ভরা পূর্ণিমায় সূর্যোদয়

লাকি পিকে ভরা পূর্ণিমায় সূর্যোদয়। ছবি: কাওসার ফারহাদ
লাকি পিকে ভরা পূর্ণিমায় সূর্যোদয়। ছবি: কাওসার ফারহাদ

ভোরের আলো ফুটতে আরও প্রায় ঘণ্টা বাকি। সারা রাত জেগে থাকার পর একটা ক্লান্তি ভর করে শরীরে। তারপরও মনে হচ্ছিল একটা কিছু করা দরকার। আইডাহোর ছোট্ট শহর বয়েসিতে দিনগুলো শেষ হয়ে আসছে। সামার শুরু হয়েছে। দিনে রোদের তীব্রতায় চামড়া জ্বালাপোড়া করে। কিন্তু রাত নামলে ঠান্ডা হাওয়া বাড়তে থাকে। তবু একটা টি-শার্ট গায়ে চাপিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। গাড়িতে সব সময় একটা জ্যাকেট থাকেই। কাজে লাগলে গায়ে চাপিয়ে নেওয়া যাবে। বের হয়েই দেখি সেদিন ছিল পূর্ণিমা। ড্রাইভিং সিটটা যতটা সম্ভব নিচে নামিয়ে দিয়ে শরীরটা এলিয়ে দিলাম। রিলাক্স থাকার চেষ্টা করলাম। জানালা দিয়ে থালার মতো চাঁদ দেখা যাচ্ছে। এই শহরে চাঁদটা বড় দেখা যায়। হয়তো ভৌগোলিক কারণে।

উঠে বসে ইঞ্জিন স্টার্ট করলাম। সূর্যোদয় ধরতে হবে। যেতে হবে ৩০ মিনিট দূরে, লাকি পিকে। সেখানে আছে অনেকগুলো বিশাল বিশাল পাথুরে পাহাড়ঘেরা একটা লেক। লেকের পানিগুলোকে অন্ধকার কালো থেকে টলটলে নীল হওয়া দেখতে হবে। সঙ্গে একটা ঠান্ডা আক্ষেপ ভরা বাংলা গান। বাসার সামনের চেরি ব্লসম গাছটাকে গুডবাই বললাম। আমার কথা সে বুঝল কি না বোঝা গেল না। পার্কিং থেকে বের হতে গিয়ে সাবধান থাকতে হলো, ভাঙা কাচের গুঁড়ো পরে আছে মাটিতে। উঁকি দিয়ে দেখলাম ময়লার বাক্সের পাশের ছোট্ট জায়গাটায় আজ কে কী ফেলে গেল! অভ্যাস, যদিও আর কিছু লাগবে না। দুদিন পরে আমার জিনিসগুলোও এখানে ফেলে রেখে যেতে হবে। ডান পাশে পার্ক করা হলুদ জিপ গাড়িটা চুপটি করে বসে আছে অন্ধকারে। সকালের রোদ পড়লেই চিকচিক করে উঠবে স্বর্ণকেশীর গাড়িটা।

চুপচাপ, জনশূন্য, থমথমে একটা শহর। হুটহাট এক-দুটি গাড়ি দেখলে বোঝা যায় উবার চলছে। লালবাতিতে একাকী বসে আছি। দু-একটা নেড়ি কুকুর থাকলে ভালো হতো। প্রাণহীন মঙ্গলের মতো অবস্থা। এমন অবস্থায় এলিয়েনরা সত্যি যদি আক্রমণ করত, পিলে চমকে যেতাম। তবে হুট করে একটা গাড়ি ট্রান্সফর্মারস হয়ে গেলে সেই হতো। আরব্য রজনীর মতো চমকপ্রদ কিছু ঘটছে না। ছয় মিনিটের মধ্যে শহর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। গাড়ি এখন চলছে ঘণ্টায় ৬৫ কিলোমিটার গতিতে। এর আগে দুবার এই রাস্তায় এসেছি। প্রতিবারই ফেরার পথে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল, ঠিকমতো মার্কার বুঝতে না পারায় ঘুরে আসতে হয়েছে। ধীরে ধীরে স্পিড ৯০ ছুলো। শহরের শেষ বাড়িগুলো থেকে আসা আলোর ঝলকানি পেরিয়ে পাহাড়ের মাঝে ঢুকে গেলাম। এবার ম্যাপ অফ করে দিলাম, এই রাস্তা আমার পরিচিত। প্রতিটা বাঁক মুখস্থ। পূর্ণিমার আলোতে মেঘগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল। অন্ধকারে কুয়াশা নেমে এল না মেঘ আমি নিশ্চিত না। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০০০ ফুট বা আর বেশি উচ্চতায় আছি। এই উচ্চতায় কুয়াশাকে মেঘ বলা উচিত। কানে চাপ পড়ছে, ঢোক গিললে ঠিক হয়ে যাচ্ছে। কানে অস্বস্তি নিয়ে গান শোনা যায় না। এসিটা অফ করে, জানালাটা একটু নামিয়ে দিলাম। শোঁওওওও করে বাতাস ধেয়ে এল। এই বাতাস সহ্য করা যায় না বেশিক্ষণ, কান ধরে যায়। জ্যাকেটের অভাব বোধ করছি। গাড়ির পেছনের বক্সে আছে সেটা, গাড়ি থামানোর কোনো ইচ্ছা আমার নেই। শেষবারের মতো বুক ভরে শ্বাস নিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিলাম।

লাকি পিকে বিশাল বিশাল পাথুরে পাহাড় ঘেরা একটি লেক। লেকের পানিগুলোকে অন্ধকার কালো থেকে টলটলে নীল হওয়া দেখতেই ঘুরতে যায় অনেকেই। ছবি: কাওসার ফারহাদ
লাকি পিকে বিশাল বিশাল পাথুরে পাহাড় ঘেরা একটি লেক। লেকের পানিগুলোকে অন্ধকার কালো থেকে টলটলে নীল হওয়া দেখতেই ঘুরতে যায় অনেকেই। ছবি: কাওসার ফারহাদ

ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগে অদ্ভুত একটা ঘোলাটে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে মেঘের মধ্যে। পাহাড় থেকে ক্রমাগত নিচের দিকে ধেয়ে আসছে এরা। ১৫ মিনিট হয়েছে, পাড় বাঁধানো লেকের পাশে পৌঁছে গেলাম বা পাশে সবুজ পাহাড় অন্ধকারে মূর্তির মতো চুপচাপ, লেকের কালচে শান্ত পানি পূর্ণিমার আলোতে চিকচিক করছে। চারপাশটা কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভের মতো অনেকটা, বাম পাশে পাহাড়, ডানে সমুদ্র অথবা ঠিক যেমনটা ছোটবেলায় রোডরাশে খেলা প্যাসিফিক হাইওয়ের মতো! হঠাৎ চোখে পড়ল একরাশ মেঘ পাহাড় ফুঁড়ে বেরিয়ে এল, এত কাছে যেন হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেওয়া যাবে!

কিছু জনবসতি চোখে পড়ল কমপক্ষে এক হাজার ফুট নিচে, লেকের পানির কাছে। বাঁধ পেরিয়ে এলাম। এবার মেঘ আরও বাড়ছে। হিটার চালু করে দিতে হলো, সামনের কাচ অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। একটা ঘোর লাগা পরিবেশ, সূর্য উঠে যাবে আর একটু পরেই, হিমশীতল কুয়াশার মধ্য দিয়ে চাঁদের আলোয় ছুটে চলেছি। ব্রিজের কাছে পৌঁছে ডানে মোড় নিয়ে উঠে এলাম মূল লেকের রাস্তায়। সামনে একটা শার্প টার্ন আছে। স্পিড এখন ৩০-এ নেমে এসেছে। পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে বিশাল লেক দেখা দিয়ে দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে আবার। ধীর গতিতে ঢাল বেয়ে নেমে এলাম। লেকের পাড়ে পৌঁছে, গাড়ি পার্ক করে, জ্যাকেট চাপিয়ে নেমে এলাম পানির ধারে। শত শত হাঁস পাড়ে চুপটি করে বসে আছে। ভাসমান ডকের ওপর দিয়ে হেঁটে শেষ মাথায় এসে বসলাম। আলো ফুটতে শুরু করেছে কিন্তু চাঁদ এখনো ডুবেনি! থালার মতো পূর্ণিমার বিশাল চাঁদ মেঘের আড়ালে হারিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে আজ। সূর্যের আলো উঁকি দিচ্ছে। আধো আলো, আধো অন্ধকারে চাঁদের ছায়া পড়েছে পানিতে, সেই প্রতিচ্ছবিতে পানি জ্বল জ্বল করছে। আলো আরেকটু বাড়লে হাঁসগুলো পানিতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। অতি সতর্ক একটি হাঁস আগ বাড়িয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কেউ একটা পাখাও ঝাপটাচ্ছে না, যেন শব্দ করলে মাছগুলোর ঘুম ভেঙে যাবে! এক পাশের পানিতে সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করছে, আরেক পাশের টলটলে নীল পানি অলস, শান্ত। পাহাড়ের ওপরের মেঘগুলো একদম গায়েব! পাহাড়ের কোলজুড়ে থাকা শুকনো ঘাসের ওপরে এখন সোনালি রোদ উঠেছে!

*কাওসার ফারহাদ, যুক্তরাষ্ট্র