আমার বোকা বাবা

লেখিকার বাবা
লেখিকার বাবা

আমার যখন দুই বছর বয়স তখন জন্মের সময়ই আমার দ্বিতীয় ভাইটি মারা যায়। আব্বা হয়তো ভুলে গেছেন, কিন্তু খুবই অস্পষ্ট ও ঝাপসা হলেও আমার এটুকু মনে আছে, আব্বা আমাকে একলা ঘরে বুকে জড়িয়ে অনেক কেঁদেছিলেন। সে কান্না আর কেউ দেখেনি আমি ছাড়া। কিছু না বুঝে যা বুঝেছিলাম তা হলো, আব্বা কী অন্যায় করেছে যে এভাবে কাঁদছে। উঠানে সাদা কাপড়ের মধ্যে শুইয়ে রাখা ভাইটিকে দেখেছিলাম একনজর। স্পষ্ট কোনো চেহারা অবশ্য মনে করতে পারি না। আমি বড় অদ্ভুত প্রকৃতির। আর সে কারণেই হয়তো এ রকম বিশেষ বিশেষ অনেক স্মৃতি আমার মনে আছে।

আমার দুই বছরের বড় ভাইটাও জন্মের সময় মারা যায়। আর সেটা ছিল আমার মায়ের জীবনের এক বিভীষিকাময় অধ্যায়। আব্বা-মা কখনো ভুল করেও আমাদের সামনে বা পেছনে সে অধ্যায় কখনো উল্টায়নি। পরম যত্নে মনের গভীরেরও গভীরে কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন। আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, তাসলি খালা প্রথম সেই অধ্যায় আমার কাছে খুলে বসেন। আর আমি সেদিন প্রাণ উজাড় করে কেঁদেছিলাম আমার অদেখা বড় ভাইটির জন্য। এমন ঘোরতর অন্যায়ের জন্য মেজ আম্মা তাসলি খালাকে ভীষণ বকেছিলেন।
আমি জানি না, আব্বা-মা কীভাবে তাদের জীবনের এই মর্মান্তিক দুটো শোক ভুলে আমাদের তিন বোনকে পাখির মতো তাদের ডানার তলায় আগলে রেখেছেন। একটা মুহূর্তের জন্যও কোনো দিন বুঝতে দেননি তাদের আদর ভালোবাসার কমতি। তবু এই বোকা আমি কত দিন কত রাত লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছি একটা ভাই না থাকার জন্য। আশপাশে যখনই ভাই-বোনের বিবিধ ভালোবাসা দেখতাম, তখনই আমার অভিযোগ শুরু হতো আল্লার কাছে—আমাকে কেন দুইটা ভাই দিয়েও আল্লাহ নিয়ে নিল। এমনটা না হলে হয়তো এতটা কষ্ট আমার লাগতই না। অবশ্য আমার বাকি দুই বোনের মধ্যে কখনো এই দুঃখ বোধের ভাবলেশ দেখিনি। ওরা চিন্তাচেতনায় আমার চেয়ে অনেকাংশে উন্নত।
তবে হ্যাঁ, আমার আগে পরে কেউ না থাকার কারণে আব্বা-মার কাছে আমি ছিলাম যক্ষের ধনের মতো। তাদের একান্ত আলাপচারিতার প্রধান বিষয়বস্তু ছিলাম আমি। রাতে শোয়ার পর এবং ভোরে ঘুম ভাঙার পরে এই দুই সময়ই আব্বা-মা দীর্ঘক্ষণ গল্প করতেন। গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতাম আমি। আমি মাঝখানে শুয়ে আড়ি পেতে সব শুনতাম আর ভাবতাম আহা! এরা আমাকে কত ভালোবাসে। এটাও ঠিক, আমার এই স্বল্প পরিসর জীবনে আমার আব্বা-মায়ের মতন সুখী সফল দম্পতি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি।
আব্বা যখন ছয় ক্লাসে পড়তেন তখন আমার দাদা মারা যান। প্রচণ্ড অর্থ কষ্টে দাদিকে সঙ্গে নিয়ে নানাবিধ সংগ্রাম করে তিনি এসএসসি পাস করেন। এরপর পরই আব্বার চাকরি হয়ে যায়। দাদিকে সঙ্গে নিয়েই আব্বা তার কর্মজীবন শুরু করেন। এসবের কোনো কিছুই আব্বার মুখে শোনা নয়। সব শুনেছি রাতে দাদির কাছে শুয়ে। আমার দাদি ছিলেন একটা জীবন্ত বই। প্রতি রাতেই সেই বই থেকে একেকটা আশ্চর্যজনক অধ্যায় আমাকে শোনাতেন আর আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। একজন শ্রদ্ধাশীল শ্রোতা হিসেবে আমার অনুধাবন যা ছিল তা হলো, আব্বার প্রতি দাদির ছিল অসীম স্নেহ আর দাদির প্রতি আব্বার ছিল সীমাহীন ভালোবাসা।

বাবা-মার সঙ্গে সন্তানসহ লেখিকা
বাবা-মার সঙ্গে সন্তানসহ লেখিকা

আমার আব্বা অত্যন্ত সহজ ও বোকা প্রকৃতির একজন মানুষ। এই বোকা মানুষটাই তার সীমিত আয় জেনেও একদিন সাহস করে আমাদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে যান তার কর্মস্থলে। আর সেদিন থেকে বদলাতে থাকে আমাদের ভাগ্য। সংসারের খুঁটিনাটি টানাটানির মধ্যেও তার সাধ্য অনুযায়ী সব সময় চেষ্টা করেছেন আমাদেরকে সেরাটা দেওয়ার জন্য। এমনও হয়েছে বাজার থেকে কিছু আনতে বললে, আমার মন খারাপ করে দেওয়ার জন্য বলতেন, ওহো ভুলে গেছি আনতে। অমনি আমার মন খারাপ হয়ে যেত আর তৎক্ষণাৎ সেটা বের করে দিতেন। এটা ছিল আমার কাছে খুবই উপভোগ্য একটা বিষয়। আর আমরা পরিবারের সবাই মিলে যেটা উপভোগ করতাম তা হলো ঈদের আগে আব্বাকে জিজ্ঞেস করা হতো আব্বা আমাদের এবার ঈদে কী কিনে দেবেন। আব্বা খুব সাবলীলভাবে উত্তর দিতেন—একটা হাতি আর একটা ঘোড়া কিনে দেব। আমরা সবাই তখন একযোগে হাসা শুরু করে দিতাম এটা শুনে।
সে সময়, আমাদের একেকটা দিন ছিল একেক রঙের। যে রঙের ছটায় আশপাশের মানুষগুলোও রঙিন হওয়ার চেষ্টা করতেন। অথচ আমি নিজে দেখেছি, আব্বার অনেক কাছের মানুষও আব্বাকে বোকা বলে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছেন। সত্যি আমার আব্বা বোকা। বোকা বলেই ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত দেখে আসছি আমরা যেতে না পারলেও আব্বা ঠিকই কোরবানি দেওয়ার জন্য দূর দূরান্ত থেকে আমাদের তিন বোনের যেকোনো একজনকে নিয়ে ছুটে যেতেন তার বাস্তুভিটায়। এখন পর্যন্ত তার এই চল অব্যাহত আছে। তবে আব্বার একমাত্র সঙ্গী এখন নীপামণি।
এত গেল এক চরিত্র। খুবই বিব্রতকর একটা অভ্যাস আব্বার ছিল। আমার বোকা আব্বা আমার বন্ধু-বান্ধবী কেউ বাসায় এলেই জিজ্ঞাসা করতেন পরীক্ষায় কত নম্বর পেয়েছ। এই ভয়ে অনেকে আমাদের বাসাতেই আসতে চাইত না। বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে আব্বার বোকামির কারণে মাঝে মাঝেই আমি-আমরা সকলেই আব্বাকে অনেক বকাবকি অতীতে করেছি এমনকি এখনো করি। আব্বা তুমি এটাও যেন, তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি বলেই রাগ করি। যদিও আব্বা কখনোই আমাদের এসব রাগের ধার ধারতেন না। তিনি তার অকাট্য যুক্তিতে অটল থাকতেন এবং এখনো থাকেন। যার ফলে আমরা অধিক রেগে যেতাম এবং ভবিষ্যতেও রাগ দেখাতেই থাকব। আমরা জেনে গেছি এটা একটা ল লাইফ প্রসেস। এ নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে আব্বার বা আব্বার বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই।
তবে আজ একটা কথা অবনত মস্তকে স্বীকার করতে চাই। আব্বা তুমি বোকা বলেই আমাদেরকে মেয়ে মনে করে নয়, ছেলে হিসেবে মানুষ করেছ। মাথা উঁচু করে একা পথ চলতে শিখিয়েছ। শুধু কী তাই, বোকা বলেই তো নিজের বসতভিটা নিজের ভাইয়ের সন্তানদের লিখে দিতে এতটুকু কার্পণ্য বোধ করোনি। তাই আমরা আমাদের বোকা আব্বাকে নিয়েই গর্বিত। এমন বোকা আব্বা যেন ঘরে ঘরে থাকে। ভালো কথা, আব্বা তুমি কি জান গতকাল ছিল বাবা দিবস। এই সব দিবস-টিবস নিছক একটা দিন মাত্র। আব্বাকে ভালোবাসার জন্য কোনো দিবস লাগে নাকি। তবু বাবা দিবসকে উপলক্ষ করেই তোমাকে বলতে চাই, আমরা তিন বোন তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি আব্বা। আরেকটা কথা, তুমি ও মা তোমরা দুজনেই ভালো থেকো, সেই সঙ্গে আমাদের জন্য দোয়া কোরো কেমন।

লাভলী ইয়াসমীন: গজফোর্ড, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া।