জয় হোক তোমাদের

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার দৃশ্য। ছবি: প্রথম আলো
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার দৃশ্য। ছবি: প্রথম আলো

আমরা বিশ্বকাপ নিয়ে মেতে আছি। আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের পতাকা উড়িয়ে সারা বাংলাদেশের আকাশ ছেয়ে দিয়েছি। বিশ্বকাপ নিয়ে আমাদের চেয়ে ঘোরের মধ্যে আর কোনো জাতি আছে বলে মনে হয় না। অথচ আমাদের চোখের সামনে মার খাচ্ছে নিরপরাধ নিষ্পাপ ছেলেমেয়েরা। নির্যাতিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণেরা। যারা এই দেশটাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। অথচ আমরা নির্বিকার। ফুটবল খেলার দর্শকদের মতো দেখে যাচ্ছি। অন্যায়-অবিচার সহ্য করতে করতে আমাদের সয়ে গেছে। কোনো কিছুই যেন আমাদের আর নাড়া দেয় না!

যে তরুণেরা রাস্তায় নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তারা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যা পিঠে পড়ে। অনেকে দিন-রাত টিউশনি করে হাজার কয়েক টাকায় মাস চালান। গণবাসে চড়ে ক্লাসে যান। হলের রুমে গাদাগাদি করে রাত কাটান। এই ছেলেগুলো কেউ হয়তো এসেছেন সোনাগাজীর গহিন গ্রাম থেকে। কেউ হয়তো এসেছেন মহেশখালীর দ্বীপ থেকে। কেউ হয়তো এসেছেন দুর্গাপুরের গাড়ো পাহাড়ের দুর্গম কোল থেকে। তাদের কারও কারও হয়তো বাবা নেই। কারও বাবা স্রেফ কৃষক। কারও কারও বাবা একটা চায়ের টং দোকান দিয়ে টেনে-টুনে সংসার চালায়। নয়তো বা কারও বাবা একটা সাদামাটা চাকরি করে সামান্য বেতনে ছেলেমেয়েদের খাওয়ান।
এই তরুণ ছেলেমেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে তাদের পরিবার। ওদের একটা চাকরির ওপর নির্ভর করে থাকবে কয়েকটি উদর। এই নির্যাতিত ছেলেগুলোর মাসোহারা দিয়ে বাঁচবে তার মা, বাবা, ভাই কিংবা বোন। এদের জীবনের প্রচণ্ড ঝড়গুলো কেউ দেখেন না। সমাজের চোখে হয়তো ঠিকমতো পড়েই না ওরা। তবুও ওরা পড়তে আসেন। বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। এদের চোখে স্বপ্ন দেখে আমার বাংলাদেশ।
এই তরুণেরা রাস্তায় নেমেছিলেন একটি অধিকারের জন্য। যে অধিকারের ছায়াতলে একটি ছেলেমেয়ে চাকরি পাবেন আত্মপরিচয়ের গৌরবে। কাউকে তার জাত, ধর্ম, জন্মজেলা, বর্ণ, লিঙ্গ, বংশপরিচয়, বাবার পরিচয় এগুলো নিয়ে উত্তর দিতে হবে না। এগুলো কেউ জিজ্ঞেস করতে পারবে না। মেধা ও যোগ্যতা ছাড়া অন্য কোনো পরিচয় যেন গৌণ হয়ে যায়। সে অধিকারের জন্য তারা রাস্তায় নেমেছিল। এর চেয়ে আধুনিক, এর চেয়ে সুন্দরতম ও যৌক্তিক দাবি, একুশ শতকের কোনো সমাজের জন্য হতে পারে না। সারা দুনিয়ার উন্নত ও আধুনিক দেশগুলো মানুষকে শুধুমাত্র তার মেধা, কর্ম ও প্রজ্ঞা দিয়ে মূল্যায়ন করে।

লেখক
লেখক

আমাদের দেশটায় যখন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধারা তখন রণাঙ্গনে গিয়েছিলেন সারা দেশের আনাচকানাচে থেকে। যোদ্ধাদের কেউ ছিলেন ছাত্র, কেউ শ্রমিক, কেউ কৃষক, কেউ বা চাকরিজীবী। রণাঙ্গনে তাদের সবার পরিচয় ছিল যোদ্ধা। তাদের পৃথক পৃথক পরিচয়ের ভিত্তিতে যুদ্ধে নেওয়া হয়নি। যুদ্ধে কোনো বৈষম্য রাখা যায় না। তাহলে যুদ্ধে জয়ী হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। একটি পতাকা আনতে হলে, ভৌগোলিক সীমানা আদায় করতে হলে রক্ত দিতে হয়। আর সেই পতাকা আর দেশ রক্ষা করতে হয় মেধা, শ্রম আর সততা দিয়ে। একটা দেশকে এগিয়ে নেওয়া ও এর স্বাধীনতার গৌরবকে ধরে রাখা একটা নিরন্তর যুদ্ধ। সে যুদ্ধে টিকে থাকার প্রধানতম শর্ত বৈষম্য বিনাশ। দুনিয়ার উন্নত দেশগুলো এই বৈষম্য বিনাশে নিরন্তর কাজ করছে। করে যাচ্ছে।
আজকের এই তরুণেরা সেই বৈষম্যকে কমিয়ে আনার জন্য রাস্তায় নেমেছিলেন। অথচ তারা মার খাচ্ছেন। নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।-এমন নিরপরাধ তরুণেরা আর কত মার খাবেন? কেনই বা মার খাবেন? আমাদের দেশ কী সে উত্তর দিতে পারবে? যে ছেলেগুলো মার খাচ্ছেন, তারা কিন্তু সমাজে একটা নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। যে মেয়েগুলো নির্যাতিত হচ্ছেন, তারা আমাদের চৈতন্যের আকালে ঢেউ তুলে যাচ্ছেন। যারা মার খাচ্ছেন, তারা সত্যি সত্যি একটি যুগের সূচনা করে যাচ্ছেন। কোনো কিছু হয়তো একদিনে হয় না, কোনো কিছু আবার চিরদিনের জন্যও অপেক্ষা করে না। যে অধিকারের জন্য তারা আজ রাস্তায় নেমেছেন, সে অধিকার এই বাংলাদেশেই আগামী দশ বছরে হবে। নয়তো বিশ বছরে হবে। নয়তো ত্রিশ বছরে হবে। কিন্তু হবেই হবে।
একজন মানুষ শুধুমাত্র তার মেধা ও যোগ্যতায় নিজেকে দাঁড় করাবে, বেঁচে থাকবে, এর চেয়ে সুন্দর কিছু মানুষের দুনিয়ায় খুব বেশি নেই। তোমরা সে সুন্দরের জন্য দাঁড়িয়েছ। জয় হোক তোমাদের!

ড. রউফুল আলম, গবেষক, যুক্তরাষ্ট্র। ইমেইল: <[email protected]>; ফেসবুক: <rauful15>