আটলান্টিকের কোলে পাথুরে পাহাড়

মেইনের বাতিঘর
মেইনের বাতিঘর

গ্রীষ্ম ও শরৎকালে (সামার ও ফল) যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃতি সেজে ওঠে নানা রঙে। দেশটিরর মধ্যবর্তী অঞ্চল ক্যানসাস থেকে আমরা কজন গত ১৫ জুন ছুটে গিয়েছিলাম প্রকৃতির খুব কাছে। ক্যানসাস, মিজৌরি ও ইলিনয় সীমানা পাড় হয়ে যত এগিয়ে যাওয়া ততই প্রকৃতির অফুরন্ত ভালো লাগা নুইয়ে পড়েছে।

আকাডিয়া ন্যাশনাল পার্কের চূড়ায় লেখক ও অন্যরা
আকাডিয়া ন্যাশনাল পার্কের চূড়ায় লেখক ও অন্যরা

যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলে আটলান্টিকের কোলে বিশাল পাথুরে পাহাড়ের গড়াগড়ি। পাথরের ফাঁকে-ফাঁকে সবুজ গাছের সমারোহ আর থরে থরে সাজানো প্রাকৃতিক সিঁড়ি। প্রকৃতি যেন ভ্রমণ পিপাসু মানুষের জন্য ৪৭ হাজার একরের এ বিশাল আকাডিয়া ন্যাশনাল পার্ক গড়ে তুলেছে। প্রতিদিন হাজারো উৎসুক মানুষের পদভারে গমগম করে এ পাহাড়ি অঞ্চল।
এতিহ্যবাহী শহর কলম্বাস হয়ে ওহাইও, নিউজার্সি, নিউহ্যামশ্যায়ার, নিউইয়র্ক, পেনসিলভানিয়া ও মেইন। আমাদের ইচ্ছা ছিল মেইন ছোঁয়া। কানাডার কাছাকাছি আমেরিকার সীমানা রাজ্য মেইন। পুরো রাজ্য জুড়ে সবুজের উৎসব। নির্জন, শান্ত, শুভ্র স্বচ্ছ লেকে স্থির দাঁড়িয়ে রয়েছে শত শত মাছ ধরার ফিশিং বোট। ঘোরানো প্যাঁচানো উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ। হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে মেইনে যাওয়ার পর এতটুকু মালুম হয়নি, একটু থামি। গাড়ি ছুটছে তো ছুটছেই। ৭০-৮০ মাইল স্পিড।

হোয়াইট মাউন্টেনের ওপরে ছবির তোলার মজাই আলাদা
হোয়াইট মাউন্টেনের ওপরে ছবির তোলার মজাই আলাদা

ঘুম ঘুম চোখে দেখা মিলল বনলতা আর বনফুলে জড়ানো শহর ফ্রেন্ডশিপ সিটি। যেখানে সবার থাকা-খাওয়ার আয়োজনসহ ভাড়া বাসা। বাড়িটির লাগোয়া ছোট্ট একটি বহমান খাল। জোয়ার-ভাটায় জলের খেলা চোখ জুড়ায়। ঘাটে বাঁধা রয়েছে ছোট্ট ডিঙি নৌকা। দুরন্ত-দুর্বার নাঈমকে কে ধরে রাখে। সোজা নৌকায় দাঁড় বেয়ে যাচ্ছে। ভয় ছিল, জোয়ারের টানে কিছু দূরে আটলান্টিকের উত্তাল ঢেউয়ে চলে যাওয়া।
সত্যিই যেন লতায়-পাতায় উদাসী বনে বসবাস। বাড়ির মালিক বলেছিলেন, মানুষের গন্ধ পেলে পাশের অরণ্য থেকে আদিবাসী মানুষের প্রেতাত্মা এসে পড়ে। সাহসী ছেলে প্রিন্স বলল, সন্ধ্যায় মিটিমিটি আলোয় আগুন জ্বালালে কেমন হয়। যে কথা, সেই কাজ। এমন জায়গায় ছিলাম, যেখান থেকে গাড়ি করে গেলেও কাঠ আনতে রাত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে চিমনির পাশে দুটি কাঠ পাওয়া গেল। আর পাশের বন থেকে শুকনো লতা-পাতা দিয়ে শুরু হলো আগুন জ্বালানোর কাজ।

স্টিফেন কিং-এর বাড়ি
স্টিফেন কিং-এর বাড়ি

রাত ৯টায় ডিনারের আয়োজন শেষ হলো। রাত কাটল সুনসান নীরবতায়। পরদিন সকালের নাশতা সেরে মেইন রাজ্যের ঐতিহাসিক বাতিঘর, ম্যস বন্দর ঘুরে দেখা। শহরের প্রতিটি বাড়ির সামনে নানা রঙের লবস্টার ধরার খাঁচা দেখা যায়। বলা যায়, পুরো শহরটি জেলে পাড়া। এ ফ্রেন্ডশিপ শহরের মানুষগুলো বন্ধুপ্রিয়। শহরকে ঘিরে রয়েছে ম্যস বন্দর। চোখে পড়ে রাস্তার ধারে মাটি ও পাথরে তৈরি মৃৎশিল্পের পরিপাটি দোকান।
পরদিন চলতি পথে আমাদের সঙ্গে থাকা শিশুশিল্পী জয়িতা দেবের আবদার রক্ষায় ছুটে যেতে হলো-তার প্রিয় লেখক স্টিফেন কিং এর শহর বেঙ্গোরে। স্টিফেন এডউং কিং। ভয়ংকর, অতিপ্রাকৃতিক উপন্যাস, সাসপেন্স, বিজ্ঞান কথাসাহিত্য ও ফ্যান্টাসি নিয়ে বই লিখে ও ফিল্ম তৈরি করে আমেরিকার তরুণ সমাজে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর নানা দেশে তাঁর লেখা ৩৫০ মিলিয়ন বই বিক্রি করা হয়েছে।

পাহাড়ের কোলে ঝরনা
পাহাড়ের কোলে ঝরনা

জয়িতা স্টিফেন কিং-এর লেখার দারুণ ভক্ত। দেড় হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বেঙ্গোর শহরের পোর্টল্যান্ড এলাকায় প্রিয় লেখকের সঙ্গে দেখা করতে ছুটে গিয়েছিল জয়িতা। স্টিফেন কিং-এর সঙ্গে দেখা করতে হলে প্রাইভেট এক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে দিন তারিখ নিয়ে দেখা করতে হয়। যথারীতি সবকিছু সেরেও পাঁচ মিনিট দেরি হওয়ায় লেখকের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি জয়িতা। তবুও অন্তত প্রিয় লেখকের বাড়ি দেখা ও একটি ছবি তোলা তো হবে। বাড়ির আঙিনায় সেকি অঝোর নয়নে কান্না জয়িতার। তার প্রিয় লেখক স্টিফেন এডউং কিং। স্টিফেনের লেখার স্টাইল তার ভালো লাগে। ইতিমধ্যে সে ১০-১৫টি বই শেষ করেছে। জয়িতা ক্যানসাস উচিটা শহরে কলেজিয়েট হাইস্কুলের অষ্টম গ্রেডে পড়ে। প্রিয় লেখক তোমার সঙ্গে একদিন দেখা হবে, এ সান্ত্বনায় ছাড়তে হলো বেঙ্গোর সিটি।

আটলান্টিকের ঢেউ আছড়ে পড়ে পাহাড়ের গায়ে
আটলান্টিকের ঢেউ আছড়ে পড়ে পাহাড়ের গায়ে

আটলান্টিকের পাশ ঘেঁষে আদিরূপে এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে বাতিঘর। এ বাতিঘর কয়েক শ বছরের ঐতিহ্য। যেকোনো পর্যটককে কাছ টানবে। একসময় আটলান্টিকের উত্তাল সমুদ্র পথযাত্রীরা বাতিঘর দেখে নোঙর করতেন। তখন থেকে এসব সমুদ্র অঞ্চলে বাতিঘরগুলো বেশ পরিচিতি লাভ করে। পর্যটকেরা বেশ আনন্দে এর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
হোয়াইট মাউন্টেন মেইন রাজ্যের একটি অংশে শুরু। নিউ হ্যামশ্যায়ার জুড়ে এ পাহাড়ের অবস্থান। একদিকে নিউইয়র্ক-বোস্টন অন্যদিকে মন্ট্রিয়েল, কানাডা পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রায় দুই হাজার ফুট ওপরে উঠতে গা ঝিম ধরে যায়। গহিন অরণ্য। নানা জাতের বন্য পশু-পাখির দেখা মেলে। সবুজ গাছে ঢাকা পাহাড়। সূর্যের আলো গাছের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে খুব কষ্ট করে। কাঠের তৈরি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হাত দিয়ে ধরা যায় হিমশীতল জলের ঝরনা। যুগ-যুগান্তরের এ ঝরনা আবহমানকাল ধরে হোয়াইট মাউন্টেনে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। পাহাড়ের ভেতরে দেখা যায় ইয়া বড়-বড় পাথর। যা দেখে অনুমান করা যায়, এটি শুধু পাহাড় নয়, অন্য কিছু! গাছের ফাঁকে পাহাড়সম পাথর।
এত দূর পাহাড়ি পথ। ক্লান্তি সেখানে স্পর্শ করে না। শুধু ছুটে চলা পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে।

এমরান হোসাইন: ক্যানসাস, যুক্তরাষ্ট্র।৥