মরণ বলে আমি তোমার জীবন তরী বাই

মৃত্যু খুব ছোট একটা শব্দ। কিন্তু এর গভীরতা বিশাল। মৃত্যু হলো জীবনের সমাপ্তি। যখন আমি ভাবি কোনো এক ভোরে আমি হয়তো আর জেগে উঠব না; আমার কন্যার হাসিমুখ দেখব না, তখন অদ্ভুত এক শূন্যতা তৈরি হয়।

জীববিজ্ঞানের ভাষায় প্রাণ আছে এমন কোনো জৈব পদার্থের (বা জীবের) জীবনের সমাপ্তিকে মৃত্যু বলে। মৃত্যু হচ্ছে এমন একটি অবস্থা যখন সকল শারীরিক কর্মকাণ্ড যেমন শ্বসন, খাদ্য গ্রহণ, পরিচালন ইত্যাদি থেমে যায়। সকল ধর্মগ্রন্থেই মৃত্যুর প্রসঙ্গ এসেছে। যেমন কোরআনে বলা আছে—‘প্রতিটি প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।’ আবার হিন্দু পুরানে আছে—‘যদি কোনো ব্যক্তি জলে অথবা দর্পণে তাঁর ছায়া দেখতে না পান, তিনি জানবেন তাঁর মৃত্যুর বেশি দেরি নেই।’
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্য হলো মৃত্যু। মানুষ নিশ্চিত হয়ে জানেন না কখন কীভাবে তার জীবনের পরিসমাপ্তি হবে। মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কোনো মুহূর্ত নেই। চিকিৎসকেরা হৃদ্‌যন্ত্র, ফুসফুস ও মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ-সংক্রান্ত কিছু নির্ণায়ক বিবেচনায় নিয়ে রোগীকে মৃত ঘোষণা করেন। তবে কখন চূড়ান্ত বা সামগ্রিক মৃত্যু (সোমাটিক ডেথ) ঘটে, তার উত্তর দিতে পারেন না। জীববিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে, মৃত্যুর কোনো সুনির্দিষ্ট একক মুহূর্ত নেই। মৃত্যুকালে মানুষ ধারাবাহিকভাবে ছোট ছোট মৃত্যুর ভেতর দিয়ে যায়।
বিশিষ্ট নিউরোলজি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ Dr. James Bernat–এর মতে, ‘মানুষের জীবনে নির্দিষ্ট কোনো মুহূর্ত নেই যখন তার সব শেষ হয়ে যায়। এই শেষ হওয়া তার জন্মের পর থেকেই শুরু হয়। আর শেষ পরিণতি অনেকগুলো মিনি ডেথের সমষ্টি।’
জীবনে প্রথম মৃত্যু দেখেছিলাম আট বছর বয়সে আমার বাবার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। আমার যত দূর মনে পড়ে, সেবারই প্রথম আমি মৃত্যুর চিরস্থায়ী রূপের কথা জানতে পেরেছিলাম। জেনেছিলাম আমার বাবা আর কোনো দিন আমাদের কাছে ফিরে আসবেন না। তখন আমি গভীরভাবে নিজের অস্তিত্বের সংকটে পড়ে গিয়েছিলাম।
বিখ্যাত লেখক কার্ল সেগান মৃত্যু নিয়ে বলেছিলেন, ‘এই মুহূর্তে তুমি কিন্তু জীবিত! এটা কিন্তু মোটেও সাধারণ কিছু নয়। একটা মানুষ জন্ম নেওয়ার রাস্তায় যে কতগুলো বাঁক আছে, সেই অসীম সম্ভাবনার কথা যখন চিন্তা করবে, তখন এই জীবনের জন্য আপনাআপনিই কৃতজ্ঞতা অনুভব করবে।’
জীবন চিরস্থায়ী নয় আর এ জন্যই বেঁচে থাকাটা এত সুন্দর একটা জিনিস; যার জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। জীবন যদি চিরস্থায়ী হতো, তবে এটা এত সুন্দর হতো না।
আমার বাবা সরকারি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। যে বয়সে বাবাকে হারিয়েছি তখনো বাবার ব্যক্তিত্ব বুঝে ওঠার বয়স হয়নি। আমার বাবাকে আমি চিনেছি অন্যের চোখ দিয়ে। এসএসসি পরীক্ষার সময় হঠাৎ একজন শিক্ষক এসে বললেন, ‘তুমি কি হান্নান স্যারের মেয়ে?’ আমি যখন হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলাম তখন তিনি আমার বাবাকে নিয়ে অনেক গল্প করলেন। জানতে পারলাম আমার বাবা তাঁর ইংরেজি ভীতি দূর করেছিলেন। তাঁর আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় কোচিংও করতে পারছিলেন না। তখন আমার বাবা কলেজের ক্লাসের পর তাঁকে ইংরেজি পড়াতেন বিনা পারিশ্রমিকে।
মুক্তিযুদ্ধের পর খাদ্যদ্রব্যের অনেক দাম বেড়ে গিয়েছিল। তখন আব্বা এলাকার অনেক মানুষের জন্য ভাত আর ডাল দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই গল্পগুলো সেই মানুষদের মুখেই শুনেছি। এ রকম অনেক ছোট ছোট গল্পের মাধ্যমে আমি আমার বাবাকে জেনেছি।
আমরা সন্তান হিসেবে বাবাকে কতটুকু সম্মান দিতে পেরেছি জানি না। এলাকার প্রতিবেশী থেকে শুরু করে বাবার সহকর্মী, ছাত্র সবার কাছ থেকে বাবার সততা আর অসাধারণ ব্যক্তিত্বের গল্প আমি শুনেছি। বাবার প্রতি তাদের যে সম্মান আমি দেখেছি, এই অসাধারণ সম্মান আমাকে ভাবিয়ে তোলে। মনে হয় বাবা মারা যাওয়ার পর এক প্রকার অমরত্ব লাভ করেছেন। হোক সেটা ছোট, মানবিক ও জাগতিক অমরত্ব। কিন্তু এটাই একমাত্র অমরত্ব যা একজন মানুষ পেতে পারে, যা আমার বাবাকে আমার চোখে একজন অসাধারণ মানুষে পরিণত করেছে।
...

রাহনুমা সুলতানা: সাইতামা, জাপান।