প্রবাসে ঈদ, স্মৃতিতে ঈদ

প্রবাসে ঈদের দিন একসঙ্গে বাজার ও রান্না করে খোলা আকাশের নিচে সবাই মিলে আড্ডা, খাওয়া
প্রবাসে ঈদের দিন একসঙ্গে বাজার ও রান্না করে খোলা আকাশের নিচে সবাই মিলে আড্ডা, খাওয়া

ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদ মানেই খুশি। একটা সময় ছিল যখন সারা বছর ধরে অপেক্ষা করা হতো কখন ঈদ-উৎসব আসবে। এখন আর সেভাবে অপেক্ষা করা হয় না। আগের অপেক্ষায় আনন্দ ছিল। এখন শুধুই বিষাদে ভরা।

ঈদকে ঘিরে কত পরিকল্পনা! বিশেষ করে আমরা যারা ঢাকা থেকে বা বাইরে থেকে গ্রামে ঈদ করতে যেতাম।
ঈদের শপিং যেন শেষ হয়েও হইল না শেষ! যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক হলে সময় যেন আর কাটতেই চায় না। অবশেষে সেই দিন...ভোর রাতে আধো আলো আধো অন্ধকারে গাড়ির কাচ হালকা খুলে গায়ে মিষ্টি বাতাস মাখিয়ে, এলোমেলো চুলে অনেক দিন পর সূর্যোদয় দেখতে দেখতে ছুটে চলা প্রিয় পরিবারের কাছে। সকাল না হতেই মা-বাবার ফোনে অতিষ্ঠ...একটু পরপর কোথায় আছিস, কতক্ষণ লাগবে...?
ভাগ্য ভালো হলে, ঘুম ধরা চোখে চেনা ঘ্রাণে, চোখ খুলে প্রিয় গ্রামকে আবিষ্কার করা! মন্দ ভাগ্যে সারা দিন জ্যাম আর গরম সঙ্গী। ক্লান্তি যতই থাকুক যেই মাত্র গ্রামের ছায়াটুকু চোখে পড়ে, অমনি সকল ক্লান্তি আর তিক্ততা এক নিমেষে উধাও!
সব থেকে ভালো লাগত যখন আসার খবর শুনে বাড়ি শুদ্ধ লোক রাস্তায় চলে আসে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য! অবশেষে বাড়ির সকলের খোঁজ খবর নিয়ে তবেই ঘরে পা রাখা। মায়ের রান্না করা খাবারের বিশেষ গন্ধে ভালো করে ফ্রেশ না হয়েই খেতে বসা।
ঈদের আগের দিন রাতে বাধ্যতামূলক ডিউটি বাচ্চাদের মেহেদি পরানো। ঈদের দিন প্রথম কাজ বাবা-ভাইকে ডেকে ডেকে ঘুম থেকে তুলে, নতুন বেড কভার লাগানো আর বাচ্চাদের গোসল হলে সাজিয়ে ঈদগাহে পাঠানো। সেদিন বাসায় অলিখিত ফিক্সড মেন্যু হলো টমেটো দিয়ে ছোট মাছ, আম-জলপাই দিয়ে মাছের টক আর শুঁটকির ভর্তা। ঈদের দিন এই খাবারগুলো সত্যি অন্যরকম মজা লাগত। এটা যেন ঈদ আনন্দের একটা অংশ। জার্মানিতে এসেও আমি এই মেন্যু দিয়েই ঈদ শুরু করি। তারপর রান্না শেষে বন্ধুবান্ধব ছাড়াও বাড়ির লোকদের ডেকে খাওয়ানো, আড্ডা আরও কত কী।

লেখিকা
লেখিকা

তবে ছোটবেলার ঈদগুলো আরও আনন্দময় ছিল। বিশেষ করে ঈদের জামা কিনে গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখা। কিন্তু অন্যদেরটা ঠিক দেখে নেওয়া। শহর থেকে আসা বড়দের বা দুলাভাইদের থেকে ঈদ সালামি জোর করে আদায় করা, একটু পরপর ড্রেস চেঞ্জ করা।
সেই দিনগুলো সত্যি হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষগুলো কেমন যেন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছেন!
জার্মানিতেও ঈদ উৎসব হয়...ব্যাপক রান্নাবান্না, আড্ডা, একসঙ্গে খাওয়া, ঘোরা...। সেই আড্ডার মাঝে হঠাৎ হয়তো কারও ফোন বেজে ওঠে বা ছোট্ট একটা মেসেজ দেখত। প্রাণবন্ত্ত মানুষটি হঠাৎ যেন আনমনা হয়ে যায়। সবার মাঝে থেকেও সে যেন ভীষণ একা, অভিনয়টা যেন আর চালিয়ে নেওয়া যায় না। দূরে গিয়ে কল করে সে যখন কথা বলে তখন প্রায় সবাই একবার তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে আর গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিয় মানুষগুলোর কথা ভেবে!
কথা শেষে আর্দ্র চোখ-মুখে সে যখন ফিরে আসে তখন জোর করে হাসিটা সবার চোখে লাগে, আড্ডাটা যেন আর জমে না।
তবে, প্রিয় স্বদেশ, প্রিয় মা-বাবা আর আপন পরিবারের সবাইকে ছেড়ে প্রবাসীদেরও আছে এক অনন্য পরিবার। যেখানে সবাই ব্যক্তিগত দুঃখ ভুলে একসঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন। একসঙ্গে বাজার করে ও রান্না করে খোলা আকাশের নিচে সবাই মিলে আড্ডা, খাওয়া।
একেকটা অলস ছেলে রান্নাবান্নায় কী পটু তা না দেখলে আর না খেলে বিশ্বাস হওয়ার নয়!
ঈদ সকল দুঃখ ভুলিয়ে আনন্দে ভাসিয়ে দিক সবার জীবন।
সবাইকে ঈদ মোবারক।

শারমিন আকতার: ইউনিভার্সিটি অব গিজেন, গিজেন, জার্মানি।