শুধু দরকার এক গ্লাস ভালোবাসা

বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্রাজিল বনাম মেক্সিকো খেলার একটি দৃশ্য। ছবি: রয়টার্স
বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্রাজিল বনাম মেক্সিকো খেলার একটি দৃশ্য। ছবি: রয়টার্স

নতুন প্রজন্মরা বাংলাদেশের ফুটবল উন্মাদনা কী তা জানে না। আমাদের সময়ে আবাহনী-মোহামেডান ক্লাবের ফুটবল নিয়ে সবাই মাতোয়ারা থাকতেন। খুব কম লোক ছিলেন ব্রাদার্স ইউনিয়ন করতেন। ঢাকার লীগ বা কোনো টুর্নামেন্টে আবাহনী বা মোহামেডানই চ্যাম্পিয়ন হতো। ব্রাদার্স ইউনিয়ন ছিল তৃতীয় শক্তিশালী দল। মাঝে মাঝে ব্রাদার্স ইউনিয়নকে কোনো টুর্নামেন্টে এই দুই দলের একটির বিরুদ্ধে ফাইনালে দেখা যেত। তখন হারু পার্টিরা ফাইনালে ব্রাদার্স ইউনিয়নকে সমর্থন করতেন।

বাংলাদেশের আশি ও নব্বই দশকের ফুটবল আর এখনকার ফুটবলের মধ্যে বিস্তর ফারাক। সে সময় ফুটবল লীগ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকার অলি-গলিগুলো আবাহনী-মোহামেডানের পতাকায় ভরে যেত। আড্ডার স্থানগুলোতে আসলাম, মনোয়ার মুন্না, কায়সার হামিদ ও সাব্বিরদের নিয়ে আলোচর ঝড় উঠত। কে কেমন খেলবে তা নিয়ে শুরু হতো কথার বারতা। কোনো ক্রিকেটার দিয়ে তখন টিভি বিজ্ঞাপন বানানো হতো না। সালাউদ্দিনের মতো ফুটবলারদের টিভি বিজ্ঞাপনে দেখা যেত। সালাঊদ্দিন সাহেবের লাইফ বয় বিজ্ঞাপনটির কথা কারও ভোলার কথা না। কারণ টিভি খুললেই সালাউদ্দিনকে লাইফ বয় সাবান মেখে গোসল করতে হরদম দেখা যেত।
আবাহনীর পতাকা ছিল নীল এবং মোহামেডানের পতাকা ছিল সাদা ও কালো রঙের। আমি সমর্থন করতাম আবাহনীকে। বড়দের সঙ্গে বিশাল বিশাল লম্বা বাঁশে নীল রং লাগাতাম। বড় ভাইয়েরা খানাদানার আয়োজন করতেন। শুরু হতো বাঁশের প্রতিযোগিতা। কে কত বড় ও লম্বা বাঁশের আগায় নিজ ক্লাবের পতাকা ওড়াবে তা নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু হতো। তখন প্রতিটি এলাকায় ক্লাবঘর ছিল। আমরা সবাই ক্লাবঘরে গিয়ে সাদা-কালো টিভিতে খেলা দেখতাম। ক্লাবঘরে তিল ধারণের জায়গা থাকত না। খেলা দেখা নিয়ে চরম উত্তেজনা কাজ করত। আবাহনী ও মোহামেডানের সমর্থকেরা এক সঙ্গে খেলা দেখার প্রশ্নই আসত না।
তখন চায়ের দোকানগুলোতে টিভি দেখার ব্যবস্থা থাকত। তবে চা-নাশতা খেয়েই টিভি দেখতে হতো। খরিদ্দার ছাড়া দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে ধাক্কাধাক্কি করে অনেকে টিভি দেখতেন। টিভি থাকত অনেক দুরে। কোনো রকম আবছা আবছা দেখেই তারা মনের আনন্দ মেটাতেন। আবাহনী-মোহামেডানের খেলার দিন চায়ের দোকানগুলোর চেয়ার খেলা শুরু হওয়ার অনেক আগ থেকেই দখল হয়ে যেত। সে দিন তাদের বেচা-বিক্রি হতো অনেক বেশি। এই দোকানগুলোতে প্রায়ই প্রতিপক্ষের সঙ্গে মারপিট হতো।

লেখক
লেখক

ফুটবল লীগ শুরু হলে এলাকাগুলোতে ঈদের মতো আনন্দ শুরু হতো। আশি ও নব্বইয়ের দশকে যাদের জন্ম হয়নি তাদের কাছে আমার কথাগুলো আষাঢ়ে গল্পের মতো মনে হলেও, সে সব দিনগুলোর ফুটবল উন্মাদনার কাছে আজকের যুগের ক্রিকেট উন্মাদনাকে আমার কাছে নস্যি বলে মনে হয়। তখন মানুষ মনে প্রাণে ফুটবলকে ভালোবাসত। একেবারে খাঁটি প্রেম আর কী!
লন্ডনে আসার পর এখানকার মানুষদের ফুটবল নিয়ে পাগলামি দেখে আমার অতীত দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। লীগের ফুটবল খেলাগুলো ব্রিটেনের মানুষ ঘরে বসে না দেখে পাব ও জুয়ার ঘরগুলোতে গিয়ে উপভোগ করতে বেশি পছন্দ করেন। উল্লেখ্য, এ দেশের প্রতিটি জনাকীর্ণ ও গলির মাথায় বিভিন্ন ঢংয়ের পাব ও উইলিয়াম হিল, পেডি পাওয়ার, কোরাল, ল্যাডব্রুকের মতো বাজির ঘরগুলো সবার নজর কাড়ে। এ সব দোকানগুলো লাইভ খেলা দেখানোর বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। এ দেশের মানুষগুলো ড্রিংক করতে করতে ও খেলায় বাজি ধরে খেলা দেখতে আনন্দ অনুভব করে। বড় দলগুলোর খেলা হলে দোকানগুলোতে বসার জায়গা থাকে না।
এখানে স্পোর্টস সামগ্রী বিক্রির দোকানগুলো ফুটবল দলের মাফলার, ক্যাপ ও হরেক রকমের টি-শার্ট বিক্রি করে মিলিয়ন পাউন্ড আয় করে। ছোট-বড় সবাই ফুটবল দেখতে স্টেডিয়ামে যায়। অনেক ঠান্ডা উপেক্ষা করে বুড়ো ও শিশুদের পরিবার পরিজনের সঙ্গে খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে যেতে দেখা যায়। বেশির ভাগ সমর্থকদের পরনে থাকে তাদের নিজ দলের জার্সি। দলের লোগো দিয়ে বানানো মাফলার গলায় ঝোলানো থাকে। ইংলিশরা ফুটবল দেখতে দেখতে গান করতে খুব পছন্দ করেন।
উল্লেখ্য, ইংলিশদের ফুটবল স্টেডিয়ামে গান করা বিশ্বে খ্যাতি রয়েছে। সারা স্টেডিয়াম দর্শকদের গানে মোহিত থাকে। খেলা শুরুর আগে সমবেত কণ্ঠে গান গেয়ে গেয়ে সবাই স্টেডিয়ামে ঢোকে ও খেলা শেষে বিজয়ীরা গান গেয়ে গেয়ে বের হয়। হারু পার্টিরা নিশ্চুপ হয়ে দ্রুত স্টেডিয়াম ত্যাগ করে। আমার বেশ কিছু ইংলিশ লীগ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ফুটবল নিয়ে তাদের উন্মাদনা আমাদের দেশের আশি বা নব্বই দশকের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।
আমরা কেন সেই ফুটবল উন্মাদনা ধরে রাখতে পারলাম না? এই প্রশ্নের উত্তর আমার অজানা। আমরা ফুটবল প্রেমিক জাতি। বিভিন্ন দেশের ফুটবল নিয়ে যা করছি তাই প্রমাণ করে আমরা ফুটবলকে কত ভালোবাসি। আমরা আজ ফুটবল ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলেছি। তাতে আমাদের কারও আফসোস নাই। আমরা তো এখনো বেঁচে আছি আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল নিয়ে। তাইতো আমাদের দেশে আজ উড়ছে ভিনদেশি পতাকা। বিশাল বিশাল পতাকা বানিয়ে লাইন ধরে ছবি তুলে ফেসবুকে দিচ্ছি। তা দেখে অন্যরা আরও বড় পতাকা বানিয়ে সবাইকে তাক লাগানোর চেষ্টায় রত।
এগুলো সবই ফুটবল নিয়ে আমাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ফুটবল নিয়ে ভালোবাসার মেকি বহিঃপ্রকাশকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার মতো কি দেশে কোনো সুহৃদ নেই! সাড়ে তিন লাখ মানুষের দেশ যদি ফুটবল বিশ্বকাপ খেলতে পারে, ১৬ কোটি মানুষের দেশে কেন ফুটবল ট্যালেন্ট নেই? আমাদের ফুটবলকে উন্নত করার জন্য শুধু দরকার এক গ্লাস দেশপ্রেম। আমাদের গ্রামগঞ্জে খুঁজলে রোনালদো, মেসি, নেইমার ও মো. সালাহর দেখা মিলবেই। আমি হলফ করে বলতে পারি, যেদিন আমাদের দেশ ফুটবল বিশ্বকাপের আসরে যাবে, সেদিন দেশের গ্রামগঞ্জ, শহর-বন্দর, অলি-গলিতে বাংলাদেশের ঝান্ডাই উড়বে!
...

মোহাম্মদ আবদুল মালেক: লন্ডন, যুক্তরাজ্য।