জীবনের বাইসাইকেল

আতিয়ার স্যার
আতিয়ার স্যার

স্কুলজীবন শেষ করে কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তি নেবে। আসনসংখ্যা মাত্র দুই শ। আমি ফরম তুললাম বিজ্ঞান বিভাগের। আমার সিরিয়াল নম্বর এল দুই শ সত্তর। পরবর্তীতে অবশ্য আসনসংখ্যা চার শ করাতে আমি সহজেই ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেলাম। আমি ছিলাম জগতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো ফলাফল করা ছাত্র। কিন্তু যখন কলেজে সারা কুষ্টিয়া জেলা থেকে ছাত্ররা ভর্তির আবেদন করল তখন বুঝতে পারলাম, আমার ফলাফলের প্রকৃত অবস্থা। সে জন্যই পড়াশোনার ক্ষেত্রে পরিবেশটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের স্কুলে আমি সামান্য একটু পড়াশোনা করলেই প্রথম বা দ্বিতীয় হতাম। তাই আর বেশি পড়তে আমার মোটেও ভালো লাগত না। আর ভালো ফলাফলের জন্য প্রতিযোগীও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভালো প্রতিযোগী পেলে প্রতিযোগিতাও অনেক হাড্ডাহাড্ডি হয় আর সেই সঙ্গে ফলাফলও অবধারিতভাবেই ভালো হয়ে যায়।
যা হোক, আমি ফরম তুলে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করে দিলাম। পরবর্তীতে বন্ধু আমিনুরও একই কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। কিন্তু আমি ভর্তি হয়েছিলাম ‘এ’ সেকশনে আর আমিনুর ‘বি’ সেকশনে। তাই সংগত কারণেই আমাদের দেখা সাক্ষাৎ কম হতে শুরু করল। স্কুলজীবনে আমাদের দুজনের স্কুল ও প্রাইভেট শিক্ষক একই হওয়াতে আমি তাঁর সাইকেলে করেই চলাফেরা করতাম। কিন্তু এখন সেকশন আলাদা হওয়াতে আমাকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হেঁটেই কলেজে আসা যাওয়া করতে হচ্ছিল। তবে মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গেও আসা যাওয়া করতাম। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হওয়াতে ক্লাস খুব একটা হতো না। সেই ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে হতো প্রত্যেক বিষয়ের স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে।
আমি যেহেতু এসএসসি পাস করেছিলাম সাধারণ প্রথম বিভাগে, তাই গ্রামের লোকেরা মন্তব্য করা শুরু করে দিলেন এই ছেলে উচ্চমাধ্যমিকে নির্ঘাত ফেল করবে। আসলে তখনকার ধারাবাহিকতাই এমন ছিল যে, এসএসসিতে প্রথম বিভাগ পেয়ে এইচএসসিতে ভূরি ভূরি ফেল করত। সায়েন্সের ছাত্ররা বেশি ফেল করত ইংরেজিতে। এমন সব তথ্য পাওয়ার পর আমি আর আমিনুর শামীম ভাইয়ার কাছে ইংরেজি পড়া শুরু করলাম। শামীম ভাই ছিলেন আমাদের দুই ব্যাচ সিনিয়র। আমাদেরই কলেজের বাণিজ্য বিভাগে পড়তেন। বয়সে আমাদের মাত্র দুই বছরের সিনিয়র হলেও এই মানুষটা মানসিকতায় অনেক বেশি পরিপক্ব ছিলেন। তিনি আমাদের পড়াতে শুরু করেছিলেন, কারণ তাঁর ফাইনাল পরীক্ষার আগে যাতে আমাদের পড়াতে গিয়ে ইংরেজি বিষয়টা এমনিতেই রিভিশন দেওয়া হয়ে যায়। আমিনুর অবশ্য তাঁকে কিছু টাকা বেতন হিসেবে দিত। কিন্তু তিনি আমার কাছ থেকে বেতন নিতেন না।
শামীম ভাই থাকতেন পাশের গ্রাম চৌড়হাসেই। তাই ওনার কাছে হেঁটে আসা যাওয়া করতে তেমন একটা সমস্যা হতো না। কিন্তু কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষকের কাছে আসা যাওয়া একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। পাশাপাশি লেখাপড়ার খরচও স্কুলের তুলনায় বেশি। ভর্তির প্রক্রিয়া শেষ করার পর সবচেয়ে বড় মুশকিলে পড়লাম উচ্চমাধ্যমিকের বই কেনা নিয়ে। বইয়ের দাম বেশি না হলেও আমার সামর্থ্যের বাইরে ছিল। তাই আমি মনে মনে পুরোনো বইই খুঁজছিলাম। আমিনুরও আমার জন্য বই খুঁজছিল। তখন আমিনুরের বন্ধু নাহিদ একদিন বলল, ওর পরিচিত একজন বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিল গত বছর। কিন্তু সে আর বিজ্ঞান বিভাগে পড়বে না। তার কাছে পুরোনো বই আছে। সেই ছেলের বাড়ি আমাদের উত্তর পাশের গ্রাম মঙ্গলবাড়িতে। একদিন বিকেলে আমি আর আমিনুর সাইকেলে চেপে সেই বই নিয়ে এলাম। একেতো পুরোনো বই, আবার সেই সামান্য টাকাটাও আমাকে একবারে শোধ করতে হলো না। তাই আমার জন্য সুবিধা হলো। কিছু কিছু করে টাকা জমিয়ে বন্ধু নাহিদকে দিয়ে দিতাম। সে সেই ছেলেকে পৌঁছে দিত।
বই কেনার পর আনুষঙ্গিক যে সামান্য খরচ, সেটাও দেওয়ার মতো অবস্থা তখন আমাদের পরিবারের ছিল না। ইতিমধ্যেই মেজ ভাইটা আমার পূর্বতন স্কুলেই মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছে আর ছোটটাও আমাদেরই গ্রামের প্রাথমিকে। তাই আমাকে দেওয়ার মতো টাকা মায়ের কাছে ছিল না মোটেও। তখন আমার সাহায্যে এগিয়ে এলেন পাড়ার বড় ভাই রায়হান ভাই। তিনি আমাকে একটা টিউশনি ঠিক করে দিলেন। বেতন মাসে আড়াই শ টাকা। সেই টাকাতেই আমার আনুষঙ্গিক খরচ চলে যেত। পাশাপাশি ছোট ভাইদেরও একটু সাহায্য করা যেত।
এত গেল বইখাতা কেনা আর আনুষঙ্গিক খরচের ফিরিস্তি। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়াল কলেজে আর স্যারদের কাছে পড়তে যাওয়া। প্রথম প্রায় কয়েক মাস পায়ে হেঁটে কলেজ আর প্রাইভেট চালিয়ে নিতে পারলেও যখন বিষয়ভিত্তিক পড়া শুরু হলো, তখন আর কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ হেঁটে স্যারদের বাড়ি পৌঁছাতে পারলেও সময় মিলছিল না। তখন আবারও আমার মা তার দুই বাহু দিয়ে আমায় আগলে ধরলেন। অনেক খোঁজখবর করে একটা সাইকেলের সন্ধান পেয়ে গেলেন। পাশের বাড়ির চাচা একদিন আমাদের বাড়ি এসে জানালেন, মাত্র সাত শ পঞ্চাশ টাকায় একটা সাইকেলের সন্ধান পেয়েছেন। এর চেয়ে সস্তায় সাইকেল আর পাওয়া যাবে না বলেও জানালেন। শুনে মা তক্ষুনি রাজি হয়ে গেলেন। বললেন আপনি সাইকেলের মালিককে কথা দিয়ে দেন। আমার আর এখন মনে নেই, মা টাকাটা কীভাবে জোগাড় করেছিলেন। কিন্তু এটা আমি জানতাম একসঙ্গে সাত শ পঞ্চাশ টাকা দেওয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের ছিল না। মাকে হয়তো এনজিওগুলোর কাছ থেকে লোন করতে হয়েছিল।
একদিন আমি আর আমিনুর ওর সাইকেলে চড়ে সেই সাইকেল আনতে গেলাম। গিয়ে দেখি সেটা কারও ব্যক্তিগত সাইকেল না। একজন সাইকেল মেরামতের দোকানদার বিভিন্ন সাইকেলের অংশবিশেষ জোড়াতালি দিয়ে সাইকেলটার অবয়ব দাঁড় করিয়েছেন। ইতিমধ্যেই আমি আমিনুরের সহায়তায় সাইকেল চালানো মোটামুটি শিখে ফেলেছি। তাই আমিনুর বলল, আমি তোর আগে আগে চালিয়ে যাব, তুই আমার পেছনে চালিয়ে আসবি আমাকে অনুসরণ করে। তাহলে চালাতে অসুবিধা হবে না। আমি তখন ওকে অনুসরণ করে সাইকেল চালিয়ে আসা শুরু করলাম। তবে কোথাও বেশি মানুষজন বা গাড়িঘোড়া দেখলেই সাইকেল থেকে নেমে ঠেলে সেই জায়গাটা পার হয়ে তারপর আবার চালাতাম। বিশেষ করে রাস্তার মোড়গুলো পার হওয়ার সময় আমাকে নামতেই হতো। এভাবে চলতে গিয়ে বেশ কিছু মাইনর দুর্ঘটনাও ঘটিয়েছিলাম।
এরপর শুরু হলো বিভিন্ন স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়া। সর্বপ্রথম রসায়ন পড়া শুরু করেছিলাম আতিয়ার স্যারের কাছে। এই মানুষটাও আমার দেখা আরও একজন ফেরেশতাতুল্য মানুষ। প্রথম দিন পড়ার শেষে আলাদা কক্ষে গিয়ে স্যারকে বললাম, স্যার আমি কিন্তু বেতন দিতে পারব না। স্যার আমার কথা শুনে মুখ তুলে আমার দিকে তার চশমা পরা চোখের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি হানলেন। আমি তাঁর দৃষ্টি দেখেই বুঝলাম আমি যদি মিথ্যা বলতাম তিনি ধরে ফেলতেন তক্ষুনি। আমি ঢোক গিললাম একটা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কেন? আমি বললাম আব্বা সামান্য রাজমিস্ত্রির জোগালি, তাঁর পক্ষে খরচ চালানো সম্ভব নয়। আপনি বিনা বেতনে পড়ালে আমি পরদিন আসব না হলে আর আসব না। শুনে তিনি বললেন, তুমি যে সত্য বলছ সেটা যাচাই করব কীভাবে? আমি তখন আবার রায়হান ভাইয়ের নাম বললাম। স্যারেরা তাঁকে হাবিব নামে চিনতেন। তাই বললাম আপনি হাবিব ভাইকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
রায়হান ভাই আমাদের পাড়ার একমাত্র মেধাবী ছাত্র যিনি আমাদের পড়ালেখার একমাত্র অনুপ্রেরণা ছিলেন। উপরন্তু তিনি স্যারের মেয়েকে পড়াতেন আর সেটা স্যারই ঠিক করে দিয়েছিলেন। কারণ রায়হান ভাইয়ের আব্বাও আমার আব্বার মতোই গরিব ছিলেন। রায়হান ভাইয়ের অবদান আমার শিক্ষাজীবনের একেবারে আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত। সে গল্প অন্য কোনো দিন। যা হোক, স্যার বললেন ঠিক আছে তুমি আসতে থাক। আমি হাবিবের সঙ্গে কথা বলে নিব। আমি পরে রায়হান ভাইকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম স্যার তাঁকে কিছুই জিজ্ঞেস করেননি। এভাবে স্যারেদের ভালোবাসায় এগিয়ে চলল আমার কলেজজীবনের পড়াশোনা। প্রত্যেক স্যারের কাছে গিয়েই আমি প্রথম দিনেই আমার বেতন দিতে না পারার অপারগতা প্রকাশ করে দিই। স্যারেরাও তেমন একটা আপত্তি করেননি।
সামনেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন। কিন্তু আমার হাতে অতগুলো টাকা নেই। আতিয়ার স্যার আগে থেকেই সব জানতেন। তাই স্যারের শরণাপন্ন হলাম। স্যার ঠিক আমার মায়ের মতোই আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, তুই তোর পড়াশোনার দিকে খেয়াল রাখ, বাকিটা আমি দেখছি। মনে রাখিস যার কেউ নাই তার আল্লাহ আছেন। দুই বছরের পরিচয়ে ইতিমধ্যেই স্যার আমাকে তুমি থেকে তুই বলতে শুরু করেছেন। আমি ঠিক আগেরবারের মতোই ভরসা পেলাম। ঠিক যেভাবে মায়ের কথায় ভরসা পেয়েছিলাম।
স্যার একদিন আমাকে আর বন্ধু সালাম, সেইসঙ্গে পরের ব্যাচের আরও একজন জুনিয়রকে ডেকে পাঠালেন। বন্ধু সালাম আর জুনিয়রেও আমার মতোই আর্থিক অবস্থা। তাই আমাদের তিনজনকে ডেকেছেন স্যার। তারপর তিনি ডিসি বরাবর আর্থিক সাহায্যের জন্য আবেদনপত্র লিখতে বলে আমাদের দিকে সাদা কাগজ আর কলম এগিয়ে দিলেন। আমরা তৎক্ষণাৎ লিখে স্যারকে দিলাম। স্যার সেগুলোতে চোখ বুলিয়ে মাঝ বরাবর ফাঁকা অংশে ‘সদয় বিবেচনার জন্য সুপারিশ করা হলো’ লিখে নিচে তাঁর দস্তখত ও সিল দিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, তোরা এক্ষুনি ডিসি স্যারের অফিসে চলে যাবি। ওনার সঙ্গে কথা বলে রেখেছি। তোরা গেলেই উনি ব্যবস্থা নেবেন। আমরা তক্ষুনি ডিসি অফিসের উদ্দেশে রওনা দিলাম।
কুষ্টিয়ার তৎকালীন ডিসি আবদুস সালাম ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আতিয়ার স্যারের সহপাঠী। সেই সূত্র ধরেই স্যার আমাদের ডিসি স্যারের কাছে পাঠিয়েছিলেন। আমরা তখনই জানতে পারলাম, ডিসিদের কাছে আলাদা সরকারি একটা ফান্ড থাকে গরিব ও দুস্থদের সাহায্য করার জন্য। আমরা মনে অনেক ভয় নিয়ে ডিসির কক্ষে প্রবেশ করে তার সামনে টেবিলের অপর পাশে রাখা চেয়ারগুলোতে বসলাম। তাঁর কক্ষে প্রবেশ করতে আমাদের তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি। কারণ আতিয়ার স্যার আগেই বলে রেখেছিলেন। এরপর ডিসি সাহেব ধীরস্থির ভঙ্গিতে খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলেন। তাঁর প্রথম কয়েকটা কথা এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। তিনি বললেন, ‘শোনো সবাই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেয় না, তাই তোমাদেরকে থেমে গেলে চলবে না। তোমরা পরিশ্রম করে অবশ্যই একদিন অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।’
পরে আমাদের জন্য সামান্য নাশতা নিয়ে আসা হলে আমরা খুব ভয়ে ভয়ে সেগুলোর থেকে একটু আধটু মুখে দিলাম। তারপর একসময় তিনি আমাদের বললেন, পাশের কক্ষে যাও সব ব্যবস্থা করা আছে। আমরা তিনজনেই প্রত্যেকে দুই হাজার টাকার ব্যাংক চেক বুঝে নিলাম দস্তখত করে। তারপর ব্যাংকে গিয়ে টাকাটা উঠিয়ে নিলাম।
স্যারদের বাসায় পড়তে যাওয়া থেকে শুরু করে নিজের টিউশনিতে যাওয়া সবকিছুই আমার জন্য সহজ হয়ে গিয়েছিল আমার জোড়াতালি দেওয়া বাইসাইকেলটার জন্য। আসলে আমার নিজের জীবনটাও ছিল অনেকটা এই বাইসাইকেলটার মতো। আমার আশপাশের বিভিন্ন প্রকার সাহায্য সহযোগিতায় আমার পথচলা সহজ হয়ে যাচ্ছিল। আর সাইকেলের আগের চাকাটা যেমন পথ বেছে নেয়, আমিও তেমনি একেকটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলাম আর সাইকেলের পেছনের চাকার মতো আমার আব্বা-মা থেকে শুরু করে শিক্ষক, পাড়া-প্রতিবেশী ও সহপাঠী সবাই সহযোগিতা করে যাচ্ছিল। তা না হলে অনেক আগেই আমি কালের গর্ভে হারিয়ে যেতাম।

মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।