আসুন পরিবর্তন আনি

লেখিকা
লেখিকা

স্কুলের একটা স্মৃতি এখনো স্মৃতির পাতায় জ্বলজ্বল করে। তখন সম্ভবত ক্লাস নাইনে পড়ি। ঢাকার বেশ নামকরা একটি স্কুলেই পড়তাম। স্কুল থেকে বাইরে যাওয়ার সুযোগ হতো খুব কম। বাৎসরিক বনভোজনও হতো স্কুলের ভেতরেই। তবে সেবার একটি বড় ধরনের ব্যতিক্রম হয়েছিল। আমাদের স্কুলে নতুন এক শিক্ষক এলেন ওপরের ক্লাসে বুক কিপিং পড়াবেন বলে। স্যার খুব সহজ সরল। আমরা যতই জ্বালাই, তিনি আমাদের ততটাই ভালোবাসেন। পড়ালেখা ঠিকঠাক মতো করলে সব দুষ্টামি তিনি স্নেহের চোখে দেখেন আর ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে ক্ষমা করে দেন।

ক্লাস নাইন বয়সটাও খুব একটা ভালো না। জীবনে প্রথম ক্লাস ফাঁকি দিলাম। বেশি দুর কোথাও যাইনি। বাথরুমে যাওয়ার নাম করে দুই বান্ধবী সারা স্কুল টহল দিতাম। নতুন বিল্ডিঙের সিঁড়িতে বসে দুনিয়ার গল্প করতাম। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বিশ্বজয় করেছি, এই আনন্দে শিহরিত হতাম। আর স্যার আমাদের ধরতে না পেরে কী রাগ হচ্ছেন সেটা ভেবে হেসে কুটিকুটি হতাম। কিন্তু স্যারকে কিছুতেই রাগানো যেত না। এতটাই স্নেহ করতেন তিনি। সেই স্যার আমাদের অবাক করে দিয়ে একদিন ঘোষণা দিলেন, তিনি আমাদের কিছু শিল্প-কারখানা দেখাতে নিয়ে যাবেন। আমাদের একঘেয়ে জীবনে বিশাল খবর। উত্তেজনা দেখে কে। শুধু যে একদিন ক্লাস করতে হবে না, তাই না, সব বান্ধবীরা মিলে বাসে করে কোথাও যাব।

যত দূর মনে পড়ে আমরা গিয়েছিলাম তেজগাঁও শিল্প এলাকায়। কোক আর পোলার আইসক্রিমের ফ্যাক্টরিতে। পোলার আইসক্রিম তখন নতুন এসেছে। পুরো এলাকা জুড়ে বিস্কুটের গন্ধ। কী যে মিষ্টি। কারখানার ভেতরে ঢুকে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। এই জগৎ আমাদের একদম অজানা। বিশাল মেশিনে কাজ হচ্ছে। লাইন ধরে বোতল যাচ্ছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে বোতল ধোয়া হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বিস্ময় আর আনন্দের কোনো সীমা পরিসীমা থাকল না, যখন আমাদের সবাইকে একটা করে আইসক্রিম দেওয়া হলো। সেই প্রথম বাইরের একটা সম্পূর্ণ অজানা জগতে পা রাখা। বইয়ের পাতার বাইরে জীবন থেকে স্বচক্ষে দেখে নতুন কিছু শেখা।

আজ সকাল থেকে আমার ঘুরে ফিরে সেই দিনটার কথা মনে পড়ছে। সারা দিনই মনে পড়েছে। আজ আমরা অফিস থেকে একদল সহকর্মী গিয়েছিলাম একটি সংগঠনে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করতে। সবাই সবাইকে চিনিও না। আমাদের সঙ্গে কিছু সদ্য হাইস্কুল থেকে পাস করা ইন্টার্নও ছিল। কয়েকটা গাড়ি নিয়ে দলে দলে ভাগ হয়ে রওনা দিলাম আমরা। আমার টিমের কয়েকজন ছিলাম একটা ট্রাকে। আমরা সবাই এই কাজটা করতে খুব আগ্রহী। এত আনন্দ আর হাসি ঠাট্টার মাঝে মনে হচ্ছিল না, আমরা কাজ করতে যাচ্ছি। মনে হচ্ছিল আমরা কোনো আনন্দ ভ্রমণে যাচ্ছি। আমার বারবার মনে হচ্ছিল ক্লাস নাইনে পড়ার সময় সেই স্কুল থেকে যাওয়া শিল্প-কারখানা ভ্রমণের কথা। একই রকমের উত্তেজনা। প্রতিদিনের বাঁধাধরা রুটিন থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দ। নতুন কিছু করার আনন্দ। আর আরেকটা বড় আনন্দ ছিল মানুষের জন্য কিছু করার আনন্দ।

আমরা আজ যে সংগঠনের জন্য কাজ করেছি, তারা মানুষের কাছ থেকে খাদ্য, ব্যবহৃত গৃহসামগ্রী, আসবাব, কাপড়, জুতো, খেলনা, বই সংগ্রহ করে। একটা সংসারে যা লাগে প্রায় সবই এরা নেয়। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দরিদ্র মানুষের মাঝে যথাসম্ভব সুষম বণ্টন করে। গৃহহীন, রিফিউজি, দরিদ্র, অসচ্ছল যে কেউ সাহায্য পেতে পারে। প্রতি বছর হাজার হাজার এমনকি লাখের ওপরে মানুষের জন্য এরা এই কাজ করে। যে দান সামগ্রী এরা পায়, তার যেন যথাযথ ব্যবহার হয়। কোনো রকম অপব্যবহার বা অপচয় না হয় সে জন্য অডিট হয়।

এই সংগঠনের লোকসংখ্যা খুব কম। হাতে গোনা। কিন্তু লাখের ওপরে মানুষকে সাহায্য করার মতো খাদ্য, বস্ত্র, গৃহসামগ্রী এরা পায়। শুনলে অবিশ্বাস্য লাগবে, এই ব্যাপক আকারের কাজ এরা করছে শুধুমাত্র স্বেচ্ছাসেবীদের সাহায্যে। এখানে মানুষ যে শুধু অর্থ বা দ্রব্য দান করেই যথেষ্ট হয়েছে ভাবে, তা নয়। আক্ষরিকভাবে মানুষ নিজে কাজ করে অন্য মানুষ, সমাজ ও বঞ্চিতদের প্রতি নিজের দায়িত্ব পালন করে। আমাদের মতো অনেক অফিস থেকেই প্রতিদিন কোনো না কোনো স্বেচ্ছাসেবীর দল আসে। নিজের হাতে এসব কাজ করতে গিয়ে মানুষের মন আর্দ্র হয়। মানুষ আরও বেশি দান ও স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করতে উৎসাহ বোধ করে। দেশ ও সমাজের প্রতি সর্বোপরি মানুষের জন্য তার দায়িত্ববোধ বাড়ে।

শুধু যে আমাদের মতো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ আসে তা নয়। আসে স্কুলের বাচ্চারাও। এ দেশে সারা বছর ধরে স্কুলের ফাঁকে ফাঁকে বাচ্চাদের বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করানো হয়। স্কুল থেকেই এগুলোর আয়োজন করে। এসব কাজ করতে গিয়ে বাচ্চাগুলোর জীবন সম্পর্কে অনেক বাস্তব শিক্ষা হয়। তাদের চেনাশোনা জগতের বাইরে যে বিশাল একটা জগৎ আছে, তাদের মতো শিশুরাও যে কত কষ্টে আছে, ছোট থেকেই তারা এগুলো দেখে। শুধু তাই না, তাদের মস্তিষ্কে এটা গেঁথে যায়, এদের সাহায্য করাও তাদের দায়িত্ব। এ দেশের স্কুলগুলোর বিশেষ করে নিচের দিকে ক্লাসে একটা প্রধান লক্ষ্যই হলো, মানবিকতার বিকাশ। তাই, অন্যকে সাহায্য করার মাঝে যে গভীর আনন্দ আছে, সেই আনন্দের সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই স্কুল শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেয়।

আমাদের মতো দরিদ্র জনবহুল দেশে, যেখানে মানুষের প্রয়োজন অপরিসীম, অগণিত দরিদ্র, বঞ্চিত মানুষ, যেখানে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান বিস্তর, অপরদিকে আমাদের আছে অপরিসীম জনশক্তি, সেখানে মানুষকে শিশুকাল থেকে এসব সেবামূলক কাজে উৎসাহিত ও সংযুক্ত করতে পারলে এটা একটা সামাজিক উন্নয়নের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। পুথিগত শিক্ষা আর অসংখ্য বিভিন্ন ধরনের উৎসবের বাইরে শিশুদের শারীরিক শিক্ষার দরকার যেমন অপরিহার্য, সেরকম দরকার মানসিক বিকাশ, মানবিক গুণাবলির চর্চা। স্কুল পর্যায়ে এ কাজগুলোকে বাধ্যতামূলক করা দরকার। বড়দের নিজেদেরও বিভিন্ন সেবামূলক কাজে অংশ নিয়ে শিশুদের শেখাতে হবে। এক প্রজন্মে না হলেও কয়েক প্রজন্মে আমরা এই পরিবর্তন আনতে পারি। যার সুফল পাবে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরাই।

তামান্না ইসলাম: ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।