ঠিকানা

.
.

আমাদের হলের বারান্দার সামনেই একটা কদমগাছ। বেশ কয়েক দিন হলো এ গাছে বাসা বেঁধেছে এক জোড়া কাক। দুটি ছানাও হয়েছে তাদের। প্রতিদিন সকালে নাশতা সেরে পত্রিকা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসি। তখন দেখি মা পাখিটা তার বাচ্চাদের কত আদরে খাওয়াচ্ছে। কাকের ছানা দুটো কেমন আমুদে গিলতে থাকে মায়ের ঠোঁটের খাবার। আমিও নস্টালজিক হয়ে যাই মাঝেমধ্যে। ঠিক এমন করেই মা আমকেও হাতে ধরে খাওয়াতেন ছোটবেলায়। মায়েরা এমনই হয়। সন্তানের চিন্তায় সারা দিন উদ্বিগ্ন থাকেন।
একবার খেতে গিয়ে মাছের কাঁটা আটকে গিয়েছিল আমার গলায়। মায়ের সে কী দুশ্চিন্তা! কাঁটা সরাতে লবণ দিয়ে গরম ভাতের দলা পাকিয়ে মা আমাকে খাইয়েছিলেন। এই স্মৃতিটাই আমার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে কাকের ছানাগুলো আর তাদের মায়ের হৃদ্যতা দেখলে। মাঝে মাঝে এদের দেখে আমার খুব ফিরে যেতে ইচ্ছে করে ফেলে আসা দিনে। তখন বাড়ি যাওয়ার জন্য মনটা কেমন আকুলিবিকুলি করে। কিন্তু পরীক্ষা, প্রেজেন্টেশন, রিপোর্ট ও টিউশনের আবর্তে আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। হয়তো মাঝেমধ্যে মাকে ফোন করে সেই সরল অথচ উৎসুক কণ্ঠটা শুনে নিই। লজ্জায় বলা হয় না, ‘মা, তোমাকে ভীষণ মিস করি।’কয়েক দিন আগে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে উপকূলীয় অঞ্চল। সেদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি সেই কাক আর তার ছানাগুলো ভয়ে ভীষণ জবুথবু হয়ে আছে। প্রচণ্ড বাতাস আর বৃষ্টিতে তাদের বাসাটা ভেঙে গেছে। মা কাকটা কা কা করে ডেকে চলেছে একটানা। এদের দেখে আমার ভীষণ মায়া হচ্ছিল। কিন্তু আমারও করার কিছু নেই। আমি মনে মনে কাকের ছানাগুলোকে আমার বারান্দায় ডাকতে থাকি। পরে ভাবলাম, আমি বারান্দা থেকে সরে গেলে হয়তো এরা আসতে পারে। কিন্তু ওরা কি উড়তে শিখেছে? কিছুক্ষণ পর দেখি মা কাকটা একটা ছানা পাশের কক্ষের জানালার পাশে নিয়ে রাখল। অন্য ছানাটা ততক্ষণে বুঝে গেছে তাকে কোথায় যেতে হবে। জীবনের দায়ে উড়তে গিয়ে বেচারা মাটিতে পড়ে গেল। মা পাখিটা তাকে ঘিরে চিৎকার করছে। কিছুক্ষণ পর ঝোপের আড়ালে, আমার দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেল পাখি দুটি। উপকূলের মানুষগুলোও সব সময় আমাদের দৃষ্টি সীমানার বাইরেই থাকে। একটা দুর্যোগ হলে তাদের যে কত দুর্ভোগ পোহাতে হয়, সে ভুক্তভোগী মাত্রই জানে। এই কাকদের মতো কত মানুষ যে গৃহহারা হয়, কত জীবন অকালেই শেষ হয়ে যায়, সে খবর কে রাখে!

মাকে ফোন করে খোঁজ করি, বাড়িঘর কেমন আছে? পাড়াপ্রতিবেশীর খবর জানতে চাই। মায়ের সেই সরল, ভেজা, উৎসুক কণ্ঠ ভেসে আসে। আমি নস্টালজিক হই, হৃদয় আর্দ্র হয় কিন্তু হাল ছাড়ি না। কাকেরা একদিন নিশ্চয় তাদের মাথা গোঁজার ঠিকানা খুঁজে পাবে!

নিদেল শরিফ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়