সামার কোডিং ক্যাম্প ও অ্যালন মাস্কের হাইপার লুপ

সামার স্পোর্টস ক্যাম্পে বাস্কেট বলের প্রস্তুতিতে লেখকের ছেলে ফাইযান
সামার স্পোর্টস ক্যাম্পে বাস্কেট বলের প্রস্তুতিতে লেখকের ছেলে ফাইযান

সামারের পুরো তিন মাস ফাইযানের স্কুল বন্ধ। এ সময় স্কুল পড়ুয়া বাচ্চাদের এনগেজ রাখা ও সময় কাটানো ব্যস্ত মা-বাবাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তবে টিউশন ফির বিনিময়ে এ সময় বিভিন্ন ইয়ুথ, কালচারাল, স্পোর্টস ও সোশ্যাল অর্গানাইজেশন ও ডে কেয়ার সেন্টার সামার ক্যাম্পের আয়োজন করে। প্রতিটা ক্যাম্পের থিম পৃথক থাকে। ফাইযানকে আমরা কয়েক সপ্তাহ ভাগ করে বিভিন্ন টাইপের ক্যাম্পে দিই। যাতে ক্যাম্পটা ওর জন্য বিরক্তিকর হয়ে না যায়। প্রথম তিন সপ্তাহ স্পোর্টস ক্যাম্পে গিয়েছিল। একজন কোচের তত্ত্বাবধানে সারা দিন ওরা বিভিন্ন রকমের স্পোর্টস করেছিল-ফুটবল (soccer), বাস্কেট বল, সুইমিং, ডজ বল, গলফ, আইস স্কেটিং, স্কোয়াশ বল, লন টেনিস, বেইস বল, আরও কত কী! আগামী দুই সপ্তাহ সে যাবে প্রোগ্রামিং/কোডিং ক্যাম্পে। এখানে আইপ্যাড দিয়ে কোডিং করানো শেখাবে। এই ক্যাম্প নিয়ে ওর সঙ্গে কথা হচ্ছিল।

—তুমি আমাকে আইপ্যাড কোডিং ক্যাম্পে দিয়েছ কেন? এটা খুব বোরিং ক্যাম্প হবে।
—কেন? তুমি তো আইপ্যাডে গেম খেলতে পছন্দ কর। আমার ধারণা, এই ক্যাম্প তুমি অনেক এনজয় করবে।
—না, আমি স্কুলে আইপ্যাড কোডিং ক্লাস করেছি। ওখানে আইপ্যাডের বাগ (Bug) কেমনে ফিক্স (Fix) করতে হয়, তা দেখিয়েছিল। খুবই বোরিং...।
—তোমার কোডিং টিচারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সে বলেছে এটা অনেক মজার ক্লাস। টিচার তোমাদের আইপ্যাডে গেম বানানো শেখাবে।
—কোডিং করে কি কখনো মজার জিনিস করা যায়?
—হ্যাঁ, অনেক মজার আর আনন্দের কাজ তো শুধু কোডিং দিয়েই হয়। যেমন তুমি ইউটিউব দেখো, ফোনে গেম খেলো, ফেসবুক, গুগল কর, সবই তো কোডিং করে হয়েছে। এমনকি ভবিষ্যতের সব চমৎকার, বিস্ময়কর কাজগুলো কোডিং করে করা হবে।
—তুমি বলছ সব কাজ?...তুমি কি কোডিং করে গাড়ি চালাতে পারবে?
—সব না হোক, অনেক কাজ কোডিং করে, রোবট দিয়ে করা হবে। হ্যাঁ, কোডিং করে গাড়িও চালানো হবে। টেসলা, গুগল ও উবারতো ইতিমধ্যে সেলফ-ড্রাইভিং গাড়ি বানিয়ে টেস্ট করছে।
—তাই নাকি! কেমনে? ড্রাইভার ছাড়া গাড়িগুলো তো ক্রাশ করবে।
—হ্যাঁ, এখন টেস্ট ড্রাইভিংয়ে মাঝে মধ্যে অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে। টেসলারের সেমি-সেলফ ড্রাইভিং গাড়ি ফ্লোরিডায় ট্রাকের সঙ্গে ক্রাশ করেছিল ২০১৬ সালে। গাড়িটিকে সেলফ ড্রাইভিংয়ে দিয়ে ইউএস নেভির একজন অবসরপ্রাপ্ত কমান্ডার হ্যারি পটার মুভি দেখছিল। উবারের সেলফ-ড্রাইভিং গাড়ি অ্যারিজোনার টেম্পেতে একজন নারী পথচারীকে হিট করেছিল গত মার্চ মাসে। যখন কোডিং আর সেন্সরগুলো আরও উন্নত হবে, তখন ক্রাশ করবে না এবং সবাই সেলফ ড্রাইভিং গাড়ি ব্যবহার করবে। এটা অনেক এক্সসাইটিং না?
—হ্যাঁ, এটা একটা দারুণ ব্যাপার হবে। তুমি কি জান কত দিন পর সেলফ-ড্রাইভিং গাড়ি কিনতে পাওয়া যাবে?
—টেসলারের বস অ্যালন মাস্ক বলেছিল, ওরা এ বছরের শেষের দিকে বিক্রি করবে। আর গুগল বলেছে ২০২০ সালে বিক্রি করবে। তুমি ও তোমার বন্ধুদের ড্রাইভিং না শিখলেও চলবে। গাড়িতে বসে কমান্ড করলে গাড়ি নিজে নিজে চলা শুরু করবে এবং গন্তব্যে নিয়ে যাবে।
—তুমি কি একটা সেলফ-ড্রাইভিং গাড়ি কিনতে পারবে?
—সেলফ-ড্রাইভিং গাড়ির অনেক দাম...দেখা যাক। তুমি কি অ্যালন মাস্ক সম্পর্কে জান?
—না, ও কি টেসলার ইলেকট্রিক গাড়িগুলো বানিয়েছে?
—হ্যাঁ, ও ডিজাইন করেছে আর ওর টিম বানিয়েছে। ও হচ্ছে কোডিং গাই। অ্যালন মাস্ক অসম্ভবকে সম্ভব করার এবং সাহসী ও দারুণ সব আইডিয়ার জন্য বিখ্যাত।
—ও কোথায় জন্মেছে, ক্যালিফোর্নিয়ায়?
—না, ও সাউথ আফ্রিকান। ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায় পড়ার জন্য ইউএসএতে এসেছিল। ছোটবেলা থেকেই কোডিং করতে পছন্দ করত। ১০ বছর বয়সে ও কোডিং করে একটা মজার গেম বানিয়েছিল, যেটা বিক্রি করে ৫০০ ডলার পেয়েছিল।
—ওই গেমের নাম কি? ওটা কি আমি আইপ্যাডে খেলতে পারব?
—ওর গেমটার নাম মনে হয় ব্লাস্টার। এটি এখনো অনলাইনে পাওয়া যেতে পারে। আমরা খুঁজে দেখতে পারি।
—ওর এখন বয়স কত?
—৪৬–৪৭ বছরের মতো হবে।
—ওর কি ল্যাম্বারগিনি গাড়ি আছে? এখন ওর কত টাকা?
—থাকতেও পারে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি পড়া বাদ দিয়ে ও কোডিং করে একটা ওয়েবসাইট বানিয়েছিল। পরে ওটা বিক্রি করে ৩০-৩৫ মিলিয়ন ডলার পেয়েছিল। এরপর সে কোডিং করে অনলাইন টাকা ট্রান্সফারের আরেকটা ওয়েবসাইট বানিয়ে সেটা ই-বের (e-bay) কাছে বিক্রি করে কয়েক শ মিলিয়ন ডলার কামিয়েছে। এখন সে বিলিয়নিয়ার।
—ও কি তাহলে লেবরন জেমসের চেয়েও ধনী?
—হবে হয়তো...তবে ওর আইডিয়াগুলো অনেক বেশি চমকপ্রদ ও চ্যালেঞ্জিং। যেমন তার আইডিয়া হচ্ছে মার্সে (মঙ্গল গ্রহে) সিটি বানানো। লোকজনকে চাঁদে অথবা স্পেস স্টেশনে (মহাশূন্যে) বেড়ানোর জন্য পাঠানো। ড্রাইবার ছাড়া গাড়ি চালানো। দূষণমুক্ত ইলেকট্রিসিটি তৈরি করা...আরও অনেক রোমাঞ্চকর আইডিয়া। অনেক মজার না?
—হ্যাঁ...। ও নাসার সঙ্গে কাজ করে না কেন?
—নাসার কাজেও অ্যালন মাস্ক হেল্প করে। স্পেস এক্স নামে ওর নিজের রকেট ও স্যাটেলাইট বানানোর কোম্পানি আছে। ফ্যালকন ৯ নামে ওর একটি বিশাল রকেট কিছুদিন আগে স্পেস স্টেশনে পাঠিয়েছে। ওর আরেকটা কোম্পানির নাম ও এর স্টোরি খুবই ফানি, বলব?
—হ্যাঁ, বল।
—সানফ্রান্সিসকোতে একটা মিটিংয়ে যাওয়ার পথে অ্যালন মাস্ককে ট্রাফিক জ্যামে প্রায় এক ঘণ্টা বোরড (bored) হয়ে গাড়িতে বসে থাকতে হয়েছিল। তখন কীভাবে ট্রাফিক সমস্যা সমাধান করা যায় এটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে সে হাইপার লুপের আইডিয়াটা পেল। আর এই আইডিয়াকে কাজে লাগানোর জন্য একটা নতুন কোম্পানি করল। আর এই কোম্পানির নাম দিল বোরিং কোম্পানি।
—হা–হা...বোরিং কোম্পানি!
—হ্যাঁ ট্রাফিক জ্যামে বোরড হয়ে এই কোম্পানির কথা মাথায় আসায় বোরিং কোম্পানি। আবার বোরিং মানে সুড়ঙ্গও। হাইপার লুপের আইডিয়ায় ট্রাফিক থাকবে না এবং সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে খুব কম সময়ের মধ্যে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া যাবে। হাইপার লুপের আইডিয়াটা শুনতে চাও?
—হ্যাঁ, বল...।

সামার আইপ্যাড কোডিং ক্যাম্পে কোডিংয়ে ব্যস্ত ফাইযান
সামার আইপ্যাড কোডিং ক্যাম্পে কোডিংয়ে ব্যস্ত ফাইযান

—অনেকগুলো টিউব মাটির নিচ দিয়ে এক সিটি থেকে অন্য সিটিতে কানেকটেড থাকবে। টিউবের ভেতরে বিভিন্ন সাইজের ক্যাপসুল কার ইলেকট্রিক কারেন্ট ও চুম্বকশক্তির মাধ্যমে হাইস্পিডে চলবে। চুম্বকশক্তি ক্যাপসুলগুলোকে টিউবের মধ্যে ঝুলিয়ে রাখবে আর ইলেকট্রিক মোটর ক্যাপসুলগুলোকে চালিয়ে নিয়ে যাবে। কোনো ড্রাইভার লাগবে না, কোডিং করে কন্ট্রোল করা হবে।
—ও আমি এটা অড স্কোয়াডে (Odd Squad-টিভি সিরিয়াল) দেখেছি। নিজেকে স্কুইজ করে একটা স্ফেয়ারে ঢুকাতে হয়, তারপর স্ফেয়ারটি টিউবের মধ্যে অনেক জোরে গিয়ে অন্য সিটিতে বের হয়।
—হ্যাঁ, ওখানে দেখাতে পারে, কারণ ওটা সায়েন্স ফিকশন সিরিয়াল। ইনফ্যাক্ট, অ্যালন মাস্ক বলেছিল ওর অনেক আইডিয়া এসেছে সায়েন্স ফিকশন বই, মুভি ও টিভি সিরিয়াল থেকে। কারণ ও ছোটবেলায় সায়েন্স ফিকশনের বই পড়তে ভালোবাসত।
—মাটির নিচের টিউবগুলোতো অনেক ভয়ংকর!
—না, ওখানে আলো থাকবে। ওগুলো অনেক নিরাপদ হতে পারে কারণ মাটির নিচে থাকার কারণে তুষারপাত, বৃষ্টি, বন্যা, টর্নেডো ও ঝড় টিউব বা ক্যাপসুল কারের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। অ্যালন মাস্কের সবচেয়ে ফেবারিট রাইটার কে ছিল জান?
—কে?
—আইজ্যাক অ্যাসিমভ। ও আমেরিকান সায়েন্স ফিকশন রাইটার। আমাদের লাইব্রেরিতে আসিমভের বই থাকবে। তুমি পড়তে চাও?
—হ্যাঁ, চাই। লাইব্রেরি থেকে আমি খুঁজে বের করব।
—অ্যাসিমভের সায়েন্স ফিকশন থেকে অনেক সায়েন্টিস্ট অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং অনেক মুভিও বানানো হয়েছে। অ্যাসিমভের সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্প নিয়ে আমরা আরেকদিন কথা বলব।
—ঠিক আছে।
—হাইপার লুপ, সেলফ ড্রাইভিং গাড়ি, ফ্যালকন রকেট...সবগুলো ভালোভাবে কাজ করবে যদি কোডিংটা ভালো হয়। ক্যাম্পে তুমি কোডিং সম্পর্কে আরও অনেক মজার জিনিস জানতে পারবে।
—হ্যাঁ, কোডিং অনেক মজার!
গত সপ্তাহ ছিল কোডিং ক্যাম্পের প্রথম সপ্তাহ। ফাইযান অনেক এনজয় করেছে। ক্যাম্পের টিচারটাও বেশ উদ্যোগী ও বাচ্চাদের ভালোই উৎসাহ দিতে পারে। ওরা কোডিং করে একটা গেম বানিয়েছে। লেগো দিয়ে বানানো রোবটের মুভমেন্ট কন্ট্রোলও করেছে আইপ্যাড থেকে। ক্যাম্প থেকে ফিরে কোডিংয়ের গল্প শোনানো ফাইযানের অনেক পছন্দ। থ্যাংকিউ অ্যালন মাস্ক, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকার জন্য।

মু. রবিউল হোসেন (রবি), ওকলাহোমা, যুক্তরাষ্ট্র।