আমি ছিলাম আশ্রিতা

লেখিকা
লেখিকা

মাসের শেষ দিন। ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর। যথারীতি বাচ্চারা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে খাবার খেয়ে যে যার বিছানায় শুয়ে পড়েছে। দেশ থেকে বেড়াতে আসা আমার মাও ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমি ছোট ছেলে আহানাফকে নিয়ে আমার ঘরে ঘুমোতে গেলাম।

ঘণ্টা দুই পরে লন্ডন থেকে বোনের ছেলের ফোন কলে ঘুম ভেঙে গেল। ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই মার ঘরে ঢুকে দেখি তিনি কোরআন শরিফ পড়ছেন। কোরআন পড়া শেষ করে মা আর আমি দুজনেই ভিডিও কলে মজা করে ওদের সঙ্গে কথা বলছিলাম।

এ সময় হঠাৎ দরজায় বিকট আওয়াজ! বেশ কয়বার জোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে কে যেন হড়বড় করে কিছু বলে গেল। আচমকা, বোধগম্য হলো না!

দরজা খুলতেই যা শুনতে পেলাম, স্তম্ভিত আমি কিছুটা মুহূর্ত! কী করব, কী করা উচিত, বুঝে উঠতে পারলাম না তৎক্ষণাৎ!

আওয়াজ শুনতে পেরে মাও আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমরা দুজনেই দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ে কয়েক সেকেন্ড বিমূঢ় হয়ে রইলাম। পর মুহূর্তেই বৃদ্ধা মাকে ধাক্কা দিয়ে বললাম, মা, তুমি আগে যাও।

মাকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে আমি দৌড়ে ভেতরে গিয়ে কিছু বোঝার আগেই আমার মেয়ে আড়ালকে বললাম তাড়াতাড়ি আমার সঙ্গে নিচে নেমে আসো।

তারপর ঘুমের পায়রাগুলোকে বিছানা থেকে টেনেহিঁচড়ে বুকে জড়িয়ে নগ্ন পায়ে সিঁড়ির শেষ প্রান্তে আসতেই বিকট বিস্ফোরণ!
কি হলো?
শুধু একবার পেছন ফিরে তাকালাম। বাচ্চাদের বাঁচাতে পারব তো? তিন বাচ্চা আর বৃদ্ধা মাকে নিয়ে বাড়ির বাইরে মাঝ রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে দেখলাম আমাদের বেসমেন্ট থেকে জ্বলন্ত অগ্নিশিখা তার শাখা প্রশাখা দিয়ে আমার ঘরের জানালায় দ্রুত গতিতে হাত বাড়াচ্ছে। পনেরো বছরের স্বপ্নের সংসার এক মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে উঠল।
কতক্ষণ ছিলাম ঘোরের ভেতর বলতে পারব না। গভীর সুখ দুঃখের, স্বপ্নের স্মৃতির দেয়াল ভেঙে অন্তরের সমস্ত নিস্তব্ধতাকে চুরমার করে দিয়ে বিকট শব্দে অগ্নিনির্বাপক দমকল বাহিনীর আওয়াজ কানে বেজে উঠল। চিৎকার আর কান্নার আহাজারিতে ঘোর কেটে গেল।
চৈতন্য ফিরে এলে নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাত-পা ছড়িয়ে রাস্তার ফুটপাতে বসে আছি। এদিক-সেদিক ফিরে দেখি আমার ছেলেমেয়ে কেউই আমার পাশে নেই। কালো ধোঁয়ায় পুরো বাড়ি আচ্ছন্ন। পাগলের মতো সবাইকে খুঁজতে লাগলাম!
খুঁজে পেলাম শুধু আমার মেয়েকে। কিন্তু আমার ছেলে অধ্যায় কোথায়? ওকে কি বের করেছিলাম? নাকি ঘরের ভেতর এখনো ঘুমোচ্ছে? বেঁচে আছে তো? এমন নানান প্রশ্নে বুকের মাঝে কষ্টের পাহাড় হাহাকার করে উঠল।
হাত-পা আমার অবশ হয়ে গেল। ভুলেই গিয়েছিলাম সব। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা দেখতে লাগলাম।
হায়, এ আমি কী করেছি? মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বললাম অধ্যায়কে তো আনা হয়নি!
মেয়ে আমাকে শান্ত করে মনে করিয়ে দিল, অধ্যায়তো আমাদের সঙ্গেই এসেছে মা। তখনই মনে পড়ল মা আর ছোট ছেলেকে ফাস্ট ফ্লোরের কে বা কার গাড়িতে যেন তুলে দিয়েছিলাম, সঙ্গে অধ্যায়কেও দিয়েছিলাম তখন।
নগ্ন পা, ঘরের জামা পরিহিত আমি। শীতের গরম কাপড় নেই গায়ে। নভেম্বর মাসের তীব্র শীতের মধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। ফাস্ট ফ্লোরের এক ভাবি এসে আমার গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে দিয়ে গেল। আমার মেয়ে আমাকে মোজা পরিয়ে দিল। কে বা কারা আমাদের সবাইকে শীতের কাপড়, পানি দিয়ে গেল।
আমি পাগলের মতো আমার বর দানিকে ফোন করছিলাম। কাজে থাকার কারণে ও ফোন ধরতে পারছে না।
অগ্নিনির্বাপক বাহিনী মুহূর্তের মধ্যে আমাদের ঘরের জানালা ভেঙে ভেতরে সব তছনছ করে বাড়ির সম্পূর্ণ চেহারাটাই পালটে দিল, যেন ধ্বংসস্তূপ!
আমার সাজানো বাসস্থান এক নিমেষে আগুনে পুড়ে দগ্ধ হয়ে গেল।
চার ঘণ্টা আমরা মা-মেয়ে একে অন্যের কষ্টের ভাগীদার হয়ে হতবাক বিস্ময়ে অশ্রুসজল চোখে শীতের কনকনে রাতে কষ্ট আর ঠান্ডাকে গায়ে জড়িয়ে তাকিয়ে রইলাম ধোঁয়াটে বাড়িটার দিকে।
ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা অনেকেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখল। ছবি তুলল, ভিডিও করল। কেউ কেউ অনেক আফসোস করল। যেমনটি আমরা অন্যের বাড়িতে আগুন লাগলে কষ্ট পাই, আফসোস করি।
একদিন নিজেরাই এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনার স্বীকার হবো, জীবনে কখনো কল্পনাও করিনি।
অন্ধকারে আমাদের এই অ্যাপার্টমেন্টের চারটি আশ্রয়হীন পরিবারের চোখের জল, বুকের হাহাকার, নৈরাশ্য কেউই দেখতে পেল না। ঘটে যাওয়া ঘটনার বিস্তারিত চাক্ষুষ দেখা লোকজনগুলো আর কেউ হয়তো খোঁজ নেবে না, জানবেও না।
আমরা এখন কোথায় যাব? এর মধ্যে রেডক্রস থেকে লোকজন এসে আমাদের সবার কাছ থেকে নাম তথ্য সংগ্রহ করে নিল। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেবার জন্য একজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ঘরে ঢোকার অনুমতি পেলাম। ঘরে ঢুকে হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। অসহায়ের মতো কান্নায় ভেঙে পড়লাম। ঘরের চরম খারাপ অবস্থা। যেখানে পা রাখতে পারছিলাম না সেখান থেকে কী নেব আর কীই বা রাখব!
ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে আলো ছিল না বলে পুলিশ কর্মকর্তার টর্চের আলোর সাহায্যে নিজেকে সামলে নিয়ে কোনো রকম হাতের কাছে যা পেলাম, কিছু জিনিস ব্যাগে ভরে তাই নিয়ে ছুটে বের হয়ে এলাম ঘর থেকে। নিচে রাস্তায় এসে দেখি ততক্ষণে আমার বর আর ভাইও চলে এসেছে। আবেগ আপ্লুত হয়ে চোখের জলে সমস্ত কাহিনির বিবরণ দিলাম তাদের। পেছনে ফেলে আসা স্বপ্নের সংসার আর ভারাক্রান্ত মন নিয়ে রাত দুটায় সপরিবারে রওনা হলাম হোটেলের উদ্দেশে।
কী ভয়ানক অবস্থার মুখোমুখি ছিলাম ওই দিন, এখনো মনে পড়লে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে আমরা সবাই সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম যদিও, কিন্তু বাকি দিনগুলো কী যে দুরবস্থা আর দুর্ভোগে অতিবাহিত করেছি তা অকল্পনীয়।
পরে জানতে পারি বেসমেন্টের চুলা থেকে আগুনের সূত্রপাত। একটি ভুল, একটু অন্যমনস্কতা, একটি ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠির আগুন থেকে সুস্থ, সুন্দর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে আমাদের বিপন্ন করে দিয়ে গেল। আচমকা কতগুলো মানুষ বিপদগ্রস্ত হলাম।
এ ঘটনার পর থেকে আগুন নিয়ে আমার ভেতরে সব সময় চরম আতঙ্ক বিরাজ করে। এমনকি যখনই দেখি অন্য কারও বাড়ি আগুনে পুড়ে যাচ্ছে, ভয়ে সেঁটে যাই নিজের সঙ্গে আমি।
আমেরিকাতে আসার পর এত বছরেও এমন অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার সম্মুখীন কখনো হতে হইনি। এই প্রথমবারের মতো বড় ধরনের ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে ছিল আমাদের জীবনে। নিজেকে দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি, কতটা দুর্ভোগে পনেরোটি দিন-রাত্রি কাটিয়েছি অন্যের আশ্রয়ে।
বাচ্চাদের স্কুলের সুবিধার্থে সেদিন আমি এক বড় ভাইয়ের বাসার ছাদের নিচে সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলাম। কারও অনুরোধে নয়, স্বেচ্ছায় গিয়েছিলাম আশ্রয় নিতে।
চোখের জলে বালিশ ভিজে যায় যখনই পনেরো বছরের গোছানো সংসারের কথা ভাবি। দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে পোড়াবাড়ির মতো ধ্বংসস্তূপ। ঘুম ছিল না চোখে আমার। সিলিংয়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে রাত্রি শেষ করেছি। বুকের পাশে থেকে ব্যথা অনুভবে নির্মোহ, নির্লিপ্ত যাতনার জীবন যাপন করেছি।
ভয়াবহ সেই দিনগুলো মনের মাঝে কাঁটা হয়ে গেঁথে ধীরে ধীরে স্মৃতিকথার রূপ ধারণ করেছে। এখনো প্রতি মুহূর্তে উপলব্ধি করি নিজের সেই সব অসহায়ত্বের কথা।
মনেৱ মাঝে ঝড়গুলো নীরবতায় অশ্রুর সঙ্গে অনবরত কথা বলে চলে।
অন্তঃপুরের চিৎকার শব্দহীন বোবা কান্না কাঁদে।
বেশ অনেকগুলো দিন-রাত
ঘর ছাড়া, বাস্তুহারা
আমি ছিলাম এক আশ্রিতা।

উইলি মুক্তি: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।