যন্ত্র পাখির ডানায় উড়ে যায় বস্ত্রবালিকারা

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন বিপুলসংখ্যক নারী। ছবি: রয়টার্স
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন বিপুলসংখ্যক নারী। ছবি: রয়টার্স

বিকেলের আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ। কর্ণফুলী নদীতে ভৌতিক এক সূর্যরশ্মি। আম্মা, ছোট বোন আর দুই ভাগনে এসেছে বিমানবন্দরে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাব। তারপর দুবাই হয়ে লিসবন। আম্মা কাঁদেন। অনেক কষ্টে চেপে রেখেছিলেন এতক্ষণ। তাঁকে দেখে ছোট বোনটাও ছেড়ে দিয়েছে চোখের পানি। বাবা বেঁচে নেই। থাকলে চিৎকার করে বুকে জড়িয়ে কাঁদতেন। যেভাবে শেষবার কেঁদেছিলেন। নিজে হয়তো টের পেয়েছিলেন, না হয় কীভাবে কপালে চুমু খেয়ে বলে দেন, হায়াত ফুরিয়েছে আমার। তোকে হয়তো আর দেখব না! ভালো থাকিস আব্বাজান। আব্বা চলে গেছেন। সত্যি সত্যি পরে আর দেখা হয়নি তাঁর সঙ্গে।

কেন জানি মনে হয়, দুনিয়ার সবচেয়ে কষ্ট ও আনন্দের জায়গা বিমানবন্দর। কেউ আসে, কেউ যায়। এই আসা যাওয়ায় বুক কাঁপে কত মানুষের। চোখ টলমল করে। আমি নিশ্চিত, পৃথিবীর সমস্ত বিমানবন্দরে প্রতিদিন একটু একটু করে ভেজে মানুষের চোখের জলে। সুখের অথবা দুঃখের। এইতো, একটু পর আমি ছেড়ে যাচ্ছি আম্মাকে, ছোট বোনকে। পরিবার, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবসহ প্রিয় চট্টগ্রাম ছেড়ে ছুটছি বহু দূরের এক দিগন্তে। যেখানে সূর্য ওঠে না এ দেশের মতো। যেখানে পাখিদেরও অদৃশ্য দেয়াল আঁকা। ভুলেও ছুঁতে যায় না ওপারের আকাশ। সঙ্গে এমন আরও কত মানুষ! আমার হাহাকার লাগে।
এদিকে আবার অনেক বছর পর, অনেক দূর থেকে কেউ হয়তো ফিরে আসছে। পরম আনন্দে চোখ ভিজে অপেক্ষারত স্বজনের—মায়ের, বোনের।
আমি বিমানবন্দর এড়িয়ে যেতে চাই। কিন্তু নিরুপায়।
ভোরে আবার ঢাকা বিমানবন্দরে দীর্ঘ লাইন। এখানে দেখা মেলে যেন পুরো দেশের মুখ। প্রায় সব অঞ্চলের বিদেশমুখো মানুষ একসঙ্গে লাইনে। ছোট বড় ব্যাগ-লাগেজ হাতে ধীরে ধীরে লাইন এগোয়। বিমানবন্দরের বাইরের বারান্দা থেকে সিকিউরিটি গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে সে লাইন। তারপর আবার দীর্ঘ লাইন বোর্ডং পাসের কাউন্টার ও ইমিগ্রেশনে। সেখানে কেউ চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কেউ মুঠোফোনে বিদায় নিচ্ছেন, কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছেন প্রিয়জনকে। তার মাঝে অনেক মানুষ ছোটাছুটি করছেন এখানে সেখানে। কোন ফ্লাইটের কোন লাইন, সেটা বুঝছেন না। আবার অনেকে ইমিগ্রেশনের ছোট কাগজে ঠিকমতো নাম ঠিকানা, পাসপোর্ট ও ফ্লাইট নম্বর লিখতে হিমশিম খাচ্ছেন। তার ওপর আছে কর্তব্যরত পুলিশের ঝাড়ি। সঙ্গে আরও নানা ঝামেলা।
বিমানবন্দরে এলেই দেখা মেলে এ রকম বহু মানুষের দুর্ভোগের চিত্র। আমি চুপচাপ তাঁদের দেখি। সহজ সরল মানুষগুলোর চোখে মুখে মিশে থাকে একদিকে পরিবার ছেড়ে দূর দেশে পাড়ি দেওয়ার নীরব কান্না, অন্যদিকে উপার্জনের আত্মবিশ্বাস। বেশির ভাগই শ্রমিক তাঁরা। গল্পও মিলে যায় সবার। জায়গা জমি থেকে শুরু করে শেষ সম্বলটুকু বেঁচে বিদেশ যাত্রা। বেশির ভাগেরই গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য। কিছু ইউরোপ। লেখাপড়া বেশি করেননি হয়তো। তবে কাজ করে টাকা পাঠাতে পারেন দেশে। সে টাকায় চলে আমাদের অনেক কিছু। কিন্তু তাঁরা পড়াশোনা না করায় দেশের বিমানবন্দরে একটু ঝক্কি-ঝামেলা কিংবা অপদস্থ হতে হয় আর কি! হয়তো বুঝে গেছেন, প্রবাস জীবনের চ্যালেঞ্জ শুরু বিমানবন্দর থেকেই। সব মেনে নিতে হবে চুপচাপ। ঢোঁক গিলে হজম করে তাই নিজেকে নিজে বলেন, হে প্রবাসী, যাত্রা শুভ হোক তোমার।
পরে ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে আমি। হঠাৎ শুনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে চাপা কান্নার শব্দ। পেছনে ফিরে দেখি মাথায় সান ক্যাপ পরা এক তরুণী। ফোন কানে। চোখ থেকে ড্যাবড্যাব করে জল গড়াচ্ছে। ‘শরীরের যত্ন নিয়ো বাবা। আমি গিয়ে বেতন পেলেই তোমার জন্য টাকা পাঠিয়ে দেব। ঢাকায় এসে ভালো ডাক্তার দেখিয়ো তখন।’ মেয়েটার কান্না থামবে জানি না! আমার নিজের চোখেও তখন জল। আব্বাকে মনে পড়ছিল খুব। আম্মাকেও। কোনো কথা না বলে মাথা নেড়ে তরুণীকে কাঁদতে নিষেধ করি। তরুণী বোঝে, কান্না থামায়। চারপাশে দেখি আরও অনেক মেয়ে। সবার মাথাতেই একই রকম ক্যাপ। চেহারায় গভীর উদ্বেগ। পরনে সালোয়ার কামিজ, থ্রি পিস। হয়তো সবচেয়ে ভালো জামাটি পরেছে আজ। বুঝলাম, কোনো একভাবে তাঁরা সবাই একসূত্রে গাথা। লাইন এগোয় ধীরে ধীরে। মেয়েরা কথা বলছে একে অপরের সঙ্গে। স্পষ্ট করে না বুঝলেও কথায় কিছুটা আঁচ করতে পারলাম, তাঁদের গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এক দেশে এবং তাঁরা সবাই শ্রমিক। গার্মেন্টস শ্রমিক। একপর্যায়ে ইমিগ্রেশন পার হই। তারপর ফ্লাইট ধরতে যাব।
ভেতরে দেখি আরও প্রায় ৫০ জনের মতো মেয়ে। যে মেয়েটিকে কাঁদতে দেখেছিলাম একটু আগে, ইমিগ্রেশন পার হয়ে সেও এখন বাকিদের সঙ্গে। কান্না থেমেছে। কিন্তু চোখ টলমল করছে তখনো।
জিজ্ঞেস করে জাসতে পারলাম, তাঁর নাম নাম লায়লা। বয়স কুড়ি। ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করতেন। এখন একটা কোম্পানির মাধ্যমে দুবাই যাচ্ছেন। ওখানেও গার্মেন্টসের কাজ করার চুক্তি হয়েছে। অনেকে তো দালালদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে আবার দেশে ফেরেন। আপনি সব বুঝেশুনে যাচ্ছেন তো! আমার প্রশ্নে লায়লা মাথা নাড়ান। তারপাশে বসা একজন তাঁকে সমর্থন দেন। লায়লার পাশের খালি চেয়ারটায় বসি। বলি, আমিও বিদেশ যাচ্ছি, খারাপ লাগছে সবার জন্য, কিন্তু বাস্তবতা তো মেনে নিতে হবে।
লায়লা নিজেকে সামলে নেন। কান্না থামিয়ে বলতে শুরু করেন, বাবার জন্য খুব খারাপ লাগছে। অসুস্থ বাবাকে রেখে চলে যাচ্ছি, জানি না ফিরে এসে দেখব কিনা! ঢাকার যে গার্মেন্টসে চাকরি করতাম, সেখানকার অল্প টাকায় বাবার চিকিৎসা সম্ভব না, এর সঙ্গে আছে ছোট ভাইয়ের খরচ, নিজের খরচ, সংসারের খরচ! কোনোভাবে সামলাতে না পেরে সুযোগ পেয়ে এখন বিদেশ চলে যাচ্ছি। দেখি ভাগ্যটা বদলায় কি না!
জীবনে প্রথমবারের মতো আকাশে উড়ে ভিন্ন এক দেশে যাওয়া। তার ওপর এমন এক বেদনাভরা জীবনের গল্প। বুঝলাম, চোখের পানি ধরে রাখা আসলেই মুশকিল। লায়লার মতো তাই অনেকের চোখই ভেজা। আবার একই সঙ্গে চেহারার কোনো এক কোনায় ফুটে উঠেছে কিঞ্চিৎ সুখের প্রত্যাশা। মনে মনে যেন বলছে তাঁরা, বিদেশ যাচ্ছি, কষ্ট আর থাকবে না। এবার সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
আর একটু দূরের চেয়ারে দেখি কয়েকজন মধ্যবয়স্ক নারী। যে কেউ একবার তাদের চেহারা দেখলে খুব সহজেই পড়তে পারবেন রাজ্যর সমস্ত উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ কীভাবে মিশে আছে তাতে। তার সঙ্গে জীবনের ভাগ্য বদলানোর সুখানুভূতি! অন্যদিকে গ্লাসের ভেতর দিয়ে সকাল সূর্যের মিঠে খুনসুটি। চুপচাপ বসে অপেক্ষা করি ফ্লাইটের। ভাবি, এই মেয়েরা কি জানেন মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজারের সার্বিক অবস্থার কথা। কঠিন সব ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য তাঁরা কি প্রস্তুত! কি হবে, যদি ওখানে গিয়ে দেখেন, চুক্তিমত কাজ ও মজুরি পাচ্ছেন না! সবই আসলে মিথ্যা!
দূর পরবাসে তখন স্বপ্নভঙ্গের কষ্টে তাঁদের মাথায় হাত বোলাবে কে! কোথাও কি তখন একটু আশ্রয় পাওয়া যাবে! এর ওপর যদি আবার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলে, তখন কোথায় যাবেন। ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকদের ওপর নানা নির্যাতনের কথা পুরো বিশ্ব জেনে গেছে। নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, উগান্ডা, কেনিয়া, তাঞ্জানিয়ার মতো দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যে তাদের নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। তবু অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই। নির্যাতন চলছেই। এ নির্মম অবস্থায় জানি না, বাংলাদেশ সরকার কী উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। নাকি এটাকে স্রেফ বিদেশি রেমিট্যান্স আয়ের অনন্য সুযোগ হিসেবে দেখছে! এই সব নারী শ্রমিকদের নাগরিক অধিকার নিয়ে কারও কি কোনো মাথা ব্যথা আছে।
একটু পর মেয়েদের ডাক পড়ে। ফ্লাইট যাত্রা করবে। বোর্ডিং পাস হাতে সবাই এগোয়। কী সুন্দর দৃশ্য! সংসারের উপার্জন করতে একদল মেয়ে উড়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণ অচেনা এক দেশে। সেখানে তাঁদের কঠোর শ্রমের বিনিময়ে হেসে উঠবে কিছু মুখ ও একটি দেশ।
ইউরোপে দেখেছি, অনেক বড় বড় কোম্পানি সস্তা মজুরির কথা মাথায় রেখে পিছিয়ে পড়া অনুন্নত দেশগুলো থেকে শ্রমিক আমদানি করে। এদের বেতন ঠিক করে দেয় অনেকটা শ্রমিকের দেশের সস্তা বেতন কাঠামো বিবেচনা করে। ফলে, ভাগ্য বদলানোর আশায় বিদেশ পাড়ি দিলেও শেষ পর্যন্ত সে আশায় গুঁড়েবালি। বিদেশ একটা মরীচিকা ও জটিল ফাঁদ হয়ে ঠেকে তাঁদের সামনে। তখন একটা চক্রের ভেতর আবর্তিত হতে থাকে জীবন। মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা তো আরও ভয়াবহ। প্রতি পদে পদে এখানে ফাঁদ। নির্যাতন। খবরের কাগজ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে আমরা খুব সহজেই জানতে পারি সব!
মেয়েরা এগিয়ে যায় ছোট করিডর ধরে। আমিও এগোতে থাকি। একটু পর বিমান আকাশে ওড়ে। আমার আশপাশে বসেছে অনেক নারী শ্রমিক। দুবাই পর্যন্ত যাত্রা একই ফ্লাইটে। তারপর আমার কানেকটিং ফ্লাইট। আচমকা দেখি, একটা কোনায় বিমানের জানালার পাশের সিটে বসেছেন লায়লা। জানালায় মুখ ঘেঁষে তাকিয়ে আছেন নিচের দিকে। নিচে হয়তো দেখা যায় এত দিনকার গার্মেন্টসে যাওয়ার ব্যস্ত রাজপথ। টিফিন ক্যারিয়ার হাতে হাঁটছে তাঁর সহকর্মীরা। ধুলো ময়লায় মোড়ানো তীব্র যানজটের চিরচেনা ঢাকা শহর। ওই যে, ওখানে বসে তারা বকেয়া বেতন ও বোনাসের জন্য আন্দোলন করেছিল। লাঠিপেটা খেয়েছিল খুব। এখন সব যেন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে! দেখতে দেখতে অবাক হন লায়লা। বাহ! ওপর থেকে ঢাকা দেখতে এত সুন্দর! আগে কখনো দেখেননি এমন করে। দুঃখে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে কতবার এ শহর ছেড়ে, এ জীবন ছেড়ে পালাতে চেয়েছিলেন লায়লা। আজ খুব মায়া হচ্ছে! সত্যি সত্যি এ শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ওপর থেকে তখনো দেখা যায়, ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে। হয়তো গ্রাম থেকে আসা তাঁর মা আর ছোট ভাইটি এই ট্রেন ধরেছে। সূর্য ডোবার আগে পৌঁছাবে তো তাঁরা! বাতাসে উড়তে থাকে প্লেন। লায়লার মনে হয়, এ ঠিক বাতাস নয়, এটি তার, তাঁর সব সহকর্মীর দীর্ঘশ্বাস। এক যোগ হয়ে প্লেনকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে দূরে কোথাও।
চোখে ঘুম নামে আমার। ঘুমের ভেতর হঠাৎ কল্পনায় ভেসে ওঠে ইউরোপের নানা দেশের নানা শহরে বড় বড় শপিংমলগুলোয় শোভা পাওয়া প্যান্ট-শার্ট কিংবা দামি কোনো বস্ত্রসামগ্রী। যেখানে লেখা মেড ইন বাংলাদেশ। আহ! বুক ফুলে গর্ব করার মতন এত চমৎকার দৃশ্য পৃথিবীতে আর কয়টা আছে কে জানে! এই মেয়েরাই তো আসলে বিশ্বের মাঝে লিখে পাঠান আমার দেশের নাম। চোখ খুলি। দেখি, ক্লান্ত হয়ে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছেন! করুণ চেহারার সে অবয়ব দেখে মনে মনে বলি, দুঃখ পেয়ো না বস্ত্রবালিকারা। বিশ্বে তোমরা আমাদের মাথা উঁচু রাখো, আমাদের দেশও রাখবে তোমাদের মাথা উঁচু। ভালো থেকো আমার বোন, বস্ত্রবালিকারা!

সোহেল রহমান: চলচ্চিত্র নির্মাতা, লিসবন, পর্তুগাল। ইমেইল: <[email protected]>