আমার সাধ না মিটিল, আশা না ফুরিল

‘আমি জিতে গেলে জিতে যায় মা।’ এই কথাটা তো দেশের জন্যও প্রযোজ্য। আমরা সবাই এগোলেই তবেই দেশটা এগিয়ে যাবে।
‘আমি জিতে গেলে জিতে যায় মা।’ এই কথাটা তো দেশের জন্যও প্রযোজ্য। আমরা সবাই এগোলেই তবেই দেশটা এগিয়ে যাবে।

স্কুল-কলেজে পড়ার সময় বইয়ে লেখা থাকত বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। সেই আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে পড়ি আকাশ (এম এম আকাশ) স্যারের ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি’ কোর্স করার সময়ে জানতে পারি বাংলাদেশ একটি স্বল্পোন্নত দেশ।

অর্থনীতি পড়ার সময় বাংলাদেশের চেয়ে ইউরোপ-আমেরিকার অর্থনীতি নিয়েই বেশি জেনেছি। এর কারণ সম্ভবত পৃথিবীর সব বাঘ-সিংহ সমমান অর্থনীতিবিদেরা ইউরোপ-আমেরিকাতেই জন্মেছেন...জন্মাচ্ছেন। মনে আছে ড. আশিকুজ্জামান স্যার বলেছিলেন ডাক্তারি পড়লেই ডাক্তার হওয়া যায়, কিন্তু অর্থনীতি পড়লেই সবাই অর্থনীতিবিদ হতে পারে না। তাই হয়তো আমিও পারিনি অর্থনীতিবিদ হতে। তবে সেসব কথা থাক, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?
আগের প্রসঙ্গে আসি, উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত অথবা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ কি?
কোন দেশ কতটা ধনী বা গরিব, সেটাকে বিশ্বব্যাংক নিজের মতো বিবেচনা করে। মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় দিয়ে বিবেচনা করা বিশ্বব্যাংকের ভাগগুলো এক হিসাবে তিনটি, আরেক হিসাবে চারটি। তিনটি ভাগ এ রকম—নিম্ন আয়, মধ্যম আয় ও উচ্চ আয়ের দেশ। মধ্যম আয় আবার দুই রকম—নিম্নমধ্যম আয় ও উচ্চমধ্যম আয়। সে হিসাবে বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের মধ্যে আছে।
বাংলাদেশ যে নিম্ন আয় থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে, সে ঘোষণা বিশ্বব্যাংক দিয়েছে ২০১৫ সালের ১ জুলাই। যেসব দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৫ ডলার বা তার নিচে, বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় সেগুলোই হচ্ছে নিম্ন আয়ের দেশ। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৫ সালের ১ জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ ছিল। নিম্ন আয়ের দেশকে সহজ বাংলায় বাঙালিরা গরিব দেশ বা দরিদ্র দেশ বলে আসছে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার পর্যন্ত সবাই মধ্যম আয়ের দেশ। এর মধ্যে আয় ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে ৪ হাজার ১২৫ পর্যন্ত হলে তা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ, আর ৪ হাজার ১২৬ থেকে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার পর্যন্ত হলে সেটি উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ। মাথাপিছু জাতীয় আয় এর চেয়ে বেশি হলেই হবে উচ্চ আয়ের দেশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ ডলার।
উন্নয়নকে টেকসই করতে মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি সামাজিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সূচক তৈরি করে থাকে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। তারই ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশ—তিন শ্রেণিতে ভাগ করে সিডিপি। ১৯৭৫ সাল থেকে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকায় ছিল বাংলাদেশ। হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ির দেশটিই এখন এশিয়ার রোল মডেল, উন্নয়নের বিস্ময়। জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে দেখানো বাংলাদেশের প্রোফাইল অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় ওঠার যোগ্যতা গত মার্চ মাসে অর্জন করেছে আমাদের এই দেশ। তবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক উত্তরণ ঘটবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচক (ইভিআই)—এই তিন শর্ত পূরণ করতে হয়, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পূরণ হয়েছে।
সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৪ সাল থেকে বাংলাদেশ হবে নিম্নমধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশ। বাংলাদেশ ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলেও ২০২৭ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ উদ্যোগের আওতায় পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে।
তবে কি জিডিপি সবকিছুর মাপকাঠি? এই যে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা, নারী নির্যাতন, শিশু নিগ্রহ, সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে দিনের পর দিন এগুলো কি নির্দেশ করে? বাংলাদেশে অপরাধীরা অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়। তার একটি বড় কারণ হলো বাংলাদেশের শিক্ষিত শ্রেণির সৎ সাহসের অভাব। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সবাই নিজের ব্যাগ গুছাতে ব্যস্ত। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে সচেতন নয়। নৈতিকতার কথা বাদ দিলাম। গত কয়েক বছরে শিক্ষা ব্যবস্থার যে বেহাল দশা হয়েছে, তার পরিণাম যে কত ভয়াবহ হতে পারে তা বাংলাদেশ আর কয়েক বছর পরেই উপলব্ধি করতে পারবে। ব্যাংকিং সেক্টরে যে এত দুর্নীতি হচ্ছে সেগুলো নিয়ে কতজন সোচ্চার আছেন।
ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলেই দেখি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ—তাঁরা তো সবাই অতীত। বর্তমানে যারা রাজনীতি করছেন তাদের নাম কি ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে? ২০৫০ সালে যে স্কুলে পড়বে সে কি জানবে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী কে ছিলেন? স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত কোনো শক্তিশালী বিরোধী দল ছিল না। যে দল ক্ষমতায় আসে সেই দল সারা জীবন ক্ষমতায় থাকতে চায়। এমন দিন কবে আসবে যেদিন বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে দেশের জন্য কাজ করবেন। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, সংসদ হবে দেশের সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে আলোচনার জায়গা। বন্ধ হবে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য, প্রশ্ন ফাঁস, ইভ টিজিং। দরকার যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা-প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান নির্ভর।
ছোটবেলায় বিখ্যাত অভিনেতা হ‌ুমায়ূন ফরিদীর একটি সিনেমার ডায়ালগ ছিল—‘ভালো হয়ে যা, ভালো হতে পয়সা লাগে না।’ তবে জীবনের পদে পদে আমার উপলব্ধি হলো সত্যিকার অর্থে একজন সৎ ও দায়িত্বশীল মানুষ হওয়া খুব কঠিন একটি কাজ। সেটা যারা হাসিমুখে করতে পারবে তারাই পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেন।
ভিকারুননিসাতে এইচএসসির বিদায় অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম রোকেয়া আকতার বেগম বলেছিলেন—‘এই যে বাংলাদেশে এত সমস্যা তাও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, কারণ বাংলাদেশে এখনো ভালো মানুষ আছে।’
টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন হয়তো অনেকেই দেখে থাকবেন। যেখানে ছেলেটা বলে—‘আমি জিতে গেলে জিতে যায় মা।’ এই কথাটা তো দেশের জন্যও প্রযোজ্য। আমরা সবাই এগোলেই তবেই দেশটা এগিয়ে যাবে।

রাহনুমা সুলতানা: সিন মিসাতো, সাইতামা, জাপান।