৬ সালের। ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি তখন। ঈদের পরদিন খুব ভোরে আমার চাচাতো ভাইয়ের প্রথম ঢাকায় আগমন। বেশ মনে আছে সেই সকালের কথা। এতটা পথের ক্লান্তি ছাপিয়ে তার চোখ দুটি চকচক করছিল। অবসন্নতার ছিটেফোঁটাও ছিল না চোখে-মুখে। শুরু হয় গল্প, প্ল্যাটফর্মবিহীন রেলগাড়ির মতো অনবরত ছুটতে থাকে তার গল্পের ঝাঁপি। যার প্রায় পুরোটা জুড়ে ছিল আসার পথে শহরের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাতের গল্প।

সপ্তাহ দু-এক পরের কাহিনি। একদিন কলেজ শেষে বাড়িতে ফিরে দেখি চাচাত ভাই কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে গ্রামে চলে যাওয়ার জন্য। শহরের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া এই ছেলে মাত্র ১৪ দিনের সম্পর্কের ইতি টানতে চায় কেন? অবাক আমি। ঘটনা কী জিজ্ঞাসা করতেই তার কান্না জড়ানো উত্তর—আপা দম বন্ধ বন্ধ লাগে। খালি বিল্ডিং বাড়ি, গাছপালা নাই, সবুজ নাই।
ওই সময়টাতে খানিকটা বিরক্ত হওয়া শহুরে আমি সময়ের পালাবদলে আজ খুব অবাক হয়ে ভাবি শহরের সঙ্গে সবুজের রেষারেষির গল্পটা মাত্র ১৪ দিনেই জেনে গিয়েছিল গ্রামের আমার কিশোর ভাইটা। বেশ অনেক বছর আগ থকে শুরু হওয়া সেই গল্পটা কিন্তু সত্যি তথাকথিত ইট-কাঠের সভ্যতার সঙ্গে সখ্য করতে গিয়ে আমাদের প্রিয় ঢাকা শহরটার প্রাণের সবুজের সঙ্গে আড়ি হয়ে গেছে বহু আগে। বাংলা সিনেমার জুনিয়র আর্টিস্টদের মতো, শহরে সবুজের ব্যবহার এখন নিতান্তই সৌন্দর্যবর্ধনে। শহুরে আমাদের চিন্তা রুমের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে রাস্তা কিংবা ফুটপাত দখল নেওয়া, সবুজ নামক সতিনের জন্য জায়গা ছাড়া সেখানে রীতিমতো বোকামি।

সত্যি করে বললে, বাঙালি ফ্রিতে পাওয়া সম্পদে অতীব খুশি হলেও তার কদরের বেলায় অতি উদাসীন। তাই বেমালুম ফ্রিতে পাওয়া অক্সিজেনের উৎস বিষয়ক চিন্তার প্রয়োজনীয়তা প্রায় শূন্যর কোঠায়। দাম দিয়ে কেনা সভ্যতার তাই বহু কদর আর সভ্যতা মানে আমাদের কাছে ইট-সিমেন্টের ধূসরতার ওপর প্রলেপ দেওয়া হরেক রঙের চাকচিক্য। আমাদের গড়া সভ্যতায় সবুজ বড়জোর দেয়ালের রঙেই মানানসই। শহুরেদের সবুজ প্রীতি শৌখিনতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকটা আর শৌখিন শব্দটাকে বগলদাবা করতে পকেটে পয়সা থাকা বাঞ্ছনীয়। খুব সম্ভবত এই সূত্রমতে সবুজের দেখা সাক্ষাৎ গুলশান বনানীর মতো জায়গাতেই বেশি পাওয়া যায়।

প্রকৃতির রঙের চাদরের পরিবর্তিত রূপ এখন আর জানান দেয় না নতুন ঋতুর আগমনী বার্তার। তাই শহুরে প্রজন্ম ঋতুর পালা বদলের খবর জানে বছরে বড়জোর দুই কী তিন দিন। তাও আবার উৎসবের সিল লাগানো ক্যালেন্ডারের নির্দিষ্ট কিছু তারিখে। একতরফা স্বার্থবাদী আমরা খুব সহজে ভুলতে বসেছি সবুজের সঙ্গে সুস্থতার গভীর প্রেমের ইতিকথা। হাতেগোনা কবি সাহিত্যিক আর প্রকৃতিপ্রেমী ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ শহুরে আমাদের কাছে সেই প্রেম উপাখ্যান যেন চোখের ঠিক নিচে ওঠা ব্রণের মতো। না উপড়ে ফেলা পর্যন্ত যেন হাত নিশপিশ করতেই থাকে।

সবুজের সঙ্গে আড়িপাতা প্রিয় শহর ছেড়ে হাজার মাইল দূরের নতুন এক শহরে আজ আমি। সভ্যতার উচ্চশিখরে থাকা এই শহরের সঙ্গে সবুজের সখ্যতায় আমি মুগ্ধ। খানিকটা আক্ষেপও হয় এই ভেবে, আমাদের শহরে দুই ‘স’-এর মধ্যকার ভাবটা কেন যে হয় না! নতুন শহরটার প্রকৃতির পরিবর্তিত রং-রূপ না চাইতেই আপনাকে জানিয়ে দেবে নতুন ঋতুর আগমনী বার্তা। শীতে বরফের চাদরে ঢাকা পড়া জরাজীর্ণ ধবধবে সাদা বুড়ি শহরটা সামার আসতে না আসতেই চটজলদি অঙ্গে জড়িয়ে নেয় রঙিন নববধূর সাজ। যে সাজটা আবার সার্ক সম্মেলন বা টি-২০ বিশ্বকাপের আগে ঢাকার সাজা ক্ষণিকের বিউটি পারলারের সাজ না মোটেও। এ দেশের সরকার আর সাধারণ জনগণের ভালোবাসা আর নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধার ফসল এই দীর্ঘস্থায়ী সাজ।

খুব জানি অনেকেই হয়তো ঠোঁট উলটিয়ে বলবেন; আমেরিকার অনেক টাকা। অত টাকা থাকলে আমরাও অনেক কিছু করে দেখাতে পারতাম। ভাই ঘটনা কিন্তু সত্য। ওদের অনেক টাকা কিন্তু দেশের প্রতি ভালোবাসার পাল্লার ওজন বাড়িয়ে আমরা কি ওদের চাইতে এগিয়ে থাকতে পারি না? দুর্নীতিতে প্রথম হওয়ার কথা খুব মনে রাখলেও কেন যে বেমালুম ভুলে যান ১৯৭১ সালে দেশপ্রেমে প্রথম হওয়ার ব্যাপারটা। ওই সময়টাতে অনেক কিছুই ছিল না আমাদের। শুধুমাত্র ভালোবাসাটাকে সম্বল করেই অর্জন করেছিলাম স্বাধীনতা শব্দটা। আপনজনের লাল রক্তের দাম দিয়ে কেনা পতাকার মর্মার্থ ভুলতে বসেছি সবাই। পতাকার সবুজ রং, বাংলার সঙ্গে সবুজের অমর প্রেমগাথার সাক্ষী। সেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা আমাদের শহরটাতে শুধু পাঠ্যপুস্তকের আটকানো।

আসুন অন্তত নিজেদের ভালোর জন্যই, আড়িপাতা সবুজের সঙ্গে সভ্যতার ভাব করিয়ে দিই আরও একবার। শুরুটা না হয় আপনার থেকেই হোক।

মীর হাসিনা আকতার: উড সাইড, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।