নিশ্বাসের সঙ্গে চলে বাতাসের কথা

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

জুন মাস। সূর্য ওঠার পর পরই গরম হতে থাকে মরু-বাতাস। দুপুরবেলার বাতাস গায়ে লাগলে মনে হবে দগদগে আগুনে আঁচ লাগছে গায়ে। যেন চামড়া পুড়ে যাবে এখনই। আর মরুভূমির বালুঝড় শুরু হলে চারদিক অন্ধকার হয়ে থাকে। রাতের চেয়েও ভয়াবহ অন্ধকার। বালুতে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ক্যারাভানের মধ্যেও নাকেমুখে মাস্ক পড়ে থাকতে হয়। শুধু বালু আর বালু। বিছানা-কম্বল, জামা-কাপড়, এমনকি ভাত-তরকারীও বাদ যায় না বালুর উপদ্রব থেকে। বালুঝড় শুরু হলে বার-বার পানি খেতে থাকে অনেকেই। বালু যেন প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। কেউ আবার কলা খেতে থাকে ধুলোবালি ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য।

এ বছর জুন মাসে রোজা। কাজের সময় পরিবর্তন হয়েছে। রোজায় কাজ করতে হবে-সকাল ছয়টা থেকে বেলা বারোটা পর্যন্ত। কিন্তু সকাল আটটার পর রোদের তাপ ভয়ানক বাড়তে থাকে। দুপুরের মধ্যে পঞ্চাশ ডিগ্রি, মনে হয় আগুনে কুণ্ডলীর মধ্যে কাজ করছে। কোথায়ও নেই এক বিন্দু ছায়া। মরুভূমির মধ্যেই গড়ে উঠছে তানিয়া ওয়াটারের বিশাল প্রজেক্ট। কর্মীদের থাকার জন্য বেশ কতগুলো এসি লাগানো ক্যারাভান আনা হয়েছে। দুপুর রোদে ক্যারাভানগুলো আগুন গরম হয়ে থাকে। এসি চালিয়ে রাখতে হয় সব সময়।
রাজধানী রিয়াদ থেকে তাবুকের এই প্রজেক্টে কাজে এসেছে পলাশ, জিতু, রহমান আর হাফিজ। রিয়াদের অবস্থা ভয়ানক খারাপ। কোনো কাজ নেই। কাজ পেলেও বেতন পাওয়া যায় না।
আজ সকাল দশটার দিকে পানি খেয়ে রোজা ছেড়েছে কয়েকজন। এই কড়া রোদে কাজ করে রোজা থাকা সম্ভব হয় না। বুকের ভেতরে থেকে সব শুকিয়ে আসে। ঢোক গেলা যায় না। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যায়।
এই কষ্ট মেনে নিয়েও আবার রোজা রাখছে অনেকেই। কাজের মধ্যেই বারবার পানি দিয়ে নিজেকে ভিজিয়ে নিতে থাকে। ভেজা কাপড়ে গরম বাতাস লাগলে শরীর বরফ ঠান্ডা হয়ে যায়।
জিতুও আজ রোজা ছিল। কাজ শেষে এসে এক ঘুমে পার করেছে দুপুরটা। মাগরিবের আজানের পর ইফতার শেষ করে বাইরে এসে দাঁড়ায় জিতু।
সন্ধ্যার মরুভূমিতে অদ্ভুত এক সৌন্দর্য আছে। সূর্যটা ডুবে যেতে যেতে লাল আলো নেতিয়ে পড়ে দূরের বালু মাঠে। তখন পৃথিবীকে শূন্য মনে হয়। মরুভূমিকে মনে হয় ছলনাময়ী নারী। প্রেম দেবে বলে বুক ভেঙে দেয়।
এ সময় পলাশ এসে দাঁড়ায় জিতুর পাশে। মলিন মুখে পলাশের দিকে তাকায় জিতু। পলাশ বলে, মন খারাপ ক্যান?
সামান্য হাসে জিতু। বলে, এমনিই, কিছু না।
—বাড়িতে টাকা পাঠাইছ?
—পাঁচ মাস কোনো বেতন পাই না। রিয়াদে বেতন চালু থাকলে এই কষ্ট করতে কেউ তাবুকে আসে।
—টাকা লাগবে?
—আপনার কাছে আছে ভাই?
—আছে, কত লাগবে।
—তিন হাজার রিয়াল দিলেই হবে। দেশে পাঠাব। বাঁচালেন ভাই। মাথা ঠিক নাই। সামনের সপ্তাহে ঈদ। বাড়িতে টাকা না পাঠাইলে ঈদই করতে পারবে না।
—ঠিক আছে। কালকেই টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেবানে। কিন্তু আমরা ঈদে কি করব?
—এই বার কিছু হবে না ভাই। এখান থেকে রিয়াদ যাইতে দুই দিন লাগবে। অত সময় নাই। মরুভূমিতেই ঈদ করব এবার।
—হ, ক্যাম্পে অনেকেই আছে। নাকি মক্কা যাবা?
—গেলে তো ভালোই হইতো। কিন্তু প্রজেক্ট থেকে কি কোনো ব্যবস্থা করতে পারবে ভাই?
—দেখি কী করা যায়। প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে আলাপ করে দেখি।
—ইঞ্জিনিয়ার তো ইজিপশিয়ান, মনে হয় না কথা মানবে।
—সবাই একসঙ্গে বললে ফেলতে পারবে না। ঈদের ব্যাপার...।
—এখান থেকে মক্কা কত দূর?
—এক হাজার কিলোমিটারের ওপরে।
—দশ ঘণ্টা লাগবে। দুই দিন হোটেলে থাকব, তারপর আবার ফিরে আসব।
—খুবই ভালো হয় ভাই। এই মরুভূমির মধ্যে ঈদের দিন মন খুবই খারাপ হয়ে থাকবে।
ওদের কথা শেষ হওয়ার আগেই ফিলিপাইনের রিকি এসে দাঁড়ায় ওদের পাশে। রিকি খুবই ভালো ইলেকট্রিক্যাল কাজ জানে। ওদের দেশে কর্মমুখী শিক্ষা দেওয়া হয়। দেশ থেকেই ওরা টেকনিশিয়ান হয়ে আসে। আর বাংলাদেশের মানুষ সব অদক্ষ থেকেই এখানে আসে। এখানে এসে দক্ষ হয়।
রিকি জিজ্ঞেস করে, হোয়াট আর ইউ ডুইং হিয়ার?
সামান্য হেসে জিতু উত্তর দেয়, নাথিং।
—ইউ আর ক্রায়িং!
—নো নো...রিকিকে এড়িয়ে যেতে থাকে জিতু। কিন্তু রিকি সান্ত্বনা দিয়ে অনেক কথা বলে—বুঝতে পেরেছি, সামনে তোমাদের ঈদ। ফেস্টিভ্যালে দেশে যেতে পারছ না, বাবা মার জন্য মন খারাপ। কিছুই কারার নেই। আমাদের জীবন তো রকমই-শুধু কম্প্রোমাইজ করতে হবে।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

দুই.

সিগারেট জ্বালিয়ে রিকি আর পলাশ সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। একা দাঁড়িয়ে থাকে জিতু। কোথায়ও কোনো শব্দ নেই। অসহ্য নীরবতা। বুকের ভেতর কেমন যেন করে ওঠে জিতুর। সন্ধ্যার শেষ আলো বড় অদ্ভুত, সবাইকে ছেড়ে একা এই প্রবাস জীবনের কষ্ট উসকে দিতে থাকে।
নিঃশব্দতার শব্দ অতি ভয়ংকর। কানে আঘাত লাগে না ঠিকই, কিন্তু অন্তর তছনছ করে দেয়।
কদিন পরেই ঈদ। কত কি মনে পড়ে যায় জিতুর। সিগারেট বাজি আর চকলেট বোম কিনতে ট্রলার করে যেতে হতো ফরাজি হাটে। তারাবাজি বিক্রি হতো গলির মুদি দোকানগুলোতেই। এর জন্য পুলিশেরও কোনো হাঙ্গামা ছিল না। কিন্তু সিগারেট বাজি অথবা চকলেট বোমসহ পুলিশের হাতে ধরে খেলে সোজা হাজতে যেতে হতো। একবার মামুন ধরা খেয়েছিল বাজিসহ। গোটা চাঁদ রাতটাই কেটেছিল হাজতে। সবাই ভেবেছিল ওর ঈদও কাটবে হাজতের মধ্যে। কিন্তু ঈদের দিন খুব সকালবেলা মামুন ফিরে এল।
ওর দিকে তাকিয়ে ছিল সবাই। যেন ভূত দেখছে। মুহূর্তের মধ্যই উঠানে মানুষের ভিড় জমে গেল। অত লোক দেখে খুব মজা পাচ্ছে মানুষ। বীরের ভঙ্গিতে বলতে থাকে, ‘আমারে কিছুই কয় নাই। রাইতভর মরিচা বাজি ফুটাইছি থানার বারান্দায়। প্রথম তো খুবই ভয় পাইছিলাম। তারপর একজন পুলিশ আইয়া কয়-তোমার কাছে মরিচা বাজি আছে না? মরিচা বাজি ফুটাও। ওতে শব্দ নাই। খালি স্যাঁতস্যাঁত করে, দেখতে ভালো লাগে।’
সবাই এক সঙ্গে হেসে উঠেছিল মামুনের কথা শুনে। কত সরল ছিল মামুন। ওই সরল মুখ কোনো দিন আর দেখা হবে না। শেষ বারের মতোও ওর মুখটি দেখতে পারেনি জিতু। অথচ দুজন ছিল প্রাণের বন্ধু। প্রবাস জীবন থেকে সব কেড়ে নিচ্ছে একটু একটু করে।
এক সময় নেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল মামুন। প্রথমে গাঁজা, তারপর ইয়াবা ধরেছিল। আর ছাড়তে পারেনি। কোনো কাজেও মন দিতে পারেনি। লিভার ধরে গিয়েছিল। নেশা করত, তাই ওর দিকে কারও খেয়াল ছিল না। বকা, লাথি খেত সব সময়। একেবারেই শেষ সময় ধরা পেড়েছিল। তত দিনে মামুনের জীবনের আলোটুকু ফুরিয়ে গেছে।
বিদেশে আসার সময় তাঁকে মামুন বলেছিল—‘আর বুঝি তোর লগে দেখা হবে না জিতু! বুঝি নাই রে, মার কথা না শুনলে জীবনে সুখ হয় না।’
শব্দ করে কেঁদে ওঠে জিতু। মরু বাতাসের গায়ে ভেসে হয়তো অচেনা কোনো শহরে চলে যায় কষ্টগুলো। সেখানে হয়তো কেউ বুঝবে না জিতুর মনের কষ্ট। কেউ জানবে না-কত কষ্ট, অত অভিমান, কত কন্নায় দিন যায়, সব ছেড়ে ছুড়ে আসা এই সব মানুষগুলোর।
কেউ কি বুঝবে কোনো দিন? কেউ কি ভালোবেসে একবার বলবে, তোমরা সংসার আর দেশের জন্য অনেক করেছ, তোমাদের আমরা ভালোবাসি। এইটুকুই তো চাওয়া।
বুকের ভেতর অবুঝ জলের খনি। কোনো ভাবেই বোঝানো যায় না। কোথা থেকে আসে এত কান্না? দেশের জন্য মনটা এমন করে কেন? কেমন আছেন আম্মা? কত দিন আম্মার আঁচল থেকে টাকা চুরি করে নিয়ে গেছি। কিছুই বলতেন না আম্মা। রাগ হতে গিয়ে হেসে দিয়ে বলতেন, তোর জন্য তো টাকার গাছ লাগতে হবে এখন! ফের যদি আমার কাছে আসবি...!
তখনই আম্মাকে জড়িয়ে ধরতাম। আম্মার গায়ের গন্ধ...চোখ বন্ধ করে নীরবে নিশ্বাস নিতে থাকে জিতু। বাতাসে আম্মার গায়ের গন্ধ পায়। চোখ খুলে কেঁদে ওঠে।
জিতু জানে, ঈদে সবাইকে সবকিছু দিয়ে টাকা ফুরিয়ে যাবে। আম্মার জন্যই হয়তো একটি নতুন কাপড় কেনা হবে না। আব্বার জন্য নতুন একটি পাঞ্জাবি...। আরও কিছু টাকা পাঠানোর দরকার ছিল। কিন্তু কি করবে? ক মাস ধরেই বেতন নেই।
সৌদি আরবে ঈদ মানে রাতভর সবাই মিলে রান্না, ঈদের নামজ শেষ করে দেশে একটু কথা বলা, তারপর যে যার ক্যারাভ্যানে গিয়ে বালিশে মুখ গোঁজা। কেউ কেঁদে বালিশ ভেজাবে, কেউ মন খারাপ করে সিগারেট টানতে থাকবে একটির পর একটি। কেউ হয়তো বাড়িতে খবর নিতে থাকে—ফাতেমার জন্য কি কিনছ মা। তোমার জন্য কিছুই কিনলা না। আব্বা কই। ভাইয়া কি আজকেও ঈদের বাজার শেষ করে নাই। তোমার হাঁটুর ব্যথা নিয়া অত কাম করতে যাইয়ো না। নিলু আপারে দুই হাজার টাকা দিয়ো ঈদ করতে। সামনের মাসে আরও বেশি করে পাঠাব নে...।
তারপর চোখে পানি নিয়ে বলবে, আমি ভালো আছি আম্মা। খুব ভালো আছি তোমার দোয়ায়। আম্মা কাঁদে। ওপাশ থেকে বলে, তুই নাই আমার আবার ঈদ কী। আম্মার মতো কেউ বলে না কোনো দিন।
চোখ মোছে জিতু। কিন্তু চোখের পানি ফুরিয়ে যায় না। সবার কথা মনে পড়ে। নিলু আপার জন্য আরও টাকা পাঠানোর দরকার ছিল। কত আদর করে-আম্মার মতো। তার জন্য কিছুই করা হচ্ছে না। সামনের মাসে নিলু আপুর জন্য কিছু টাকা পাঠাতে হবে। আম্মার হাঁটুর ব্যথাটি বেড়েছে? নিজের অসুখের কথা কোনো দিন বলবে না। এখন আর ঈদে আম্মার পা ছুঁয়ে সালাম করা হয় না। আব্বার হাত ধরে ঈদগাহে যাওয়া হয় না।
একেকটি ঈদ একেকটি কষ্টের পাহাড় হয়ে থাকে জিতুর সামনে।
রাত নেমেছে। একটি তারাও নেই আকাশে। বাতাস ঠান্ডা হতে থাকে। আকাশ থেকে অন্ধকার নেমে এসে মিশে থাকে বাদামি আর ধূসর বালুতে। রাতের ঘ্রাণে মাটির গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসে কোটি কোটি পতঙ্গ। দ্রুত ছুটতে থাকে ওরা। বুকের ভেতর জমে থাকা স্মৃতি চলাচলের মতো।
হঠাৎ ক্যারাভানের ভেতর থেকে চিৎকার শোনা যায়। কাল ঈদ, কাল ঈদ। সৌদি-আরবে চাঁদ দেখা গেছে। ঝাপসা চোখে আকাশের দিকে তাকায় জিতু। কোথাও চাঁদ দেখতে পায় না। চাঁদ দেখা কমিটি বাইনিকুলার নিয়ে দেখেছে হয়তো।
ক্যারাভানে যায় না জিতু। বালুর মধ্যেই বসে পড়ে। সামনে অবারিত বালুমাঠ। থেঁতলে যাওয়া কষ্টগুলোকে অবহেলা করে নিশ্বাস। আর নিশ্বাসের সঙ্গে চলে বাতাসের কথা। একটু একটু করে মরে যেতে থাকে জীবনের শব্দ।

কাজী সাইফুল ইসলাম: সৌদি আরবপ্রবাসী। ইমেইল: <[email protected]>