প্রবাসে আমাদের ঈদ

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

চাঁদের আলো হঠাৎ করেই ঘরের আঙিনায়। আমাদের ভাসাল খুশির আমেজে। শিশুরা হাসছে। হাসছে ভাবি আর চাঁনরাতের খবর তো আমি আগেই জেনে গেছি। তাই নেটে খুঁজছি মেহেদির ডিজাইন। সাজগোজের প্র্যাকটিসও শুরু করে দিয়েছি। চারপাশের সবুজ লতাগুল্ম, ম্যাপল আর ফুলের দলও যেন হেসেই লুটোপুটি। চাঁদের হাসিতে হাসছে সবাই। আমি, পিংকি, ফারিয়া, মৌ, অতসী। প্রতিবেশী চাচা–চাচিরাও খুশিতে মশগুল। বাড়ির উঠোন জুড়ে শুরু হয়েছে উৎসব আসর। শিশুরা হইচই আর কোলাহলে মেতেছে। কাল ঈদ।

এক মাস সিয়াম সাধনার পর ভালোবাসা, সৌহার্দ্য আর ত্যাগের মহিমায় বেশ আড়ম্বর আর আনুষ্ঠানিকতায় আমরা প্রবাসীরা অনেকটা দেশীয় আমেজে ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপন করেছি। জোছনার পথ ধরে ধরে অনেকটা দূর গিয়ে মেহেদিতে রাঙিয়েছি হাত–পা আর মন। এখানেও বিউটি সেলুনগুলোতে ঈদ লগনে উপচে ভরা ভিড়। যার যার মতো লুক আনতে অনেকেই বেছে নিয়েছেন পছন্দমতো হেয়ার স্টাইল। রূপে অধিক লাবণ্য আনতে ব্যস্ত সবাই। আমাদের পাশের বাড়ির দাদিজানও সাদা চুল পারলারে গিয়ে রং করে এসেছেন। উৎসব মনে রং ছড়ায়। সেই রং ছড়িয়ে পড়ে অন্তরে অন্তরে।
দেশ থেকে এসেছেন ভাই–ভাবি। আমি পেয়েছি দুটো আড়ং–এর জামা, সঙ্গে লাল, নীল সবুজ নানান রঙ্গের চুড়ি, নকশি করা হ্যান্ডব্যাগ আরও নানান উপহার সামগ্রী। মন কেড়েছে রূপকথার রাজকন্যার গল্পকথায় নান্দনিক শৈলীতে ভরপুর নকশিকাঁথাগুলো।
সারা রাত জেগে আমরা মেয়েরা রান্না আর ঘর গোছানোতেই ব্যস্ত ছিলাম। হরেক রকম মজাদার আইটেমের পাশাপাশি আমার বানানো হাতের সেমাই, অতিথিদের মন কেড়েছে। আমাদের গ্রামে এটা দুধচুরি নামেই পরিচিত। বাড়ির নতুন বউরা প্রথমেই শাশুড়ির কাছে শিখে নেন দুধচুরি বানানো। সুদূর নিউইয়র্কেও আমরা এর স্বাদ উপভোগ করি। আমি আরও বানিয়েছি নকশি করা পাকন পিঠা। আমার ভাবি মনকাড়া সব আইটেমের সঙ্গে বানিয়েছেন তাজ কাবাব। ঈদে দুধ সেমাই আমার ভীষণ প্রিয়। অবশ্যই মায়ের হাতের। আমার কাছে দুধ সেমাই এখন মায়াহীন মনে হয়। সেমাই পড়ে আছে। পড়ে আছে কোলাহল। মাটির ব্যাংকে টাকা–আনা–পয়সা। আমাদের ঘর আছে। আমাদের বাজেট আছে। শুধু মা–বাবা বেঁচে নেই। তাই ঈদের খুশি হঠাৎ হঠাৎ ই ম্লান হয়ে যায়।
ঈদের দিন প্রায় ৫০–৬০ জন অতিথি আমাদের বাড়িতে এসেছেন। রঙে রঙে, কুসুমে কুসুমে ভরেছে ঘর। নানান রঙের বাহারি পোশাক, সাজসজ্জা। সঙ্গে শাহি বিরিয়ানির মাতাল গন্ধ। ঈদি বিতরণে ব্যস্ত কেউ কেউ। ছোটরা সালাম করছে বড়দের। যেন আনন্দ আর খুশিগুলো স্বর্গ থেকেই ঝরে পড়ছে। হঠাৎ মনে গেল বেলি, টুনি, পুষ্প, সুমন এই সব শিশুদের কথা। জীবনের কষ্টগুলো যাদের হাসিমুখ ম্লান করে দেয়। এই ঈদে তারা কতটুকু খুশি হতে পেরেছে? ঈদে ওদের মুখে হাসি ফোটানোর কাজে কিছুটা অংশগ্রহণ করেছি মাত্র। বারবার মনে পড়েছে, বয়সের ভারে যারা অসুস্থ, অসহায় তারা ঈদে নতুন পোশাক আর ভালো খাবার পেয়েছেন তো? আনন্দ আর সুখটুকু মানুষে মানুষে ভাগাভাগির মধ্য দিয়েই ঈদটুকু পূর্ণতা পায়।
ঈদের সন্ধ্যায় খালার বাসায় দাওয়াত ছিল। প্রচুর মেহমান এসেছেন। এসেছেন মুরুব্বি পরিজন। ভীষণ উৎসবমুখর পরিবেশ। বাগানে ফুটেছে আজ যত ফুল। শস্য পাতার দল তার সবটুকু সুবাসই ছড়িয়ে যাচ্ছে হৃদয় থেকে হৃদয়ে। আজ ভালোবাসা বিলিয়ে দেওয়ার শ্রেষ্ঠ দিন। আনন্দ ও হইচই–এর পাশাপাশি আমাদের স্নেহময়ী দেশ মা, ছোটবেলার ঈদ, যারা কাছে নেই তাদের কথাও উঠে এসেছে বারবার। যত দূরেই থাকি প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি হৃৎপিণ্ডের পুরোটা অংশ জুড়েই জড়িয়ে থাকে ভালোবাসায়।
ধীরে ধীরে অনেকটা সময় গড়িয়ে যায়। একরাশ আনন্দ আর আলোর মতো ঝলমলে হাস্যভরা মন নিয়ে ফিরে আসি আপন ঘরে। উৎসবের রেশটুকু থেকে যাবে অনেকগুলো দিন। রাত গভীর হয়, ভোর এগিয়ে আসে। জানালা দিয়ে হঠাৎ দেখি পুবের আকাশে নতুন সূর্যোদয়।