সীমারেখা টেনে কি হবে?

লেখিকা
লেখিকা

আমাদের বাসার সামনের রেস্তোরাঁটা যখন এক রাতে আগুনে পুড়ে গেল, আমরা দুজন তখন বসার ঘরে গল্প করছিলাম। মধ্য রাত। মাত্র হ্যালোইনের উৎসব শেষ হয়েছে। আমরা জেগে আছি খুব বিশাল ছাড় ও অল্প দামে অনেক অনেক চকলেট কিনব বলে। আর ভাবছি এখন বের হব, নাকি ভোরের আলো ফুটলেই দোকানে দৌড় লাগাব। দোকান তো ২৪ ঘণ্টাই খোলা। যেকোনো সময়ই যাওয়া যায়, কিন্তু ডিসকাউন্ট কখন থেকে দেবে তা নিয়েই আসল চিন্তা।

আমাদের বসার ঘর পেরিয়েই কাচের স্লাইডিং দরজা। এরপর কাঠের খোলা বারান্দা। গাঢ় খয়েরি রঙের এই বারান্দাটাকে দেখলে বাংলাদেশের বিষণ্ন বাদামি প্রজাপতির পাখার কথা মনে হয়। আরে ওই যে ঘরের মাঝে হুটহাট করে কিছু প্রজাপতি চলে আসে না বেরসিকের মতো, ম্যাড়ম্যাড়ে, একঘেয়ে রঙের। যেগুলোকে দেখতে একদম ভালো লাগে না, অমন আর কি। এই ম্যাড়ম্যাড়ে বারান্দাকে আনন্দময় করতে কম কসরত করিনি আমি। তিন পাশে ঝুলিয়েছি নানারকম নকশা করা উইন্ড চাইম। কিছু ফুলগাছ। বসার দুটা চেয়ার। কিছু শো–পিছ।
মাঝে মাঝে আমরা স্বামী-স্ত্রী সেখানে বসে চা পান করতে করতে গল্প করি। কোনো কোনো দিন খুব পোকা উঠলে সিগারেটও টানি। ও ধোঁয়া দিয়ে দুর্দান্ত রিং বানাতে পারে। আর আমি অনেক দূর পর্যন্ত ধোঁয়া ছুড়ে দিতে পারি। এই নিয়ে প্রায়ই দুজনে পাল্লা দিই। হাসাহাসি করি। সময়টাকে তখন সুখময় মনে হয়। সেদিন এমনই এক পোকা ওঠা রাত ছিল। ভাবছিলাম ঠান্ডা ঠান্ডা এই আবহাওয়ায় দুজন মিলে চা হাতে সিগারেট ফুঁকব নাকি? তারপর রাতটা কোনো একটা সিনেমা দেখে কাটিয়ে দেব। ভোর হলেই গাড়ি নিয়ে ছুটে যাব চকলেট কিনতে। সেই চকলেট নিয়ে মাসখানেক পর দেশে যাব। এখনো কত কিছু কেনা বাকি!

লেখিকা
লেখিকা

কিন্তু আমাদের পরিকল্পনামতো কিছুই হলো না। দৃশ্যটা প্রথম ও দেখেছিল। একটা ঘন সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী ধেয়ে আসছে আমাদের বারান্দার দিকে। যেন কোনো জিন কিংবা দানব কিংবা কোনো জীবন্ত মেঘ। ভেসে ভেসে এগিয়ে এসে হুট করে ঢুকে যাবে আমাদের ঘরে। তারপর গ্রাস করে নেবে আমাদের। আমরা কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর শুনলাম বেশ দূরে দমকল বাহিনীর তীব্র সাইরেন বাজছে। আমরা দ্রুত বারান্দায় চলে গেলাম। বিশালাকৃতির ধোঁয়ার আস্তরণ ততক্ষণে আমাদের চারপাশ ঢেকে ফেলেছে। কেমন যেন একটা পোড়া গন্ধও আছে সঙ্গে। ধোঁয়া এতই ভারী যে এক হাত দূরের কিছুও দেখা যাবে না।

আমরা দুজনেই মূর্তির মতো সেই ধোঁয়ায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। এবার শুনতে পেলাম পুলিশের গাড়ির সাইরেন। একাধিক গাড়ির তীব্র সাইরেনে চারপাশের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে গেল। ওপাশের এক রেস্তোরাঁয় আগুন লেগেছে। কমলা আগুনের লেলিহান শিখা আকাশের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে নাচের ভঙ্গিতে। মাত্র কয়েক মাস হয়েছিল রেস্তোরাঁটা খুলেছিল। মরক্কান রেস্তোরাঁ। আমরা সেখানে একবারই গিয়েছিলাম। খাবার খুব ভালো না লাগলেও পরিবেশ খুব নান্দনিক ছিল। কীভাবে পুড়ল? কোনো মানুষ নিশ্চয়ই এত রাতে ভেতরে ছিল না। ছিল কি? সবকিছুই কি এখন পুড়ে ছাই হয়ে গেল? মনে মনে এসবই ভাবতে থাকলাম।

কয়েক মিনিট কেটে যাওয়ার পর বারান্দা থেকে বসার ঘরে ফিরে এলাম। স্লাইডিং দরজাটা টেনে দিয়ে দুজনেই চুপচাপ বসে থাকলাম দীর্ঘক্ষণ। সুসংবাদ আমাদের যতটা সরব করে, দুঃসংবাদ বা দুর্ঘটনা তার চেয়েও যেন বেশি নীরব করে ফেলে। সেই নীরবতা আঁকড়ে ধরে আমরা দুজন মানুষ পাশাপাশি চুপচাপ বসে থাকলাম। টাইম ল্যাপসের মতো খুব দ্রুত ধোঁয়া কেটে যেতে শুরু করল। সাইরেন মিলিয়ে যেতে শুরু করল। রঙিন আলো কমে যেতে শুরু করল। সেই রাতে আমরা কেউই কেন যেন ঘুমাতে পারলাম না।

পরদিন ভোরে চকলেট কিনতে যাওয়ার সময় দেখলাম মরক্কান রেস্তোরাঁর পেছনের দেয়ালে খুব বড় করে লেখা ‘গো ব্যাক’ মানে ফিরে যাও। কে লিখল? কেন লিখল? অনেক ভেবেছি। অনেক। নিজের দেশে অন্য দেশের মানুষদের যারা ঘৃণা করে তারা? নাকি রেস্তোরাঁ ভালো চলছিল না বলে মালিক নিজেই রাতের অন্ধকারে আগুন ধরিয়ে গিয়েছে, যেন মোটা অঙ্কের ইনস্যুরেন্সের টাকা পায়। আর এমন দুটি ন্যক্কারজনক শব্দ লিখে গিয়েছে, যেন সন্দেহটা তার ওপর না গিয়ে সাম্প্রদায়িক মানুষদের ওপর গিয়ে পড়ে। নাকি আসলেই কে বা কারা সত্যি ইচ্ছাকৃতভাবে এমন ক্ষতি করে গিয়েছে? অনেক ভাবলাম অনেক। সদুত্তর পেলাম না।

আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের দেয়ালগুলো লাল ইটের তৈরি। দেয়ালের ওপাশে সারি ধরে চেরি ফুলের গাছ। সেই গাছে সকাল সকাল সেদিন পাখির রাজ্য বসেছিল। ডাকাডাকি করে মুখরিত করে ফেলেছিলও চারপাশ। আমাদের গাড়ি মূল রাস্তায় নামলে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে সেই দেয়ালের দিকে তাকালাম। সাদা দেয়ালে কালো রং দিয়ে লেখা ‘গো ব্যাক’। কাকে বলা হয়েছে? কাদেরকে? দেশ, শহর, গ্রাম, অরণ্য, লোকালয় আসলে কি? পুরো পৃথিবীই তো আমাদের। মানুষদের, পশুপাখির। এই সীমারেখা টেনে কি হবে? খুব বিশাল কিছু কি হবে? এই ভিনদেশে যখন ঝুম ঝুম বৃষ্টি নামে আমি তখন সেখানে যেন ঢাকার বৃষ্টির ঘ্রাণ খুঁজে পাই। এখানের লেকের পানিতে হঠাৎ যখন কোনো মাছ ঘাই দিয়ে ওঠে, আমার তখন গ্রামের বাড়ির শেওলা ধরা পুকুরের কথা মনে পড়ে। এমন কোথায় যাব যেখানে গেলে নিজের দেশকে একটু হলেও খুঁজে পাব না? এও কি সম্ভব? তাই পুরো পৃথিবীটাই আমাদের। আমাদের সবার। এটা তো পেস্ট্রি কেক বা পিৎজার কোনো অংশ নয় যে, মারামারি, কাটাকাটি করে খেয়ে নেব। তাহলে কেনই বা এত ঘৃণা, উপেক্ষা, দলাদলি আর বিনাশ? আমি ভেবে পাই না। শুধু নির্ঘুম চোখে একটা আকাশ খুঁজতে থাকি।

সকালের খোলা রাস্তায় আমাদের রুপালি রঙের গাড়ি চলতে থাকে দ্রুতগতিতে। আশপাশের নাম না জানা গাছগুলো আসি আসি শীতের আবহাওয়ায় যেন আরও বেশি ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। এরই মাঝে হঠাৎ এক টুকরা রোদ উঠে আলো ছড়াতে থাকে। সেই আলো দেখে আনন্দে নাম না জানা কত শত পাখিরা ডাকাডাকি করে। আচ্ছা, কেউ কি জানেন আমরা কেন মানুষ হলাম? এর চেয়ে বরং পাখিই হতাম। কেউ কখনো কাউকে ফিরে যেতে বলত না। পুরো আকাশটাই আমাদের থাকত...।

মাহরীন ফেরদৌস: ক্যানসাস, যুক্তরাষ্ট্র।