হীরার টুকরো বাবা

লেখকের বাবা
লেখকের বাবা

আমার ফেসবুক অ্যালবামের ছবিতে প্রিয় বন্ধু মন্তব্য করেছিলেন, ওল্ড ইজ গোল্ড। মন্তব্য ক্ষণে জানতে চেয়েছিলাম, মাই ফাদার ইজ ওল্ডার দ্যান মি। হোয়াট অ্যাবাউট হিম। এর উত্তর না পেয়ে অপেক্ষিত বিবেক সায় দিল, ইফ আই গোল্ড, মাই ফাদার ইজ ডায়মন্ড।

আমিও বাবা হয়েছি। প্রতিদিন সন্তানের আব্বু ডাক শুনে অভ্যস্ত। এই ডাক যত শুনি ততই মধুর লাগে। ইচ্ছে হয় অবিরাম শুনতেই থাকি! সন্তানের হাসি-তামাশায় নিজেকে কল্প-শিশুতে বিবেচনা করি। উপমায় বলি, আমিও কী বাবাকে এমনতর ডেকেছিলাম? বলতে পারব না, উত্তরও কারও কাছে চাইনি। সাবালক হওয়ার পরে বাবাকে এমনিতে ডেকেছি বলে মনে পড়ে না। বন্ধন যখন চিরতরে ডাকে কী যায় আসে! ‘হিরার টুকরো বাবা’ ভালোবাসার এমন আবেগী অপব্যাখ্যা পেলাম কোথায়? যার বাবা চলে গেছেন এক শ কেজি হিরা দিলেও তো কেউ বাবা এনে দিতে পারবেন না।


বাবা বার্ধক্য রোগে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। কই, কিছুই করতে পারছি না! অনিদ্রা, অরুচি, দুর্বলতা রোধে কোনো ঔষধই তো বাবাকে সুস্থ করে তুলছে না। যাঁর অছিলায় জগতের সবই দেখে উপভোগ করলাম তাঁকেই সুস্থ করতে পারলাম না। তবে কি আমি অপরাধী? সে উত্তর তো আজব কারিগরই ভালো জানেন। নয়তো ইচ্ছে করেই তিনি এমন খেলা খেলেন। ক্ষমা তো চাইতেই পারি, সে দরজাও তো খোলা। কিন্তু সন্তানকে ক্ষমার আগেই বাবা তার ঊর্ধ্ব আসনে বসে আছেন। জগতে কত কী অনিয়ম চলে! প্রতিদিন নিয়ম ভেঙে কত পথ চলি সে হিসাবও তো রাখি না! এতসবে শুধু একটি অনিয়ম যোগের ক্ষমতা যদি পেতাম; প্রথমেই বাবাকে সুস্থ করে চিরতরে রেখে দিতাম!

বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসি। যে ভালোবাসার সংজ্ঞা জানি না এবং শিখতেও পারিনি। ভালোবাসা নামের গুণে আছে অমৃত। যার অভ্যন্তরীণ প্রেমময় যন্ত্রণা আমাকে শিখিয়েছে পরমানন্দ। তোমার ভালোবাসা সংস্পর্শে আমার সকল দুঃখ হয় পরাজিত। তোমার দৃঢ় ভালোবাসা দিবসহীন; জীবনের সর্বময় প্রেরণা। তোমার সৃষ্টে আমিই দলিল। তুমিই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরুষ। তোমার রূপেই আমি আকার। তোমার রোপা কড়ই গাছের শিকড়গুলো নিজের মতোই দিক নিয়েছে। হিরা, মুক্তা, মণি ও পান্না; এই সব জড় পদার্থে মূল্য কষে আমি রয়ে গেলাম অপদার্থ। তোমার তুলনা শুধু তুমিই! অন্য কোনো কিছুতেই তা হয় না, হতেও পারে না। চলে যাবে? সে আর নতুন কী? তুমি যাও, আমিও আসছি। বিধাতা অধীনে তুমি যে মরণ বিদায় স্মৃতি আমাকে দিয়ে যাবে; আমি তাকে নতুন জীবনের অচিন যাত্রী হিসেবে চিনি। শুরু থেকেই আমরা ভিন্ন ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। তাই তো আজও জানতে পারিনি, কত শত জনমের দায়ে ভাগ্যকূলে তোমার মতো বাবা পেয়েছি। ভালোবাসি দৃষ্টান্তের জীবন তোমাতে নিলাম গেলেও শেষবারের মতো বাজি খেলতে কোনো দ্বিধা নেই! বিশ্বাস অনুকূলে তোমার বিকল্প আমাতে কিছুই নেই। বাবা তুমি সুখী হও, চির সুখে থেকো। যেখানেই থাকো, অনাবিল শান্তিতে থেকো।

বি. দ্র.: উপরিউক্ত লেখাগুলো প্রথম আলোতে দাখিলের জন্য বাবা দিবসের অপেক্ষায় ছিলাম। এরই মাঝে বাবা আমাকে জনমের মতো দিবস দিয়ে গেছেন। গত পয়লা রমজান (শুক্রবার) সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে বাবা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। এই পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যুতে কেঁদে ছিলাম, তাও অতি সামান্য। পরে অনুতপ্ত হয়ে বলে ছিলাম, আমার এই কান্না মৃত ব্যক্তির কোনো মঙ্গল বয়ে আনেনি। ভবিষ্যতে কারও মৃত্যুতেই কাঁদব না। মৃত যাত্রীকে তাঁর মহাজনের হাতে হাসিমুখেই তুলে দেব। এটাই প্রকৃতি।

বাবার মৃত্যু সংবাদ যেকোনো সময়ে আসতে পারে প্রস্তুত ছিলাম। সকল প্রস্তুতিই বাবার শোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল! অঝোরে চোখের পানি ঝরছে! দেরি না করে ওমরাহর পোশাকে বায়তুল মামুরের দিকে রওনা করলাম। সেখানে (কাবাঘর) জামাত শেষে সকল মৃত মুসলিম নর-নারীর জানাজা এক সঙ্গে পড়া হয়। এই জানাজা বিশ্বজুড়ে। আমি বাবার সাক্ষী হয়ে জানাজায় অংশগ্রহণ করতে ছুটলাম। কিছুতেই চোখের পানি থামাতে পারছি না। একা থাকায় বেশ চুপ ছিলাম। সঙ্গে বাবার শোক পাথরের মতো স্তব্ধতা দিয়েছিল। হাজার হাজার মানুষ থাকলেও বিনা প্রয়োজনে কোনো কথা বলিনি। কান্নাই অগ্রাধিকার পেয়েছিল! মানুষের দেহে এত পানি থাকতে পারে এই প্রথম বুঝতে পারলাম! বুঝতে শুরু করেছি থেকে জীবনে কখনো এত বেশি কাঁদিনি, কাঁদতে হয়নি। মন আমার উদাস। বাবা চলে গেলে কী বাঁচার মতো বাঁচা হয়! হৃদয়ের উত্তাল ঝড়ঝাপটা গীতিকারের লেখাই স্মরণ করিয়ে দিল—‘সাগরের জল দেখতে বেশি, আমার চেয়ে বেশি বয় না।’ বইবেই বা কেমন করে, তিনি তো সাগরকে বড় বলেননি। তিনি আমাকেই (মানুষকে) সবের সেরা বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সাগরের জল যত বেশিই বয়ে যাক তা নির্বোধ, শুধু আমার জলেই আছে বোধ।

বেশ কিছুদিন ধরে বাবা খানাপিনা ছেড়ে দিয়েছিলেন। মাঝে মধ্যে দু-চার চামচ সাবু খেতেন। মৃত্যুর আগের দিন (বৃহস্পতিবার) বাবা ভাত নিয়ে বসলেন। গরুর কলিজা দিয়ে ভাত মাখলেন। নিজে এক লোকমা খাওয়ার পরে ঘরের সবাইকে এক লোকমা করে খাইয়ে দিয়ে বললেন, তারে তো আর দেখলাম না, নে, এই লোকমাটা ফ্রিজে রেখে দে, সে আসলে দিস। আমার ভাত খাওয়া শেষ। বাবা সত্যিই আর ভাত খাননি। হাতের ১৬ হাজার টাকাও মাকে দিয়ে দিলেন।

শাম্মীকে (স্ত্রী) বলেছি, লোকমাটি যতন করে রেখে দিয়ো। বেঁচে এলে অবশ্যই খাব। এই ভাতের জন্য প্রবাসে পরে আছি বলেই আজ বাবাকে নিজ হাতে মাটি দিতে পারলাম না। এই দেখো! আবারও চোখে পানি, কী আশ্চর্য...! এখানেই তো শেষ নয়! দুঃখ ছিল, প্রতিনিয়ত আসছে আরও আসবে। আমাকে আরও অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃখ অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে হবে! বাবার এই এক লোকমা ভাতের চিরতর মূল্য আমাকে আজীবন চোখের পানিতেই দিতে হবে।

বাবা বলেছিলেন, রমজানের আগে আসলেই ভালো হতো! শিগগিরই পরবাসকে নিপাত দিয়ে দেশে ফিরে এসো। এ দেশেও না খেয়ে মরবে না। না খেয়ে মরব না জানলেও বাবাকে উত্তর দিয়েছিলাম, হজের পরে আসব। সত্যি বলতে কী, যেখানেই থাকি রিজিক শেষ না করে মরব না। তবুও, যেকোনো কারণেই হোক, বিধানকর্তা আমার ওপর প্রবাসনীতি ধার্য করে ছিলেন। এই প্রবাস আমার কাছ থেকে অনেক আপনজনকে নিয়ে গেছেন, সবশেষে বাবাকেও নিলেন। শেষ দেখাটাও দেখতে দিলেন না! আমি বাবার মতো দুঃখ পোষণ করা শিখলেও এবারের দুঃখে ভারাক্রান্ত, আমার কণ্ঠ ভারী হয়ে গেছে, বুকেও ব্যথা! মালিকের কৃপাই একমাত্র পাথেয়।

সবশেষে মদিনা শরিফ জিয়ারত করে এলাম। কান্নাকাটির কথা লিখে পাঠক পাঠিকাকে আর বিরক্ত করতে চাই না! যতটুকু জানি, এই দিনে মৃত ব্যক্তি বিশেষভাবে পুরস্কৃত হন। আমার এমনকি শিক্ষা-দীক্ষা আছে বাবার জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করি, বরং বাবাই অদৃশ্য ছায়ার আড়াল আদরে আমাকে তাঁর বুকে জড়িয়ে রেখেছেন। কর্তাহীন গৃহে আমি আর কাকে মনের কথা খুলে বলব! শুনবেই বা কে। আমার বলার জায়গা সংকীর্ণ হয়ে গেছে। আমি ঘরের ভেতর ঘর হারিয়েছি, আমার লেখার ভেতরে লেখা ঢুকে পড়েছ! এখনই লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। আজ আমি এতিমের দরিয়ায় হাবুডুবু খাচ্ছি, কাল মা গেলে পরশু ডুবেই মরব। হায়রে নিয়তি! এই তোমার লীলা! চিরদিনই বুঝি এমন খেলা খেলছ তুমি মানুষ অন্তরালে।

মো. জিয়াউদ্দিন শাহ্: জেদ্দা, সৌদি আরব।