তবুও আমরা ভালো আছি

লেখক
লেখক

বাংলাদেশে প্রবাসীদের পরিবারগুলো এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কেনাকাটা নিয়ে। তাদের কারও হয়তো মন খারাপ পছন্দের পোশাক কিনতে না পারার জন্য। পরিবারের নারীরা ঈদের স্পেশাল আইটেম তৈরি করা নিয়ে চিন্তিত। কাকে কাকে দাওয়াত দেওয়া যায় তার তালিকা করছেন কেউ কেউ। আর ছোটরা কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায় তার পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত।

ঠিক তখন জন্মভূমি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে পরিবার পরিজন ছেড়ে প্রতিদিনের মতো কাজ করে যাচ্ছি আমরা প্রবাসীরা। মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের জন্মই হয়েছে অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। নইলে প্রিয়জন শপিং করে যখন তাদের নতুন পোশাকের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল ছবি পাঠায় তখন আনন্দে স্বর্গীয় সুখ অনুভব করি কেন?
দুই–তিন দিন সহকর্মীদের সঙ্গে ঈদ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করলে সবাই একই স্বরে বললেন, আমাদের পরিকল্পনা একটাই ঈদের দিন যেন ছুটি পাই। কারণ আমাদের শিফট ডিউটি করতে হয়। শিফট ডিউটি অনুযায়ী আমাদের সবারই কাজ আছে। আমাদের ছুটি নির্ভর করে লোকবলের ওপর। আমি বললাম, আশা করি আমরা সবাই ছুটি পাব।
আনোয়ার ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই ঈদের জন্য কি কেনাকাটা করলেন? তিনি মুখে ম্লান হাসি ফুটিয়ে জবাব দিলেন, ভাই রোজা শুরু হওয়ার আগে বাড়িতে ইফতার করার জন্য অতিরিক্ত টাকা পাঠিয়েছি এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে। কারণ প্রতি মাসে আমার যে বেতন আসে, গত মাসেও তাই এসেছিল। তাই অতিরিক্ত টাকাটা ধার করতে হয়েছিল।
এখন ঈদে শপিং করতে আবার বাড়িতে টাকা দিতে হবে। আমি তো বেতন আগের মতোই পাব। ঈদ বলে অতিরিক্ত কিছু পাব না। এটা তো আর বাংলাদেশ নয় যে ঈদের বোনাস দেবে। তাই এই শপিংয়ের জন্য অতিরিক্ত টাকা ধার করতে হবে। এখন আপনিই বলুন আমি কোথা থেকে নতুন জামা কিনব। আমি আর কথা বাড়ালাম না। আমি জানি আমিও গত তিন বছর ধরে ঈদে নতুন জামা কিনি না। পুরোনো যেগুলো দেশ থেকে নিয়ে এসেছিলাম সেগুলোই ইস্ত্রি করে পরব।

সহকর্মীদের সঙ্গে লেখক
সহকর্মীদের সঙ্গে লেখক

আসলে রমজান মাস আর অন্যান্য মাসের মধ্যে আমাদের প্রবাসীদের কোনো পার্থক্য নেই। রোজা উপলক্ষে বিশেষ কর্মসূচি নেই। আগের মতোই ডিউটি করতে হয়। ভোর রাতে সাহ্‌রি খাবার পর এক ধরনের ঘুমের মাদকতা অনুভব করি। চোখ বন্ধ হয়ে আসে। শুধু আমি না এই সময় সকল প্রাণীই মাদকতায় ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের সেই সুযোগ নেই। সাহ্‌রি খাওয়া শেষ করেই ঘুম ঘুম চোখে ছুটতে হয় অফিসে। ডিউটি শেষে কাজের সাইটেই বন্ধুদের সঙ্গে ইফতার করে নেই। অনেক সময় বাসে বসেই ইফতার করতে হয়।
কাল এক রুমমেট রাত এগারোটায় ডিউটি শেষ করে বাসায় ফিরেছিল। ডিউটি থেকে ফিরেই তিনি জামাকাপড় ধোয়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, এত রাতে কাপড় ধোয়ার দরকার কি? তুমি ঘুমাবে কখন? খাবে কখন? রুমমেট জবাব দিলেন, ভাই আজকে প্রচুর গরম ছিল। কাপড় ঘামে ভিজে জবজবে অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। এখন জামা থেকে ঘামের দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এখন না ধুলে আগামীকাল পরা যাবে না।
রুমমেট ঠিকই বলেছেন। ইদানীং সিঙ্গাপুরে যে গরম পড়েছে পরনের কাপড় ঘামে ভেজে আর শুকায়। তাই যত রাতই হোক কাপড় পরিষ্কার করতে হবে। কাপড় ধুয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাত একটায় ঘুমাতে হবে। আবার রাতের শেষ প্রহর পাঁচটায় উঠে সাহ্‌রি খেয়ে ডিউটিতে যেতে হবে। এইতো জীবন!
আমি জিজ্ঞেস করলাম ঈদের কেনাকাটা কি করলেন? তিনি বুকের কষ্ট লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন, ভাই ঈদের দিনের জন্য নতুন ইউনিফর্ম তুলে রেখেছি। বছরে একটা ঈদ পুরোনো জামা পরে তো আর ডিউটি করা যাবে না। তাই নতুন ইউনিফর্ম পরেই ডিউটি করব।
তার কথা শুনে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারণ আমারও ঈদের দিন ডিউটি ছিল। বসকে বলে বহু কষ্টে ঈদের দিন ছুটি নিয়েছি।
তাঁকে বললাম, বসকে অনুরোধ করে ছুটি নাও। তিনি কাপড় কাচা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ছুটি নিয়ে কি হবে ভাই বলুন? এখানে মা নেই যে তাঁর হাতের রান্না টেবিলে থাকবে। বাবা নেই যে সুরমা হাতে বসে থাকবেন। ছোট বোন নেই যে ঈদ সালামির জন্য পিছে পিছে ঘুরবে। সে ঘরে কীসের ঈদ। আমি রুমে থাকলে কষ্টে বুক ফেটে যাবে, নিজের কান্না রুখতে পারব না। বরং প্রতিদিনের মতো কাজে যাব। মনে করব আমার প্রবাসজীবনে ঈদ বলতে কিছু নেই। যেখানে আপনজন নেই সেখানে ঈদ নেই, থাকতে পারে না। হয়তো পরিবার পরিজন ছাড়া কিছুটা সময়ের জন্য সুখী হওয়ার মিথ্যে অভিনয় করতে হবে।
আমি আর কিছু বললাম না। কারণ এটাই তার প্রবাসে প্রথম ঈদ। তাই তার আবেগটা একটু বেশি। আমরা যারা অনেক বছর ধরে প্রবাসে আছি তারা আপনজনরা ছাড়া ঈদ উৎসব উদ্‌যাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমাদের আবেগ অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। তাই এখন আর আগের মতো কষ্ট হয় না। ঈদের দিন আমরা ঈদের নামাজ আদায় করে আপনজনদের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেই আমাদের ঈদ উৎসব শেষ করে দিই। এবারও হয়তো তাই হবে, তাই ঈদ নিয়ে আমাদের প্রবাসীদের কোনো পরিকল্পনা নেই। তবুও আমরা ভালো আছি, আমাদের ভালো থাকতে হয়।

এম ওমর ফারুকী শিপন: সিঙ্গাপুরপ্রবাসী।