আকাশ তোমার রহস্যের দ্বার খুলে দাও

আকাশ তোমার রহস্যের দ্বার খুলে দাও
আকাশ তোমার রহস্যের দ্বার খুলে দাও

জাপানে আসার পর থেকে আকাশ এক নতুন রূপে ধরা দিয়েছে আমার কাছে। ধুলোবালি কম বিধায় মনে হয় মাঠের এ মাথা থেকে ও মাথা দৌড়ে গেলেই হয়তো আকাশের দেখা পাব। যা হোক আসি আসল কথায়।

সম্প্রতি বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন একটি অধ্যায়ের সংযোজন হয়েছে। তা হলো বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ। ইতিমধ্যে উপগ্রহটি তার নিজস্ব অবস্থানে বা অরবিট স্লটে পৌঁছেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনার ঝড় উঠেছিল আমাদের মতো দেশের এত ব্যয়বহুল প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। তবে আমি এখানে কৃত্রিম উপগ্রহ দরকার ছিল নাকি ছিল না, সেই আলোচনায় যাব না। বেশ কয়েকজনের লেখা পড়ে মনে হয়েছে মহাকাশের উৎপত্তি বা কৃত্রিম উপগ্রহ বিষয়ে অনেকেরই স্বচ্ছ ধারণা নেই। এর একটি বড় কারণ হলো, আমাদের বিজ্ঞানের পাঠ্যবইগুলোতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপস্থাপন করা হয় ধোঁয়াশার সঙ্গে। তাই আমার স্বল্পজ্ঞান দিয়ে রহস্যময় এই মহাবিশ্বকে নিয়ে কিছু লেখার সাহস করছি। তবে আগেই বলে নিচ্ছি, দয়া করে ধর্ম ও বিজ্ঞানকে একসঙ্গে গোলানোর চেষ্টা করবেন না।

বিগ ব্যাংকে ধরা হয় মহাবিশ্বের সূচনার নিয়ামক হিসেবে। যা সংঘটিত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি বছর আগে পরমাণুর চেয়েও বহুগুণ ক্ষুদ্র প্রায় শূন্য আয়তনে ঘটা একটি বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। বিগ ব্যাংয়ের পর শূন্য আয়তনের মহাবিশ্ব ছড়িয়ে পড়ে আর সময়ের পরিক্রমায় সৃষ্টি হয় গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি।

বর্তমান সময় থেকে প্রায় ৪৫৬ কোটি বছর আগে তৈরি হয় সৌরজগতের প্রাণকেন্দ্র সূর্য। সূর্যের আশপাশে ছিল গ্রহ উপগ্রহ তৈরির জন্য পর্যাপ্ত পদার্থ। যেগুলো সময়ের সঙ্গে মহাকর্ষের টানে কাছাকাছি এসে একত্রিত হয়ে গ্রহের আকার ধারণ করে সূর্যের চারপাশে ঘুরতে থাকে এবং তৈরি করে সৌরজগৎ। এই গ্রহগুলোর একটি আমাদের পৃথিবী। আজকের পৃথিবীর সঙ্গে সূচনালগ্নের পৃথিবীর কোনো মিল নেই। কেননা আজ থেকে ৪৫৪ কোটি বছর আগে যে পৃথিবী গ্রহের আকার ধারণ করে তার ভর ছিল বর্তমান ভরের ৮০ শতাংশ। এ অবস্থায় পৃথিবী ছিল সম্পূর্ণ অর্ধ-তরল গলিত লাভার একটি গোলাকার খণ্ড। তখন পৃথিবীর ঘূর্ণন ছিল বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি আর নিজ অক্ষের ওপর একবার ঘুরতে সময় লাগত মাত্র ৬ ঘণ্টা।

ক্রমে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথ নির্ধারণ করে নিল। পৃথিবীর তাপমাত্রা কমতে লাগল। হালকা পদার্থ তরলের ওপরে উঠে এসে ভূপৃষ্ঠের আচরণের তৈরি করতে থাকল আর ভারী পদার্থ ডুবে গিয়ে পৃথিবীর কেন্দ্রে ভারী লোহা ও নিকেলের মিশ্রিত একটি ‘কোর’ তৈরি করল। এই ধাতব কেন্দ্র থেকে একটি চৌম্বক ক্ষেত্রের সৃষ্টি হলো যা সূর্যের ক্ষতিকর আয়নিত কণা থেকে পৃথিবীর জীবজগৎকে রক্ষা করে চলে প্রতিনিয়ত।

৪৫৩ কোটি বছর আগে প্রায় মঙ্গল গ্রহের সমান একটি বস্তুখণ্ড ঘণ্টায় প্রায় ২৫ হাজার কিলোমিটার বেগে এসে পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে। এই সংঘর্ষের ফল ওই বস্তুর কিছু অংশ পৃথিবীতে থেকে যায় আর বাকি অংশ ছড়িয়ে পড়ে মহাকাশে। ছড়িয়ে পড়া এই বস্তুর কিছু অংশ মহাকর্ষের টানে একত্রিত হয়ে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরতে শুরু করে। সৃষ্টি হয় পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ।

ধাপে ধাপে পৃথিবীতে আসতে থাকে পরিবর্তন। আজ থেকে ৩৮০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে সৃষ্টি হয় প্রথমবারের মতো স্থায়ী সমুদ্র। যা ছিল প্রথম প্রাণের উৎপত্তিস্থল ও আবাস।
এখন দেখা যাক কৃত্রিম উপগ্রহ কীভাবে কাজ করে। গ্রহকে ঘিরে যেসব বস্তু নিজস্ব কক্ষপথে ভ্রমণ করে তাদের উপগ্রহ বলে। যেমন, চাঁদ হলো পৃথিবীর উপগ্রহ। যেহেতু পৃথিবীর উপগ্রহের নাম দেওয়া হয়েছিল চাঁদ (moon), তাই যখন গ্যালিলিও গ্যালিলি বৃহস্পতি গ্রহের চারটা চাঁদ আবিষ্কার করলেন, বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলার তাঁকে চিঠি লিখে বললেন, যেন তিনি সেগুলোকে মুন না ডেকে ‘স্যাটেলাইট’ ডাকেন। এই শব্দটি এসেছে লাতিন ‘satelles’ থেকে, যার অর্থ অনুচর।

কৃত্রিম উপগ্রহটি মহাকাশে পৃথিবী, চাঁদ ও অন্য গ্রহগুলোর চারপাশে অবস্থান করে একই কক্ষপথে ঘোরে। কৃত্রিম উপগ্রহ এমনভাবে পৃথিবীর চতুর্দিকে ঘূর্ণমান হয়, যাতে এর গতির সেন্ট্রিফিউগাল বা বহির্মুখীন শক্তি ওকে বাইরের দিকে গতি প্রদান করে। কিন্তু পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি একে পৃথিবীর আওতার বাইরে যেতে দেয় না। উভয় শক্তি কৃত্রিম উপগ্রহকে ভারসাম্য প্রদান করে এবং কৃত্রিম উপগ্রহটি পৃথিবীর চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে। যেহেতু মহাকাশে বায়ুর অস্তিত্ব নেই তাই এটি বাধাহীনভাবে পরিক্রমণ করে। কৃত্রিম উপগ্রহগুলো বৃত্তাকারে পরিক্রমণ করে না, তার গতি ডিম্বাকৃতির।

পৃথিবী থেকে বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে তথ্য পাঠানো হয়। কৃত্রিম উপগ্রহ সেগুলো গ্রহণ করে ও বিবর্ধিত করে পৃথিবীতে প্রেরণ করে। কৃত্রিম উপগ্রহ দুটি ভিন্ন কম্পাঙ্কের তরঙ্গ ব্যবহার করে সিগনাল গ্রহণ ও পাঠানোর জন্য। কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পৃথিবীতে আসা সিগনাল অনেক দুর্বল বা কম শক্তিসম্পন্ন হয়ে থাকে। তাই প্রথমে ডিস অ্যানটেনা ব্যবহার করে সিগনালকে কেন্দ্রীভূত করা হয় ও পরে রিসিভার দিয়ে গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করা হয়।

বিজ্ঞানীদের মতে সূর্যের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমাদের সৌরজগতের সমাপ্তি। এই যে পৃথিবীর এত প্রাণের জোয়ার, হাসি, খেলা, কান্না, সফলতা, ব্যর্থতা, খুন, ধর্ষণ, যুদ্ধ সবকিছুর ইতি ঘটবে যদি না অন্য কোনো বাসযোগ্য গ্রহের সন্ধান না মেলে।

মহাকাশের সকল রহস্য উদ্‌ঘাটনের জন্য বিজ্ঞানীরা নিরলস গবেষণা করে যাচ্ছেন। কিন্তু সবচেয়ে জটিল রহস্য হলো এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি কী উদ্দেশ্যে হলো তা আজও অনুদ্‌ঘাটিত। তাই তো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:

‘আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি আমি পেয়েছি মোর স্থান
বিস্ময়ে তাই জাগে জাগে আমার গান
অসীম কালের যে হিল্লোলে জোয়ার ভাটায় ভুবন দোলে
নাড়িতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান
বিস্ময়ে তাই জাগে জাগে আমার গান
ঘাসে ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে
ফুলের গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে
ছড়িয়ে আছে আনন্দেরই দান
বিস্ময়ে তাই জাগে জাগে আমার গান
কান পেতেছি চোখ মেলেছি ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি
জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান
বিস্ময়ে তাই জাগে জাগে আমার গান
আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি আমি পেয়েছি মোর স্থান
বিস্ময়ে তাই জাগে জাগে আমার গান।
— — —

রাহনুমা সুলতানা: সিন মিসাতো, সাইতামা, জাপান।