পরবাসে বাংলা গানের পাঠশালা

বাংলা স্কুল অব মিউজিকের অনুষ্ঠানের ফাইল ছবি
বাংলা স্কুল অব মিউজিকের অনুষ্ঠানের ফাইল ছবি

বাইশ বছর আগে মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডেট্রয়েট শহরে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় ‘বাংলা স্কুল অব মিউজিক’ নামের গানের স্কুলের যাত্রা শুরু। সময়ের আবর্তে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ এই স্কুল বাংলাদেশিদের কাছে এক জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। বাংলার সব উৎসব এখানে বেশ ঘটা করে পালিত হয়। প্রবাসে জন্ম ও বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি শিক্ষার প্রত্যয়ে এগিয়ে চলছে বাংলা গানের স্কুল।

বাংলা স্কুল সকলের স্কুল। সব বয়সের জন্য এ স্কুলের দরজা খোলা। প্রবাসে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশি আমেরিকানদের জন্য বাংলা শেখানো এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। সেই অবস্থানে থেকে বাংলা গান ও গানের সব বাদ্যযন্ত্র শেখানোর কঠিন কাজ করে যাচ্ছেন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রিন্সিপাল আকরাম হোসাইন। নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলা ভাষা ও শেখার ব্যাপক আগ্রহ তাঁকে এ স্কুল প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ জুগিয়েছে বলে জানালেন। বাংলা সংস্কৃতি বিকাশে এ কাজ তিনি করে যাচ্ছেন তার ব্যক্তিগত ভালোবাসার জায়গা থেকে।

বাংলা স্কুল অব মিউজিকের অনুষ্ঠানের ফাইল ছবি
বাংলা স্কুল অব মিউজিকের অনুষ্ঠানের ফাইল ছবি

রবীন্দ্র, নজরুল গীতি, লালনের গান, ভারতীয় ক্ল্যাসিক, আধুনিক বাংলা ও ভারতীয় বাংলা গানের ছন্দ, তাল-লয় ও অন্ত্যমিল এ স্কুলের প্রধান বিষয়। এ ছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশি বাচ্চাদের জন্য বাংলা অক্ষরের সঙ্গে পরিচয়, বাংলা ভাষা পড়া, লেখা ও সঠিকভাবে বাংলা বলতে পারার শিক্ষাও দেওয়া হয়। ছবি আঁকার মাধ্যমে গ্রাম বাংলার অপরূপ দৃশ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছে এ গানের স্কুল।
বাংলা টাউন খ্যাত হামট্রামাক শহরের উত্তর পার্শ্ব ও ডেট্রয়েট শহর সীমানা ঘেঁষে ডেভিসন ফ্রিওয়ের পাশে ছোট এক বাসায় এ স্কুল। স্কুল, বন্ধু ও টিভিসহ চারপাশে যেখানে ইংরেজি, তখন নিজের সন্তানকে শিকড়ে ধরে রাখতে ও বাংলা ভাষার আভিজাত্য বোঝাতে বাবা–মা অনেকটা জোর করেই সন্তানকে এ গানের স্কুলে দিচ্ছেন বলে জানালেন গান ও গিটারের শিক্ষক এথেনা আকরাম। বাদ্যযন্ত্রের মাঝে হারমোনিয়াম, তবলা, হাওয়াই গিটার, স্প্যানিশ গিটার, পিয়ানো ও কিবোর্ড শেখানো হয়।
প্রথমে বাচ্চাদের অনেকটা জোর করে স্কুলে নিতে হলেও অল্প দিনেই এ স্কুল হয়ে ওঠে বাচ্চাদের প্রিয় স্থান। নতুন সব বন্ধু, নাচে গানে বাংলা শেখা ও নিজেকে জানা ও বাংলা ভাষার মধুরতা সবকিছু মিলে এ স্কুলে তারা ভালোবাসার বন্ধনে বাঁধা পড়ে।

বাংলা স্কুল অব মিউজিকের অনুষ্ঠানের ফাইল ছবি
বাংলা স্কুল অব মিউজিকের অনুষ্ঠানের ফাইল ছবি

১৯৯৬ সালে বাংলা গানের স্কুলের যাত্রা শুরু। আকরাম হোসাইনের হাত ধরে এ স্কুলের পথ চলা। তিনি শুরু থেকেই প্রতি বছর বেশ কিছু অনুষ্ঠান করে থাকেন। প্রতি সপ্তাহের শনি ও রোববারে প্লে হাউসে (ভবনের নাম) মিলিত হয় সকল সকল শিক্ষার্থীরা। গানের স্কুলে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা উৎসব, ভালোবাসা ও বসন্ত উৎসব, মার্চে স্বাধীনতা উৎসব, এপ্রিলে বৈশাখ। এ ছাড়া প্রতি মাসেই কোনো না কোনো উৎসবে গানের আয়োজন। বাংলাদেশ থেকে বড় কোনো শিল্পী এলে আকরাম হোসাইনের আতিথেয়তা ছাড়া মিশিগান ছেড়েছেন এমনটি এখনো হয়নি। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা থেকে এ যুগের বিউটি দাস সকলেই তাঁর অতিথি। গানের স্কুলের হয়ে মিশিগানে গান করেছেন প্রথিতযশা সব শিল্পীরা। ফরিদ রহমান, তাজুল ইমাম, তপন মদক, ক্বাদরী কিবরিয়া, সৌমেন অধিকারী, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, রথীন্দ্রনাথ রায়, দুলাল ভৌমিক, ফেরদৌস আরা ও রামা মণ্ডলসহ অনেকে।
গান ও বাদ্যযন্ত্রের শিক্ষক হিসেবে এ গানের স্কুলে রয়েছেন আকরাম হোসাইন নিজেই। রয়েছেন তার মেয়ে এথেনা আকরামসহ শাম্মি আক্তার, নাজমুল আনোয়ার, লিজা, আক্তারুজ্জামান ও আইরিন সুলতানা অ্যানি। গানের স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য রয়েছে শক্তিশালী এক কমিটি। আকরাম হোসাইনের নেতৃত্বে এ কমিটিতে রয়েছেন নাজমুল আনোয়ার, এথেনা আকরাম, জি এম আলী হায়দার, আহমাদুল হাসান রুশো, চিনু মৃধা, লিজা, উত্তম বড়ুয়া, শাম্মি আক্তার, সঞ্জিব রায় চৌধুরী ও সুব্রত মোহন্ত।
৪৫ বছর ধরে গান ও গানের সব বাদ্যের সঙ্গে আকরাম হোসাইনের সখ্য। ১৯৯২ সালে সহধর্মিণী ও মেয়েসহ যুক্তরাষ্ট্রে ছয় মাসের জন্য বেড়াতে আসেন। সে সময় তার সহধর্মিণী মিশিগানে ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট হিসেবে চাকরি পেয়ে যান। আমেরিকায় আসার আগে আকরাম হোসাইন দেশে বাংলাদেশ বেতারে সংগীতশিল্পী, কম্পোজার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন। বাদ্যযন্ত্রে দখল তার ছোটকাল থেকে। ১৭ বছর বয়েসে পাকিস্তানে জাতীয় সংগীত প্রতিযোগিতায় গিটারে স্বর্ণপদক জেতেন। সংগীত জগতের হাতেখড়ি পেয়েছেন সাধন সরকার, বিনয় রায় ও আজিজ খানের মতো ওস্তাদের সান্নিধ্য।
১৯৯৭ সালে আকরাম হোসাইন হার্ট অ্যাটাক হয়। এতে তিনি প্যারালাইসিস আক্রান্ত হন। মাসখানিক শয্যাশায়ী ছিলেন। তবে তিনি বাংলা স্কুলের হাল ছাড়েননি। পাওয়ার হাউস প্রডাকশনে অবাঙালিদের সঙ্গে কাজ করেন। বাংলাকে উপস্থাপনে সর্বদা বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়েছেন। থিয়েটার গ্রুপ হিন্টারল্যান্ডের সঙ্গে মিলনায়তন শেয়ার করেন। এতে তার গানের স্কুলের শিক্ষার্থীরা বড় পরিসরে পারফর্ম করার সুযোগ পায়। রাজ্যের যেকোনো স্থান থেকে ডাক এলেই তিনি তার স্কুলের শিক্ষার্থীদের উপস্থাপন করেন, তৈরি করেন অনুষ্ঠানের জন্য।

বাংলা স্কুল অব মিউজিকের অনুষ্ঠানের ফাইল ছবি
বাংলা স্কুল অব মিউজিকের অনুষ্ঠানের ফাইল ছবি

স্কুলের শিক্ষার্থীরা মূলত প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশি হলেও তারা বাংলা গানে আগ্রহ প্রকাশ করছে। বাংলা গান শিখতে, গানের সঙ্গে গলা মেলাতে গানের স্কুল থেকে ২০১৫ সালে একটি বই প্রকাশ করা হয়েছে। ‘চন্দ্রতরু’ নামে বাংলা গান ও কবিতার এ বই প্রকাশিত হয় ড. মোহাম্মদ নাজমুল আনোয়ারের সম্পাদনায়। পাওয়ার হাউস প্রডাকশনের সহযোগিতায় এ বই ইংরেজি ফোনেটিক উচ্চারণ ও অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এটি বাংলাদেশি আমেরিকান নতুন প্রজন্ম ও অবাঙালিদের সহজবোধ করে তোলে। ২০১৫ সালে অলাভজনক এ গানের স্কুল ফাউন্ডেশন থেকে অনুদান লাভ করে, যা গানের স্কুলের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়।
বাংলা গানের স্কুলের দ্বিতীয় প্রকাশনা ‘গীতিমালা’ বাজারে এসেছে। বাংলা ও ইংরেজি ফোনেটিক উচ্চারণ ও অনুবাদে গানের এ বইও সম্পাদনা করেছেন ড. মোহাম্মদ নাজমুল আনোয়ার। আকরাম হোসাইন ছিলেন সর্বাত্মক সহযোগিতায়। তার শিল্পী জীবনের সাফল্যের ওপর একটি নিবন্ধ আছে এই বইতে। মিথুন চক্রবর্তী ও অভ্র চট্টোপাধ্যায়ের বেশ কিছু কবিতার চমৎকার অনুবাদ করেছেন। লিজা বিল্বি ও জিনা রাইকার্ট ছিলেন এর প্রকাশনের সহযোগিতায়। বাংলা ও ইংরেজি ফোনেটিক উচ্চারণের পাশাপাশি বইয়ের ফ্রন্ট সাইজ নির্বাচনে আনা হয়েছে ভিন্নতা। অনুষ্ঠানে গান পরিবেশনে এ বই রেফারেন্স হিসেবে কাজে আসবে। বাংলা স্কুলের সকলের বিশ্বাস এ বই নতুন প্রজন্মকে সহজ ভাষায় গান শেখায় উৎসাহ জোগাবে। বাংলা গান ও ভাষাকে অন্য ভাষাভাষির কাছে গর্বের সঙ্গে তুলে ধরতে এ জ্ঞানের স্কুল অনন্য।

সাইফুল আজম সিদ্দিকী: মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র।