মেঘ রোদ্দুরের খেলা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বহুদিন পর ভদ্রমহিলার মুখে ‘আঁখি’ নামটা শুনে রাকিব সত্যি চমকে উঠেছিল। কিছুক্ষণের জন্য সে কোথায় যেন ক্ষয়ে গিয়ে একেবারেই চুপ হয়ে গিয়েছিল। 

আঁখি তার ডাক নাম।
অবশ্য সে ভদ্রমহিলার মুখে তার ডাকনামটা শুনে যতটুকু না আবেগে তাড়িত হয়েছিল, এর ঠিক উল্টো অনুভূতি হয়েছিল ‘বাবা’ ডাকটা শুনে।
ভদ্রমহিলাই কথা বলে যাচ্ছিলেন বেশি। এপাশে মোবাইল কানে চেপে ধরে রাকিব কিছুক্ষণ কঠিন হয়ে বসেছিল।
উনিশ বছর! রাকিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, হ্যাঁ, উনিশ বছর!
সে উনিশ বছর আগের সেই দৃশ্যটা মনে করার চেষ্টা করল। শেষবারের মতো ভদ্রমহিলার সঙ্গে তার যখন দেখা হয়, তখন ছিল শীতের সূর্যের এক দুপুর। দুপুরের নিস্তব্ধতা ছিল সর্বত্র। শুধু রিকশার টুং টাং শব্দ, আর দূরে কিছু এলোমেলো ঝিম ধরা মানুষ। ভদ্রমহিলা তার স্বামীসহ রিকশায় বসেছিলেন। রিকশার হুড তোলা ছিল।
ভদ্রমহিলা শুধু কাঁদছিলেন।
ভদ্রমহিলার স্বামী রাকিবের হাত টেনে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়ে বলেছিলেন, তুমি টিফিনের জন্য রাখো।
পঞ্চাশ টাকার নোট তার জন্য তখন অনেক টাকা। তখন তার বয়সই বা কত ছিল? বারো কী তেরো। তখন সে ক্লাস সেভেনে পড়ত।
ভদ্রমহিলার পরনে ছিল সাদার সঙ্গে মিশ্রণ মাটি রঙা একটি সুতি শাড়ি। ব্লাউজটাও একই রঙের ছিল। তাঁর বাম কাঁধে একটা শাল ভাঁজ করা ছিল। শালের রংটা মেরুন না লাল ছিল, সে এ মুহূর্তে ঠিক মনে করতে পারল না। কিন্তু ভদ্রমহিলার শাড়ির রংটা প্রতিনিয়তই সে মনে রেখেছে। আর সে মনে রেখেছে বলেই মাটিরঙা শাড়ি পরা কোনো ভদ্রমহিলা দেখলে আজও তার ভেতর কেমন নাড়া দেয়।
ভদ্রমহিলার স্বামীর দেওয়া পঞ্চাশ টাকার নোটটার কথা সে অবশ্য কোনো দিন বাড়িতে কাউকে বলেনি। দীর্ঘদিন বইয়ের মলাটের ভেতর লুকিয়ে রেখে পরে সে উত্তরের উজানে পুনোয়ারার মেলায় গিয়ে জুয়া খেলে উড়িয়ে দিয়েছিল। ওটাই ছিল তার প্রথম ও শেষ জুয়া খেলা।
রাকিব লাইনটা কেটে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে অযথাই কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। স্ক্রিনটার আলো কমতে কমতে একসময় কালো হয়ে গেল।
রাকিব মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে থেকে ভদ্রমহিলার চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করল। একটা আবছা এলোমেলো ছায়া তাঁর চোখে ভেসে উঠল। এতগুলো বছর। তাঁর দাদি-চাচিরা বলতেন, ভদ্রমহিলা নাকি দেখতে প্রতিমার মতো ছিলেন। ঘিয়ে রং, খোদাই করা চেহারা। পানপাতার মতো মুখ! কাজী বাড়িতে নাকি সাতপুরুষেও এমন সুন্দর বউ আসেনি।
রাকিব মোবাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাইরে তাকাল। জানালার কাচ গলে একফালি রোদ তাঁর পায়ের কাছে এসে পড়েছে। তেরসা রোদের ভেতর গাছের চিকন-চিকন ডালের সরু সরু ছায়া। একটা ওক গাছ কাচের জানালার ওপাশে। দোতলার জানালার সমান উঁচু গাছটার এলোমেলো ডালগুলো শীতে পাতাহীন হয়ে কেমন ন্যাংটো হয়ে রয়েছে। যেন মসৃণ বিবস্ত্র যুবতীর মতো ন্যাংটো।
রাকিব বসা থেকে কাত হয়ে বালিশটা টেনে একটু টানটান হয়ে শুলো। পাশ থেকে একটা ভারী নীল কম্বল টেনে গায়ে দিল। রুমের দক্ষিণ কোণে একটা ইলেকট্রিক ওয়েল হিটার চলছে। হিটারের ছোট্ট মনিটরে টোয়েন্টি টু ডিগ্রি একটা ডিজিটাল লেখা ভেসে উঠেছে। রুমের তাপমাত্রা মোটামুটি উষ্ণই বলা যায়। এ ছাড়া রুমটার ভেতর একটা রোদ-ছায়ার খেলাও চলছে। তবুও তার খানিকটা শীত শীত বোধ হচ্ছে।
সিথানের বামপাশের বেড সাইড কেবিনেটের ওপর টেবিল ঘড়িটা চলছে—টিক-টিক, টিক-টিক।
রাকিব ঘড়ি দেখল। সকাল প্রায় সাড়ে নয়টা বাজে। রোদ উঠে যাওয়ার পরও কাচের জানালায় শিশির বিন্দুগুলো হালকা ঝাপসা করে তখনো জমে আছে। বিশেষ করে জানালার কাচের নিচের অংশে।
রাকিব এত বেলা পর্যন্ত কখনো শুয়ে থাকে না। সাধারণত সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত তাঁর অফিস। ফ্লিটাচার স্টিল কোম্পানিতে সে শিফট সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করে।
কিন্তু আজ তাঁর ছুটির দিন। আগামীকালও তাঁর ছুটি। এ সপ্তাহে ইস্টার হলিডের লং উইকেন্ড চলছে।
গতরাতে একটু রাত করেই সে বাসায় ফিরছিল। রিয়েল টু সিনেমা হলের লেট শোতে সে মণিকা আলীর ‘ব্রিকলেন’ উপন্যাস অবলম্বনে ব্রিকলেন মুভিটা দেখতে গিয়েছিল। সাধারণত রিয়েল টু সিনেমা হলে একটু পুরোনো সিনেমাগুলো দেখায়। রিজেন্ট সিনেমা হলে তো আরও পুরোনোগুলো দেখায়। নতুন মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলো দেখায় ইভেন্ট অথবা হোয়েটস সিনেমা হলগুলোতে।
রাকিব ব্রিকলেন উপন্যাসটা পড়েছে। পরিচালকের পরিচালনার হাত যদি মেধাবী না হয় তাহলে মুভি ক্যামেরায় একটা উপন্যাসের যে কী রকম বেহাল অবস্থা হয়, ব্রিকলেন মুভিটাই তা স্পষ্টই প্রতীয়মান। নায়িকার অভিব্যক্তিগুলো ফুটে ওঠার চেয়ে বরং বিকৃত হয়েছে।
উপন্যাসের কাহিনি একজন বাঙালি নারীকে নিয়ে। যৌবনে পা দিতে না দিতেই মধ্যবয়স্ক এক লন্ডনপ্রবাসী ভদ্রলোকের সঙ্গে বিয়ে। তারপর লন্ডনের ব্রিকলেনের জীবন। দুই মেয়ের জননী হওয়া। সংসার ধর্ম ও সকাল-দুপুর-রাত স্বামী-সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকা। একদিন আকস্মিকভাবে এক যুবকের প্রেমে পড়া। তারপর শেকড়হীন!...শেকড়হীন, রুটলেস!...বাঙালি নারী যে বাবার ঘরে শেকড়হীন, স্বামীর ঘরে শেকড়হীন, সংসার-ধর্মে শেকড়হীন, প্রেমিকা পরকীয়া—সর্বত্রই শেকড়হীন, সেটাই উপন্যাসটার মধ্যে ফুটে উঠেছে।
ব্রিকলেন উপন্যাসের নারী চরিত্রটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে রাকিব অন্য কথা ভাবল। ব্রিকলেনের নারী চরিত্রটার মতো প্রবাসের প্রত্যেকের জীবনটাই কি শেকড়হীন নয়? এই যে তার জীবন, এখানকার সবার জীবন, এই প্রবাসে, নিউজিল্যান্ডে!...রুটলেস, রুটলেস...।
এমন ভাবনার মধ্যে টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল।
বিছানার ডান পাশে বেড সাইড কেবিনেটের ওপর টেলিফোন সেটটা রাখা। টেলিকম কোম্পানির ঘিয়ে রঙের সেট। পাশেই তার মোবাইলটা চার্জে রাখা। একটা টেবিল ল্যাম্প টেলিফোন সেটটার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাংক অব নিউজিল্যান্ডের একটা এনভেলাপ দিয়ে ঢেকে রাখা একটা কাচের গ্লাস। গ্লাসের ভেতর আধা গ্লাস পানি। টেলিফোনের শব্দে গ্লাসের পানিটা সরু সরু রেখা বানিয়ে তিরতির করে কাঁপছে।
রাকিবের কপালেও তৎক্ষণাৎ একটা চিন্তার সরু রেখা ফুটে উঠল। ভাবল, ভদ্রমহিলা এবার মোবাইলে ফোন না দিয়ে ল্যান্ডলাইনে ফোন করলেন নাতো?
বালিশ থেকে কাত হয়ে একটু সময় নিয়ে সে টেলিফোন সেটটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে করে রিসিভার ওঠাল। সংযতভাবে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে এ দেশি এক নারীর কণ্ঠ ভেসে এল—ক্যান আই টক টু আতিক প্লিজ!...
রাকিব ‘ইয়েস বা নো’ কিছুই বলল না। রিসিভারটা টেলিফোন সেটটার পাশে কাত করে রেখে অনেকটা ধীরস্থিরভাবেই সে বিছানা ছেড়ে উঠল। শরীরের আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে খানিকটা বিরক্ত দৃষ্টিতে টেলিফোনের রিসিভারটার দিকেও তাকাল। তার এই বিরক্তির কারণ টেলিফোনের সেট নয়, আতিক!
বেডরুম ছেড়ে রাকিব লিভিং রুমে গিয়ে একটু এদিক-ওদিক তাকাতেই বড় সোফার কোণায় কর্ডলেসটা পেয়ে গেল। সে উবু হয়ে কর্ডলেসটা নিয়ে আতিকের রুমের দিকে পা বাড়াল।
আতিকের রুমের দরজা ভেজানো।
রাকিব আস্তে করে ভেজানো দরজা ঠেলে আতিকের রুমে উঁকি দিল।
জানালার পর্দা টেনে রাখা বলে আতিকের রুমে আলো আঁধারি ভাবটা বেশি। সে ভুস ভুস করে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
গতরাতে আতিক নাইট শিফটে কাজ করেছে। সে একটা পেট্রল পাম্পে কাজ করে। শিফটিং ডিউটি। বিপি কানেক্ট সার্ভিস স্টেশন। সিটির ভেতর ট্রিসটম স্ট্রিটে সকাল ছয়টা পর্যন্ত তাঁর ডিউটি ছিল।
রাকিব ভাবল, আতিককে ডাকা উচিত হবে কি না? একধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে সে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আস্তে করে ডাকল, আতিক!
দুই ডাকেই আতিক চোখ মেলল।
রাকিব কর্ডলেসটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, তোমার ফোন, ধরো।
আতিক ঘুম জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল, কে করেছে?
রাকিব একটু গম্ভীর গলায় বলল, জানি না।
আতিক হাত বাড়িয়ে কর্ডলেসটা নিল। ‘হ্যালো’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর চেহারায় হাসি হাসি একটা ভাব চলে এল। সে রাকিবের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে কৌতুকের হাসি হাসল।
রাকিব আরও গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল শুধু। (ক্রমশ)
...

মহিবুল আলম: গোল্ডকোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>