আব্বার কাঁধ

কাঁধে মেয়ে ও কোলে ছেলেকে নিয়ে লেখক
কাঁধে মেয়ে ও কোলে ছেলেকে নিয়ে লেখক

খড়ের চাল। একটু বৃষ্টি হলেই সারা ঘরে বৃষ্টির পানি পড়ে। বিভিন্ন প্রকারের পাত্র দিয়ে সেই পানির ছড়িয়ে পড়া ঠেকানোর একটা বৃথা চেষ্টা করা হয়। রাতে কখনো হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলেই মা ছোটকে কোলে নিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে না এমন একটা জায়গায় বসে আগলে রাখেন। যাতে কোনোভাবেই বৃষ্টির পানি যেন তার আদরের ছোট ছেলেকে ছুতে না পারে। আব্বা আমাকে আর মেজোকে দুপাশে বসিয়ে দুহাতে এমনভাবে ধরে রাখেন, যেন আমরাও কোনোভাবে বৃষ্টির পানিতে ভিজে না যাই। আব্বার গায়ে চাদর আর আমরা সেই চাদরের তলে বসে নির্ভাবনায় ঘুমিয়ে যাই। কিন্তু জেগে থাকে দুটি চোখ। সন্তানের প্রতি ভালোবাসার এমন উদাহরণ আমার জানা মতে দুনিয়াতে আর দ্বিতীয়টি নেই।

মায়ের ওপর কোনো কারণে রাগ করে রাতে ভাত না খেয়েই শুয়ে পড়েছি। মা এসে অনেকবার ঘ্যানর ঘ্যানর করেছেন। কিন্তু মটকা মেরে পড়ে আছি। এমন ভাব করছি যেন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছি। কিন্তু শুনতে পাচ্ছি সবই। মা বেশ কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টা করে অপেক্ষায় থাকেন কখন আব্বা বাড়িতে ফিরবেন। আব্বা এসে শুধু একবার বলেন, ইয়াকুব এসে খেয়ে নাও। আমি একেবারে সুড়সুড় করে উঠে সুবোধ বালকের মতো আব্বার সঙ্গে খেতে বসি। কারণটা আমি এখনো জানি না। তবে এটা নিশ্চিত মারের ভয়ে না, কারণ শৈশবে বেশির ভাগ পিটুনিই খেয়েছি মায়ের হাতে। আর আব্বার হাতে খেয়েছি জীবনে মাত্র দুবার। এই কারণটার নামই হয়তো পিতার প্রতি সন্তানের শ্রদ্ধা।

তাস খেলা ছিল আমাদের রক্তে। তিন ভাই এক জায়গায় হলেই আমরা বসে পড়তাম। কিন্তু তাস খেলতে লাগে চারজন। তাই অবধারিতভাবেই চতুর্থ ব্যক্তিটি হলেন আমার আব্বা। বেশির ভাগ সময়ই আমি আর ছোট পার্টনার হতাম। ওদিকে মেজো আর আব্বা পার্টনার হতেন। দক্ষতার দিক দিয়ে তারা দুজনই আমাদের দুজনের চেয়ে অনেক ভালো খেলোয়াড়। কিন্তু তাস আবার ভাগ্যেরও খেলা। ভাগ্যদেবী সব সময়ই আমাদের দুজনের ওপর একটু বেশি সুপ্রসন্ন থাকত। তাই টুয়েন্টি নাইন খেলাতে আমি আর ছোট মিলে আব্বা আর মেজোকে একের পর এক লাল সেট, কালো সেট দিয়ে যেতাম। আর মেজোর সে কী রাগ। সে তার হলের চ্যাম্পিয়ন ইত্যাদি আরও কত কী? আমার, মেজোর বা ছোটর বন্ধুরা এসেছে কিন্তু সব মিলিয়ে চারজন হচ্ছে না। ব্যাস ডাকো আব্বাকে। জানি না এমন সহজ সরল সম্পর্কের নাম কী? হয়তোবা এটাকেই বন্ধুত্ব বলে।

আমার সাদা-মাটা শৈশবে চমকপ্রদ ঘটনা খুব বেশি ঘটত না। আর যাও ঘটত এখনকার বাচ্চারা শুনলে হেসে গড়াগড়ি দেবে। যা হোক, মজার ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল আব্বার কাঁধে চড়ার ব্যাপারটা। নিয়মিত এই ঘটনাটা ঘটত না। কারণ বেশির ভাগ সময়ই জীবিকার তাগিদে আব্বা বাড়ির বাইরে থাকতেন। তবে একদিনের কথা এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে। মনে হয় এইতো সেদিনের ঘটনা। নানি বাড়ি থেকে ফিরছি আমি আর আব্বা। বর্ষাকাল সবে শেষ হয়েছে। তাই ছোট ছোট খালগুলাতে তখনো কিছু কিছু জায়গায় পানি রয়ে গেছে। বেশির ভাগ খালই আমরা একটু ঘুরপথে, যেখানে পানি শুকিয়ে গেছে সেখান দিয়ে পার হচ্ছি। পথের শেষের দিকে এসে একটা খালে তখনো অনেক পানি। প্রায় আব্বার কোমর সমান। তাই আব্বা আমাকে কাঁধে তুলে নিলেন। আর এক হাতে স্যান্ডেল অন্য হাতে একটা ব্যাগ নিলেন। আমাকে বলে দিলেন, আমি যেন তাঁর চুল শক্তকরে ধরে চুপচাপ বসে থাকি। তারপর আমি আব্বার কাঁধে চড়ে হেলতে দুলতে খালটা পার হলাম। এরপর আমি জীবনে অনেক যানবাহনে চড়েছি, কিন্তু কখনো এতটা নির্ভয়ে এত বেশি মজা নিয়ে ভ্রমণ করিনি। মনে হচ্ছিল আমি কোনো রাজপুত্র, ঘোড়ায় (আমি আমার আব্বাকে ঘোড়া বলছি না, আমি শুধু আমার ওই সময়কার মনের অনুভূতি বোঝাতে চাচ্ছি) চড়ে দেশে ফিরছি। কারণ আমি প্রত্যেকদিনই ঘুমাতে যেতাম, কোনো না কোনো রূপকথা শুনতে শুনতে।

বর্ষাকাল এলেই তাহিয়াকে স্কুলে দিয়ে আমি অফিসে যাওয়ার পথে ওকে আমি কয়েকবার কাঁধে নিয়েছিলাম। কারণ, আমার এক হাতে থাকত ওর ব্যাগ অন্য হাতে আমার জুতা। সহজে পানি পার হওয়ার জন্য ওটা ছিল খুবই ভালো পদ্ধতি। এরপর তাহিয়ার সঙ্গে কোথাও গেলে সে বিভিন্ন অজুহাতে আমার কোলে না চড়ে কাঁধে চড়তে চাইত। আমিও অবলীলায় ওকে কাঁধে নিয়ে ঘুরতাম। একদিন হঠাৎ মেয়ের মা ওকে কাঁধে নিতে দেখে আমাকে ঝাড়ি দেওয়া শুরু করল। আমি বললাম সমস্যাটা কোথায়? ওর মা বলল, তাহিয়াকে কাঁধে নিতে দেখে লোকে বিভিন্ন ধরনের তির্যক মন্তব্য করে, তাই তাহিয়াকে আর কাঁধে নেওয়া ঠিক হবে না। শুনেতো আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। হায়রে শহুরে স্মার্ট বাঙালি? কোনটা যে স্মার্টনেস আর কোনটা যে খ্যাত, সেটাই বুঝল না? গ্রামের চাষা-ভুসা মানুষদের সব অভ্যাসই খারাপ না।

মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।