অনুভূতিতে শুধু তুমি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

অন্ধকার রুমে জানালার ফাঁকে মায়াভরা তারাদের দিকে তাকিয়ে আনমনে মাঝরাতে এলোমেলো ভাবনাগুলো দূর আকাশে মিলিয়ে দিতে ব্যস্ত মেঘলা। এমন সময় ফেসবুকে নতুন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের নোটিফিকেশনে ঘোর কাটল তাঁর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভুল করে অ্যাকসেপ্ট করে ফেলেছে অপরিচিত এই অতিথিকে। যা তাঁর নিয়মতান্ত্রিক জীবনের বিরোধী। কোনো অপরিচিত ফ্রেন্ড নেই তাঁর। হঠাৎ করে সে দেখল এই অপরিচিত অতিথির কভার পিকচারে তাঁর কাছের একজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির উপস্থিতি। একটু স্থির হয়ে মেঘলা সরাসরি সেই ব্যক্তিকে জানাল অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি।

তিনি মেঘলাকে বললেন, আমিই তাঁকে তোমার সঙ্গে কন্টাক্ট করতে বলেছি। উনি আমার সুপরিচিত। আমি চাই তুমি তাঁর সঙ্গে পরিচিত হও। তাঁকে নিয়ে তোমার সঙ্গে পজেটিভলি ফ্যামিলিয়ার কিছু চিন্তা করছি আমরা। সুতরাং বুঝতেই পারছ?
—হুম। সব শোনার পর মেঘলা ভেবে চলেছে কী করা যায় এখন? এখন কী হবে...জীবনের প্রথমবার এমন হতে চলেছে...অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ কেন এমন হয় … কেমন বিড়ম্বনা।
মেসেজ ইনবক্সে অপরিচিত সেই অতিথির পাঠানো মেসেজের নীলাভ আলোতে ভাবনাগুলোর রেশ কাটল তার। তাকিয়ে দেখল।
—আমি হৃদয়, সরি আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য...।
—নো প্রবলেম, ইটস ওকে।
অল্প আলাপচারিতায় শেষ হলো আধুনিক যুগের প্রথম পত্রকথন। ক্লান্ত মেঘলা ঘুমিয়ে পড়ল।
চোখে আজ ধূসর রঙের স্বপ্নে রংধনুর আবির্ভাব। সময়ের কাজ নিরন্তর বয়ে চলা। সঙ্গে হাজারো স্মৃতিকথা। অনেকটা অধিকার দেখিয়ে হৃদয় সেদিন বলেই ফেলল, মেঘলা, তুমি কি কিছু বোঝো না?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

—না। বেশ দৃঢ় কণ্ঠে বলল মেঘলা। আমি কিছু বুঝি না। আর বুঝতেও চাই না। আমি শুধু জানি বাবা যা বলবেন তাই...।
—ওকে, বাবাতো বরাবরই পজেটিভ। কিন্তু তোমার অনুভূতি আমার কাছে মুখ্য। বিয়েটা কি তোমার মনের বিরুদ্ধে হচ্ছে কি না আমি জানতে চাই।
—আমি শিশু না।
—উ, তোমার সঙ্গে কথায় আমি পারব না।
—আচ্ছা।
—তুমি এমন করলে এই সাত সমুদ্র পারি দেওয়ার আকুতি অর্থহীন।
—হুম।
—হুম কি? আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই?
—বলেন...।
—এখন একদম চুপ থাকবে কথা শেষ হলে কথা বলবে। ঠিক আছে?
—হুম।
মেঘলা চুপ করতেই কানে ভেসে এল ‘ফর দ্য রেস্ট অব মাই লাইফ’ গানটির লিরিক। মেঘলা চোখ বন্ধ করে শুনছে।
ইতিমধ্যে কেটে যায় আরও বেশ কিছু সময়। সময়ের স্রোতে আজ হৃদয় এসেছে মেঘলার বাসায়। ঘরভর্তি মানুষজন। এতগুলো মানুষের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এই মেয়ে দেখার আসরে হৃদয় জীবনে প্রথম দেখল মেঘলাকে। হলুদ আর লাল রঙের ড্রেসে অসাধারণ লাগছে মেঘলাকে। মেঘলার লাল ঘোমটার ফাঁকে চোখে একবার চোখ মেলাতে চায় হৃদয়। আর ওদিকে মেঘলা শিশুর মতো বড় আপুর হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে। কেন জানি আজ সবকিছুতেই তীব্র ভয় কাজ করছে তাঁর। জীবনে প্রথমবার পাত্র পক্ষের সামনে বসেছে সে। কেমন এক বর্ণনাহীন অনুভূতি। ভয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে সংশয়। হৃদয়দের কী তাঁকে পছন্দ হয়েছে। আরও সবকিছুকে ছাপিয়ে দুজনের আই কন্টাক্ট হলো এবার। দুজনের নির্বাক দৃষ্টি বিনিময়। অতঃপর পরিবারের অনুমতিতে তিন মিনিটের একক আলাপনে হৃদয়ের অস্পষ্ট বাক্য বিনিময় আর মেঘলার চঞ্চল দৃষ্টিতেই শেষ হলো সেই পড়ন্ত বিকেলবেলা।

লেখিকা
লেখিকা

বিধাতার ইশারায় আজ বর বেশে হৃদয় বাসর ঘরে। হৃদয়ের মনে হাজার রকম প্রশ্ন। মেঘলার নীরবতার মাঝে কী আছে জানার চেষ্টায় ব্যাকুল সে।
মেঘলার কাছে যেতেই মেঘলা বলল, প্লিজ, একটু দূরে বসেন।
উৎসুক দৃষ্টিতে হৃদয় বলল, মানে! আজ আমাদের বাসর রাত আর তুমি এখন এমন বলছ কেন?
—আমার কিছু বলার আছে আপনাকে।
—বল আমি তো সব সময়ে চেষ্টা করেছি জানতে। কিন্তু পারিনি...।
মেঘলা নিশ্চুপভাবে একটি ডায়েরি দিল হৃদয়ের দিকে বাড়িয়ে।
হৃদয় হাতে নিয়ে বলল, এটা কি?
—আমার অনুভূতি...আপনি প্রথমে পড়েন তারপর আমার সঙ্গে কথা বলেন।
হৃদয় স্তব্ধ হয়ে গেল। মেলাতে পারছে না জীবনের সমীকরণ। কী ঘটতে চলেছে তার জীবনে। নববধূর এমন আচরণে সে হতবাক। অতঃপর সাহস নিয়ে ডায়েরি খুলল সে। ডায়েরির প্রথম পাতায় তাকাতেই সে বিস্মিত হলো। সুন্দর আলপনা ও ছবি আর রংবেরঙের কালিতে লেখা অন্তরের বিশুদ্ধ অনুভূতি। হৃদয় পড়ে চলেছে আর ভাবছে মানুষ মানুষকে এতটাই ভালোবাসতে পারে কীভাবে? আর সে ভালোবাসার মানুষ কে না জানিয়েই। গোটা লেখাটাই ফুটে উঠেছে মেঘলার না বলা সকল অনুভূতি আর সময়ের আকুতি।
ডায়েরির শেষ পাতা পড়ে চোখ বন্ধ করে হৃদয় বলল, মেঘলা এত ভালোবাস অথচ ভালোবাসার মানুষটিকে বুঝতেই দিলে না?
—হুম।
—কেন এমন করলে? নিজেকে খুব নগণ্য মনে হচ্ছে।
—এভাবে বললে আমি কষ্ট পাচ্ছি।
—সরি।
হৃদয় হাতটা বাড়িয়ে মেঘলার হাত ধরে ডায়েরির শেষ পাতা খুলে বলল, জানতে চাই সেই অবুঝ স্বপ্নকুমার এখন তোমার হাত ধরায় কেমন লাগছে?
—আলহামদুলিল্লাহ...।
হৃদয় মেঘলাকে বুকে টেনে নিল আর দুজনের দৃষ্টি নিবন্ধিত হলো—‘অনুভূতিতে শুধু তুমি’ শিরোনামে লেখা ডায়েরিটির ওপর।
‘নীরব আর পবিত্র ভালোবাসার অনুভূতি সর্বদাই অনেক শক্তিশালী...এর মাঝেই বেঁচে থাকুক ভালোবাসার অটুট বন্ধনে গড়ে ওঠা চিরস্থায়ী পবিত্র সম্পর্কগুলো।’
— — —

মোছা. নাজিরা আক্তার রিতু: গবেষক, টোকিও ইউনিভার্সিটি অব মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, মিনাতো, টোকিও, জাপান।