প্রবাসে বিয়ে বাড়ির ডামাডোল-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দেশে বিয়ে খাওয়ার সুযোগ আজকাল হয় না একদম। বিশেষ করে বিয়ের প্যাকেজ এত লম্বা হয়ে গিয়েছে যে ফুল প্যাকেজ বিয়ে খেতে গেলে ছুটির প্রায় পুরাটাই শেষ হয়ে যায়। বছর তিনেক আগে খুব শখ হলো মেয়েটাকে দেশি বিয়ে দেখাই, বিশেষ করে গায়েহলুদের অনুষ্ঠান। সেবার গিয়েছিলাম শুধু আমি আর আমার মেয়ে। তাই হাতে সময় কিছুটা বেশি ছিল। তা ছাড়া অবরোধের কারণে অনেকটাই গৃহবন্দী ছিলাম। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গিয়ে উপস্থিত হলাম গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে।

সেখানে গিয়ে আমার মনে হলো অন্য কোনো দেশে বা সময়ে চলে এসেছি। যারা আমাদের বরণ করলেন তাদের সঙ্গে কোনো দুষ্টামি হলো না, আলাপ হলো না। শুধুই প্লাস্টিক হাসি হেসে ছবি তোলা। খাওয়ার আয়োজন খুব ভিন্ন। বিভিন্ন ধরনের পিঠা দেওয়া হচ্ছে। জিলাপি ভাজা হচ্ছে। ফুচকা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কোথায় সেই গায়েহলুদের তত্ত্বের মাছ ভাজা? পুরো অনুষ্ঠানে আন্তরিকতার খুব অভাব। বিনোদন বলতে দেখলাম হিন্দি গানের সঙ্গে নাচ। মেয়েকে কী দেখাব, আমার নিজের কাছেই তো সবকিছু ভীষণ নতুন লাগছে।
যা হোক, চলে আসি আমার প্রবাসী বিয়ের গল্পে। গায়েহলুদের অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল একটি হলে। পুরো অনুষ্ঠানের আয়োজন দেখে আমি দারুণভাবে মুগ্ধ হয়েছি। এখানেও পিঠা ছিল নানা পদের। এত ধরনের পিঠা যে আছে, তা আমি নিজেও জানতাম না। তবে পিঠাগুলো বানিয়েছে ছেলে ও মেয়ের মা, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুরা। আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে এই দুই পরিবারের মানুষগুলো। ছেলে ও মেয়ের দুই পরিবারের মা-বাবা ও ভাই-বোনদের কোনো অভাব নেই। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চলে এসেছেন। মেয়ের চাচা ঘর্মাক্ত হয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন। খালা তাঁর হবু বেয়াইয়ের সঙ্গে রসিকতা করছেন হেসে-হেসে। এই দৃশ্যগুলো বড়ই মধুর।
তবে যেটা ছিল সবচেয়ে বড় চমক, সেটা হলো বিনোদন অনুষ্ঠানটি। স্বাভাবিকভাবেই আমি একটি হিন্দি গানের সঙ্গে নাচের অনুষ্ঠান আশা করছিলাম। কিন্তু আমাকে চমকে দিয়ে পরিবেশন করা হলো আদি অকৃত্রিম বাংলা ভাষায় দারুণ একটি মনমাতানো অনুষ্ঠান। সেখানে কৌতুক ছিল, গান ছিল, নাচ ছিল, নাটিকা ছিল। সবচেয়ে যেটা ভালো লেগেছে সেটা হলো অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে দুই পক্ষেরই চাচা, মামা, খালা, ফুপু সব মুরুব্বিরা পর্যন্ত। মেয়ের বাবা যখন তাঁর এক বন্ধুর সাহায্যে গান গাইতে শুরু করলেন—তুই কি আমার পুতুল পুতুল সেই ছোট্ট মেয়ে...’ তখন চোখের পানি ধরে রাখাই ছিল কষ্টকর।
পরদিন বহুপ্রতীক্ষিত বিয়ে। গায়েহলুদে যেহেতু মেয়ের বাড়ির পক্ষ থেকে ছেলের পক্ষকে বরণ করেছি তাই বিয়ের অনুষ্ঠানে বরযাত্রী যাওয়াই ঠিক করলাম দুই পক্ষকে খুশি করার জন্য। যথারীতি রওনা দিতে দিতে অনেক দেরি হয়ে গেল। বিয়েবাড়িতে কেই-বা কবে পেরেছে সময়মতো রওনা দিতে? কিন্তু এ কথা বোঝাবে কে ছেলের বাবাকে? দুর্ভাগ্যক্রমে আমি তাঁর সঙ্গে একই গাড়িতে। তাঁর মেজাজ প্রচণ্ড গরম। আমিও দু-একটা ধমক খেয়ে গেলাম। সাজগোজ করে যারা রওনা দিতে দেরি করেছে সেই দলের আমিও একজন। তাই বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ধমক আমার প্রাপ্য ছিল। তবে আমি ভয় পাচ্ছিলাম টেনশন করতে গিয়ে তিনি না আবার অসুস্থ হয়ে যান।
অবশেষে বিয়ে বাড়িতে পৌঁছালাম। বর নামছে ধীরেসুস্থে গাড়ি থেকে। আমি ভাবলাম মুরুব্বি মানুষ আমি, গেট ধরাধরির ঠেলাঠেলিতে নাই থাকি। মেয়ের মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে দোতলায় চলে গেলাম মেয়ের কাছে। সবকিছু ছাপিয়ে চোখে পড়ছিল ভীষণ আনন্দ। অনাগত জীবনের মিষ্টি মধুর স্বপ্নে চোখ দুটো মাখামাখি। আমি খুশিমনে নিচে নেমে আসলাম। এসে দেখি বর ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। দরজা বন্ধ। পাশের একটি দরজা খোলা দেখে ঢুকে গেলাম। ঢুকে কেমন যেন অস্বস্তি হলো। স্টেজে অন্য এক জোড়া বর বউ। ভাবলাম কী জানি কোনো নাটক হচ্ছে হয়তো। ভিড় ঠেলে কোনার একটি টেবিলে জায়গা করে নিলাম। আশপাশে কাউকেই চেনা ঠেকছে না। টেবিলে কিছু সাদা ও কালো লোক। অস্বস্তি বেড়েই চলছে। এমন সময় হঠাৎ শুরু হলো ধুমধাড়াক্কা হিন্দি নাচ। ঠিক তখনই আমি বুঝে গেলাম আমি ভুল বিয়েতে এসেছি। সঙ্গে সঙ্গে হল থেকে বেরিয়ে ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখলাম আমার আন্দাজ ঠিক। পাশাপাশি দুটো বিয়ে হচ্ছিল। ভুল করে ঢুকে গিয়েছি অন্যটায়। ভাগ্যিস খেয়ে ফেলিনি। বিয়েতে আত্মীয়স্বজন ছাড়াও দুই পক্ষের অনেক বন্ধুবান্ধব এসেছেন। খুব ভালো লাগল সবার সঙ্গে দেখা হয়ে। পরিচ্ছন্ন, মার্জিত, রুচিসম্মত ও আনন্দে পরিপূর্ণ একটি বিয়ে। তবে দেশের যে জিনিসটি প্রচণ্ডভাবে মিস করেছি, বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল কাচ্চি বিরিয়ানি, রোস্ট, রেজালা, বোরহানির স্বাদ। এভাবেই সমাপ্তি হলো বিয়ে। দুই দিন পরে বউভাত অন্য একটি শহরে। আমি বর বউকে বরণ করতে চলে গেলাম সেই শহরে।
সেই বাড়িতে গিয়ে বিয়ে বাড়ির আসল মজা উপভোগ করেছি। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজন। সবাই অলসভাবে গল্প করছেন, খাচ্ছেন। ছেলের মা প্রচণ্ড ব্যস্ত। যাকে তাঁকে মাঝে মাঝে ধমক দিচ্ছেন আর আমরা হেসেই খুন। কে কোথায় ঘুমাচ্ছেন কোনো ঠিক নেই। গভীর রাত পর্যন্ত চলছে আড্ডা। রুম খালি রেখে সবাই গাদাগাদি করে একসঙ্গে ঘুমাতে চান। কেউই কোনো গল্প মিস করবেন না। বাথরুমের সামনে লম্বা লাইন। গোসল, প্রাতঃকৃত্য সবকিছুই সারতে হচ্ছে প্ল্যান করে, না হলে বিরাট সমস্যা। জানি না কত দিন পরে এ রকম একটি বিয়ে বাড়ির আনন্দ পেলাম। কাছের, দূরসম্পর্কের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশী, সবাই মিলেমিশে একাকার। বয়স্কদের একটি গ্রুপ হয়ে যাচ্ছে। কেউ হাঁটতে বের হচ্ছেন যারা বেশি স্বাস্থ্যসচেতন। কমবয়সীদের আরেকটি গ্রুপ। তরুণ-তরুণীরা বের হয়ে যাচ্ছে আলাদাভাবে ঘুরতে। বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
একটি মেয়ে এসে বউভাতের বিকেলে বউকে সাজিয়ে দিল। সেই সঙ্গে আমরাও একটু চান্স নিলাম। কে কী পরবে, কাকে কেমন লাগছে এগুলো নিয়ে প্রশ্ন, হুড়োহুড়ি। বউভাতের আয়োজন হয়েছিল ইতালিয়ান পাড়ায়। অসাধারণ বাঙালি খাবার। সঙ্গে উল্লেখযোগ্য যেটা ছিল সেটা হলো বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন। বিদেশি মিষ্টান্ন কিন্তু ভীষণ মজার। বউভাতের অনুষ্ঠানেও কিছুটা ভিন্নধর্মী আয়োজন ছিল। ছিল কিছু মজার কৌতুকময় স্লাইড শো। কিছু ছোটখাটো শুভেচ্ছা বাণী। দেখা পেয়ে গেলাম কিছু পুরোনো পুরোনো বন্ধুর। অবশেষে আমাদের বাঙালি রীতি ও ঐতিহ্যকে মেনে চলে এই অনুষ্ঠানে অনেক দেরি হলো। পুরো অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে মাঝরাত শেষ। কিন্তু তাতে কি? সবার মনেই তখনো আনন্দের রেশ, বিয়ে বাড়ি বলে কথা।

তামান্না ইসলাম: ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।