মেঘ রোদ্দুরের খেলা-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রাকিবের সঙ্গে আতিকের পরিচয় হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। মতি ভাইয়ের বাসায়। অকল্যান্ডে। মতি ভাই পরোপকারী মানুষ। নিউজিল্যান্ডে কোনো বাঙালি সমস্যায় পড়লে তিনি সবার আগে গিয়ে উপস্থিত হন। হোক তা এক শ কিলোমিটার দূরে কিংবা এক কিলোমিটার দূরে।

রাকিব তখন অকল্যান্ডে। থাকত একটা বোর্ডিং হাউসে, জাকারান্ডা লজে। এক সকালে সে তার স্ত্রী এমেন্ডার ব্যাপারটা নিয়ে মতি ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে গিয়েছিল। তখনো ওদের ডিভোর্স হয়নি, সেপারেশন চলছিল। কীভাবে ডিভোর্স নেওয়া যায়? কোর্টে যাবে নাকি আপসে ডিভোর্স লেটার সাইন করবে? ওদের মেয়েরই বা কি গতি হবে?
ওদের একটাই মাত্র মেয়ে ছিল। দেড় বছরের। সবাই সাদিয়া ডাকলেও রাকিব তাকে আদর করে ডাকত, বুড়ি।
মতি ভাইয়ের সঙ্গে ওসব ব্যাপারে আলাপ-আলোচনার ঠিক মাঝখানে আতিক এসে হাজির হয়েছিল।
আতিক এসেছিল তাওরাঙা সিটি থেকে। সেও মতি ভাইয়ের কাছে নিজস্ব এক সমস্যা নিয়ে এসেছিল।-সে বিয়ে করতে চায়। কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ বা কাগজের বিয়ে। ঘরোয়া ভাষায় যাকে বলে মালের জন্য বিয়ে। নিউজিল্যান্ডের নাগরিকত্বকে এখানকার বাঙালিরা ঘরোয়া ভাষায় ‘মাল’ বলে। পরে রাকিব দেখেছে, এই মাল শব্দটা শুধু বাঙালিরাই নয়, ভারত থেকে আসা মানুষজন বা পাকিস্তানিরাও ব্যবহার করে।
এই কাগজের বিয়ের জন্য আতিক বিশ-পঁচিশ হাজার ডলার খরচ করতে রাজি। একটা যেনতেন মেয়ে হলেই হয়। তার তখনো নিউজিল্যান্ডের নাগরিকত্ব হয়নি। তখনো নিউজিল্যান্ডের ইমিগ্রেশনে একটা বানানো কেস করে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছিল।
অবশ্য পরে আতিককে নিউজিল্যান্ডের নাগরিকত্বের জন্য কাগজের বিয়ে করতে হয়নি। অকল্যান্ডে বসবাসের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সে কুইন্স স্ট্রিটের একটা নাইট ক্লাবে মদ্যপান করে নাচতে গিয়ে ভ্যাবিয়ান নামে এক ইউরোপিয়ান নারীর সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয় পর্বের পর পটিয়ে বন্ধুত্বের নাম করে মাস কয়েক একই ছাদের নিচে বসবাস করে। তারপর এক বিকেলে মতি ভাই, তাঁর পরিবার, তাওরাঙ্গার আলী হায়দার ভাই ও ভ্যাবিয়ানের পক্ষের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, দু-চারজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে গির্জায় ধর্মযাজকের সামনে ওদের বিয়ে হয়। রাকিবও সেই বিয়েতে অংশগ্রহণ করেছিল।
বিয়ের পর ওদের আড়াই বছরের সংসার।
আতিক-ভ্যাবিয়ানের এই আড়াই বছরের সংসার জীবনে রাকিব বেশ কয়েকবারই ওদের সান্নিধ্য পেয়েছিল এবং বিভিন্ন বিষয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত হয়েছিল। ওদের সুখদুঃখ, যাপিত জীবন ও ভালোবাসায়।
রাকিব অকল্যান্ডে আট মাস ছিল। তারপর সে হ্যামিল্টনে চলে আসে। হ্যামিল্টন এসেও ওদের সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশ গভীর ছিল। অকল্যান্ডে গেলে সে ওদের বাসায় থাকত। রাতভর গল্প করত। গাড়ি নিয়ে মাউন্ট ইডেনের চূড়ায় চলে যেত। ভ্যাবিয়ান বাংলা ভাষা না বুঝেও তাকে কবিতা আবৃত্তি করতে অনুরোধ করত। সে অনুরোধ রক্ষা করত। আতিক হাসত। ওদের সান্নিধ্য তাকে সুখ দিত, আনন্দ দিত। কারণ তার মনে তখন এমেন্ডার কাছ থেকে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ও তার কন্যা সাদিয়াকে নিয়ে প্রচণ্ড ঝড়।
ওদিকে ভ্যাবিয়ান ও আতিকের মধ্যে ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। বিশেষ করে ভ্যাবিয়ান আতিককে সত্যি প্রচণ্ড ভালোবাসত। সে তার ছোটখাটো বিষয়গুলোর দিকেও বেশ খেয়াল রাখত। আর কত স্বপ্নের কথা বলত! সংসার, জীবনযাপন, নিজেদের ভবিষ্যৎ, এমনকি বাংলাদেশ নিয়ে সে স্বপ্ন দেখত!
ভ্যাবিয়ান ছিল আতিকের চেয়ে ছয় বছরের বড়। তখন সে ত্রিশের কোঠায়, আতিকের চব্বিশ কী পঁচিশ। নিউজিল্যান্ডের মেয়েরা যখন ত্রিশের ঘরে পড়ে, তখন ওরা আর এ ঘর-ও ঘর করে না। সংসারী হতে চায়। আজীবনের জন্য ঘর বাঁধতে চায়।
আতিককে বিয়ে করে ভ্যাবিয়ান তাই চেয়েছিল।
কিন্তু আতিকের মনে ছিল অন্য কিছু। নিউজিল্যান্ডের মাল বা নাগরিকত্ব। তাই পরবর্তীতে তার যখন নিউজিল্যান্ডের নাগরিকত্ব হয়ে যায়, তখন সে ভ্যাবিয়ানের সামনে আসল চেহারা প্রকাশ করে। অযথাই ঝগড়াঝাঁটি, খুনসুটি বাঁধাতে শুরু করে। কথায় কথায় খুঁত ধরা। অযথাই বয়সের কথা তুলে অপমান করা। সংসার খরচ নিয়ে ঝগড়া টেনে আনা।
নিউজিল্যান্ডের নাগরিকত্বের পর ওদের সংসার মাত্র চার-পাঁচ মাস টেকে। একদিন মদ খেয়ে সারা রাত নাইটক্লাবে নেচে ভোরে এসে অযথাই ঝগড়া বাঁধায়। সেদিন বিকেলেই সে বাসা ছেড়ে গাড়ি নিয়ে সরাসরি তাওরাঙ্গা শহরের উদ্দেশে পাড়ি জমায়। সেখানে আলী হায়দার ভাইয়ের মাধ্যমে একটা কিউই ফ্রুট ফার্মে কাজ জুটিয়ে এক বছরের মতো থাকে। তারপর আতিক হ্যামিল্টন চলে আসে।
হ্যামিল্টন এসে অবশ্য আতিক সরাসরি রাকিবের বাসায় ওঠেনি। তার এক পূর্ব পরিচিত ফিজিয়ান-ইন্ডিয়ানের বাসায় দুই মাসের মতো থাকে। ওই বাসায় বোর্ডার হিসেবে থাকতে গিয়ে আতিক সেই ফিজিয়ান-ইন্ডিয়ানের স্ত্রীর সঙ্গে কী একটা ঝামেলা বাধিয়ে বসে। এক বিকেলে আতিক উপায়ান্ত না পেয়ে রাকিবের ম্যাকফার্নেল স্ট্রিটের এই বাসায় এসে ওঠে।
রাকিবের এই বাসায় আতিকের প্রায় এক বছর হয়ে এল।
রাকিবদের বাসা দুই বেডরুমের। একটা লম্বা লিভিং রুম কাম ডাইনিং। পাশেই ছোট্ট কিচেন। বেডরুম দুটি পরপর। তারপর বাথরুম ও টয়লেট।
আতিকের রুম থেকে বের হয়ে রাকিব টয়লেটে ঢুকল। টয়লেটে বসেই তার চোখ পড়ল টয়লেট টিস্যু রুলের অর্ধেকটা টিস্যু হোল্ডারে ঝুলছে। এ ছাড়া আর কোনো টয়লেট রুলের অবশিষ্ট নেই।
টয়লেট টিস্যু রুলের দিকে তাকিয়ে রাকিবের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। কাল থেকেই তার মেজাজ একটু একটু করে খারাপ হচ্ছে। গতরাতে রিয়েল টু সিনেমা থেকে বাসায় ফিরে দেখে, চুলায় রান্না বলতে কিছু নেই। ফ্রাইপ্যান-সসপেন সব উপুড় করা।
গতকাল আতিকের রান্না করার কথা ছিল। এমনকি সুপার মার্কেট থেকে বাজার করারও।
গত দেড় সপ্তাহ ধরে সে সুপার মার্কেটে যায় না। রাকিব তাকে প্রায় প্রতিদিনই বলছে। কিন্তু সে কোনো গা করছে না! আগের মাসের পুরোটাই রাকিব বাজার করেছে। এ মাসের প্রথম সপ্তাহেও অনেকটা বাধ্য হয়ে করেছে। কিন্তু আর কত?
দুই সপ্তাহ ধরে সুপার মার্কেটে যাওয়া হয়নি বলে ফ্রিজ প্রায় খালি। শেলফে ওইডবিক্স, কর্নফ্লেক্স বা রাইস সিরিয়াল কিছুই নেই। শুধু নিচের শেলফে কয়েকটা টুনা মাছের ক্যান এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে।
রাকিব ভাবল, বাসার সব দায়িত্ব যেন তারই। ইলেকট্রিসিটি বিল, টেলিফোন বিল, ইন্টারনেট বিল, বাজার করা, বাসা পরিষ্কার করা, সপ্তাহের পর সপ্তাহ একাই রান্না করা! ধ্যাত! টয়লেট ফ্লাশ করতে করতে সে নিজে নিজেই অস্ফুট উচ্চারণ করল। ভাবল, কার ওপর সে বিরক্ত হবে? সেই আতিক? যে এক শ বার ভুল করে এক শ বার ক্ষমা চায়?
রাকিব টয়লেট থেকে বের হয়ে বাথরুমে ঢুকল। টুথব্রাশে পেস্ট নিতে নিতে বেসিনের পাশের আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখল। বামগালের এক পাশে একটা ব্রণের মতো কী যেন উঠেছে। এটা কি ব্রণ না কি পোকার কামড়? ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। ভাবল, এই একত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সে কীসের ব্রণ? কাল বিকেলেই বের হওয়ার আগে দাড়িগোঁফ কামিয়ে গেছে। কিন্তু এক রাতেই কেমন ছোট ছোট খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফ গজিয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে দুই-তিনটা আবার সাদা। জুলফিতেও বেশ কয়েকটা চুল পেকেছে। বংশের তাছির। তাদের কাজী বাড়িতে অল্প বয়সেই চুল পাকে।
রাকিব নিজে নিজে আবার বয়সটা হিসাব করল। এ্ই তো গত জানুয়ারিতে একত্রিশ পেরিয়ে বত্রিশে পড়েছে। বত্রিশ বছর! এরই মধ্যে যে বিদেশের মাটিতে দশটা বছর চলে গেছে!
রাকিব আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে থেকেও খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে দাঁত ঘষতে শুরু করল। ঘচ ঘচ ফ্যাচ ফ্যাচ, ঘচ ঘচ। দুই ঠোঁটের মাঝে জেল টুথপেস্টের ফেনা মুখ ভর্তি করে উঠেছে। সাদা ফেনা, সরু সরু সবুজাভ রেখা। রাকিব টুথপেস্টের ফেনাটা বেসিনে ফেলে আবার আয়নায় দৃষ্টি ফেলল। ভাবল, দশটা বছর! সেই বাইশ বছর বয়সে দেশ ছাড়ে! সবে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স পরীক্ষাটা দিয়েছিল। ফলাফলের অপেক্ষায়। কিন্তু সে অনার্সের ফল পায় নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বসে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে রাকিব তার বড় চাচার বাসায় থাকত। বড় চাচা সরকারি চাকরি করতেন। তখন সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গোছের ছিলেন। এই মন্ত্রণালয়েই অনেক দিন চাকরি করেছেন। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় বলে কথা! স্থাপন-অস্থাপন করে দুই হাতে শুধু টাকা আর টাকা বানিয়েছিলেন! ধানমন্ডির পাশে নর্থ রোডে বেশ বড় আলিশান বাড়ি। নামে-বেনামে ব্যাংক ব্যালেন্স, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এখানে-সেখানে প্লট ও ফ্ল্যাট, চাঁদনিচক ও মিরপুর মার্কেটে দুটো করে দোকান!
বড় চাচার একমাত্র ছেলের নাম ছিল নাদিম। রাকিবের প্রায় সমবয়সী। তবে কয়েক মাসের ছোট ছিল। বড় চাচার দুই মেয়ের পর এই ছেলে। মেয়ে দুজন স্বামীসহ দেশের বাইরে থাকত। একজন সাউথ আফ্রিকায়। স্বামী ডাক্তার। অন্যজন আমেরিকার আটলান্টায়। স্বামী কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি. করে আটলান্টায় একটা টেলি-কমিউনিকেশন সংস্থার গবেষক হিসেবে কাজ করতেন। মেয়ে দুজনকেও উচ্চশিক্ষিত বলা যায়।
কিন্তু ছেলে নাদিম। একমাত্র ছেলে বলে অতিরিক্ত আহ্লাদে-আদরে বেশ লাগামছাড়া হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে ছেলের প্রতি বড় চাচির আহ্লাদটাই বেশি ছিল। ফলে যা হওয়ার তাই হয়। নাদিমের লেখাপড়ায় একেবারেই গোল্লা যায়। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কোনোমতে পাস করতে পারলেও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি। পরে অনেক টাকা খরচ করে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট কোর্সে আমেরিকার আটলান্টায় পাঠানো হয়। কিন্তু এক বছরের মাথায় সে ফিরে আসে। পরে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি করানো হয়। কিন্তু ওখানেও সে লেখাপড়া চালিয়ে যায়নি। পরে উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেদের মতো সারা দিন পাড়ার মাস্তানদের সঙ্গে টো টো করে ঘুরত। আর কী সব আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি-টার্টি করত। রাতে-মাঝরাতে মদ-গাঁজা টেনে, মাঝেমধ্যে ড্রাগ-ট্রাগ নিয়ে নেশা করে বাসায় ফিরত।
রাকিবের সঙ্গে নাদিমের সম্পর্ক অবশ্য বেশ ভালো ছিল। তাকে রাঙা ভাই বলে ডাকত। নাদিম তাকে কেন রাঙা ভাই ডাকত, সে তা জানে না। এক-দুবার জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পায়নি বলে পরে আর জিজ্ঞেস করেনি। হয়তো তার ভালো লাগত বলে এই নামে ডাকত।
নাদিম মাঝরাতে যখন নেশা করে বাসায় ফিরত তখন বড় চাচার ভয়ে রাকিবের রুমে এসে ঢুকত। বেশির ভাগ সময়ই ক্ষুধার্ত থাকত। রাকিব তাই তার জন্য কৌটায় বা বয়ামে বিস্কুট-চানাচুর জাতীয় খাবার রেখে দিত। মাঝেমধ্যে পরোটা-মাংস কিংবা নীলক্ষেত থেকে মোগলাই এনে রাখত।
নাদিম এসব খেতে খেতে বা চানাচুর চিবোতে চিবোতে পা দুলিয়ে আবদার করত, রাঙা ভাই, একটা কবিতা আবৃত্তি করো না, প্লিজ! ওই যে।
—কখনো কী দেখেছ সোনালি সূর্যের একাকী মগ্নতা
ভালোবাসার কাঁকর বিছিয়ে যত সব হৃদয়ের কথা ভাবে
জীবনের কোনো জটিলতা নেই
আছে শুধু আগুন!...
কিন্তু রাকিব জানে না, নাদিমের বুকে কীসের আগুন ছিল? নাকি সে আগুন নিয়ে বিলাসিতা করত? তাকে নেশা নামক আগুনের সেই আসক্তি কেন পেয়ে বসেছিল?
নাদিমের সঙ্গে রাকিবের যেমন খুব ভালো একটা সম্পর্কটা ছিল, কিন্তু এর ঠিক উল্টোটা ঘটেছিল বড় চাচির সঙ্গে। বড় চাচি এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্রী ছিলেন। এমএ পাস করে কিছুদিন ঢাকার কোনো একটা কলেজেও পড়িয়েছেন। বড় চাচার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর তিনি কলেজের চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। প্রথম জীবনে বড় চাচার ছিল বদলির চাকরি। বড় চাচার সঙ্গে বড় চাচিকেও বিভিন্ন থানা ও জেলায় ঘুরতে হয়েছে।
বড় চাচির সঙ্গে রাকিবের তিক্ততার প্রধান কারণ তাদের বাসায় থাকা নিয়ে। তিনি প্রথম থেকেই তাকে কেমন সহ্য করতে পারতেন না। এই সহ্য না করার আরেকটা প্রধান কারণ ছিল সে খুব ভালো ছাত্র ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়াটা তার চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অথচ তার নিজের ছেলে নাদিম ছিল যাচ্ছেতাই ধরনের।
বড় চাচি মাঝেমধ্যে এমন সব আচরণ করতেন, রাকিব তা ভেবে পেত না! এমন একজন উচ্চশিক্ষিতা মানুষ এত নিচু-নোংরা আচরণ কীভাবে করতেন? অনেক সময় চাকর-বাকরদের সামনেও জঘন্য আচরণ করতে ছাড়তেন না। কিন্তু সে মুখ বুজে তা সহ্য করত। সহ্য করা ছাড়া তার উপায়ও ছিল না। কারণ জন্মের পর থেকেই সে কারও না কারও বোঝা হয়ে বেড়ে উঠেছে। একবার-দুবার যে বড় চাচার বাসা ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয় হলে উঠে যাওয়ার চিন্তা করেনি, তা নয়। টিউশনি করে লেখাপড়াটা ঠিকই চালিয়ে নিতে পারত। কিন্তু বড় চাচার দিকে তাকিয়ে পারেনি।
বড় চাচির মানসিক অত্যাচারের সীমা একসময় বড় চাচার ওপরও প্রভাব বিস্তার করে। রাকিবের তখন অনার্স পরীক্ষা শেষ। এক সন্ধ্যায় বড় চাচা অফিস থেকে বাসায় ফিরে সরাসরি তার রুমে আসেন। কোনো ভূমিকা না করেই তিনি তাকে একটা প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবটা হলো; তার অফিসের এক অধীনস্থ সহকারী সচিবের ভায়রা বিদেশে লোক পাঠান। তিনি সেই ভদ্রলোককে বলে তার জন্য বিদেশ যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করেছেন।
বড় চাচা সচরাচর রাকিবের সঙ্গে খুব গম্ভীর হয়ে মেপে মেপে কথা বলতেন। পরিবেশ কেমন গম্ভীর হয়য়ে যেত। কিন্তু সেদিন তিনি কথা বলছিলেন খুব সহজভাবে। একসঙ্গে তিনি অনেকগুলো কথা বলেছিলেন। তার কথাগুলো যে একেবারে অযৌক্তিক ছিল, তা নয়। কিন্তু পুরোপুরি যৌক্তিকও বলা যাচ্ছিল না।
রাকিব সরাসরি তার দিকে তাকিয়েছিল। তার যে বিদেশ সম্বন্ধে কৌতূহল ছিল না, তা নয়। কিন্তু লেখাপড়া শেষ না করে এ পর্যায়ে বিদেশে যাওয়া?
রাকিব আস্তে করে জিজ্ঞেস করেছিল, কোথায়?
বড় চাচা দৃষ্টি ওঠানামা করে বলেন, নিউজিল্যান্ড।
নিউজিল্যান্ড! রাকিব অস্ফুট স্বরে বলে। নিউজিল্যান্ড দেশটা সম্বন্ধে তার পূর্বে থেকেই ভালো ধারণা ছিল। পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের একেবারে দক্ষিণের দেশ। এরপরই অ্যান্টার্কটিকা। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের ভেতর দুটি প্রধান দ্বীপ নিয়ে দেশটা। এ ছাড়া আরও ছোট ছোট দুই-চারটা দ্বীপ আছে। ক্রিকেট তার প্রিয় খেলা। সেই ক্রিকেটের জন্যই সে দেশটাকে ভালো করে জানত।
বড় চাচা বলেন, হ্যাঁ, খুব সুন্দর দেশ নাকি!
রাকিব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, আমি জানি। কিন্তু আমার লেখাপড়া?
—লেখাপড়া?
—জি, অনার্স পরীক্ষা সবে শেষ হলো। রেজাল্টও বের হয়নি।
—লেখাপড়া যা করার তো করেছই। বাকি লেখাপড়া সুযোগ পেলে নিউজিল্যান্ডে গিয়ে করবে।
—মাস্টার্সটা শেষ করে যাই?
বড় চাচার দৃষ্টিতে তৎক্ষণাৎ তাচ্ছিল্য ভাব ফুটে ওঠে। বলেন, আরে শোনো, এ দেশের এমন অনার্স-মাস্টার্স সার্টিফিকেট দিয়ে কি করবে? যেখানে হাজার হাজার অনার্স-মাস্টার্স বেকার বসে আছে? তুমি কি জানো, একটা নিম্নপদস্থ কেরানি পোস্টের জন্য আমাদের সময় এইট-নাইন পাস অ্যাপ্লিকেন্ট অ্যাপ্লাই করত। কিন্তু আজ অসংখ্য অনার্স-মাস্টার্স সেই পোস্টের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
রাকিব একটু চুপ হয়ে থেকে বলে, তবুও!
বড় চাচা একটু চুপ হয়ে থেকে মাথা নেড়ে বলেন, শোনো রাকিব, আমি তোমাকে প্রস্তাবটা দিলাম। তুমি ভেবে দেখ। আমার মনে হয় প্রস্তাবটা তোমার সিরিয়াসলি নেওয়া উচিত। ভবিষ্যতে হয়তো এমন প্রস্তাব নাও আসতে পারে। এমনিতেই আমার বয়স হয়েছে। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। আমার ফুল সেক্রেটারি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। গভর্নমেন্ট চেঞ্জ হলেই আমাকে যেকোনো সময় রিটায়ারমেন্টে চলে যেতে হবে। হয়তো তখন আমি তোমার লায়াবিলিটি বা রেসপনসিবিলিটি নাও নিতে পারি!
রেসপনসিবিলিটি!...লায়াবিলিটি!-রাকিব শব্দ দুটির কথা ভেবে মাথা নাড়ল। দুই ঠোঁটের ফাঁকে টুথপেস্টের ফেনা অনেক জমা হয়েছে। সে গলা কেশে চিড়িৎ করে বেসিনে ফেনা ফেলতে ফেলতে ভাবল, তার নিজের ছেলে নাদিমের রেসপনসিবিলিটি কে নেবে? যে সকাল-দুপুর, সন্ধ্যা-রাত নেশার ওপর থাকত?
রেজাল্ট বের হওয়ার পর রাকিব জানতে পারে সে অনার্স ফাইনালে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে! ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড। কিন্তু তত দিনে সে নিউজিল্যান্ডে।
তোয়ালায় মুখ মুছতে মুছতে রাকিব বাথরুম থেকে বের হয়ে ভাবল, বোঝা! সত্যি সে বোঝা। এখন জীবন নামক বোঝাটাই সে আদিগন্তে টেনে চলছে।
বড় চাচা এখন আর বেঁচে নেই। বছর দু-এক আগে ব্রেন স্ট্রোক করে মারা গেছেন। কিন্তু তিনি মৃত্যুর সময় একদঙ্গল কষ্ট নিয়ে গেছেন। নাদিম মারা যায় বড় চাচার মৃত্যুর তিন বছর আগে। ড্রাগের নেশা তার শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছিল। শেষের দিকে চিকিৎসার জন্য তাকে দেশের বাইরেও পাঠানো হয়েছিল।
একদিকে নিজের বিশাল সম্পত্তি। নর্থ রোড ছাড়াও বনশ্রীতে আলিশান সাততলা বাড়ি। অন্যদিকে একমাত্র ছেলে নাদিমকে মৃত্যুর ছোবল থেকে রক্ষা করতে না পারা। বড় চাচা ছেলের শোক সহ্য করতে না পেরে কিছুদিন পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর থেকে তিনি রাকিবকে ঘন ঘন বাংলাদেশ থেকে ফোন করতেন। দীর্ঘক্ষণ কথা বলতেন। একই কথা বারবার ঘুরেফিরে বলতেন। মাঝে মধ্যে অযথাই ফিস্ফিস করতেন। কথায় কথায় বড় চাচির খুব বদনাম করতেন। আর অকারণেই নিজে নিজে শুধু কাঁদতেন।
এক সন্ধ্যায় অস্ট্রেলিয়া থেকে ছোট ফুফুর ফোন আসে, বড় চাচা আর নেই। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>