মেঘ রোদ্দুরের খেলা-চার

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শীতের পাতাহীন ওক গাছের ফাঁক গলে সকালের যে রোদটা বাসার ভেতর রোদ ছায়ার খেলা করছিল, তা তখন অনেকটাই মিইয়ে গেছে। রোদ নেই। ছায়ার খেলাই বেশি।

রাকিব দরজার ফাঁক গলে আকাশে দৃষ্টি ফেলল। দক্ষিণের আকাশে খানিকটা মেঘ করে এসেছে। ধূসর মেঘ। এখনো মেঘটা ঘন হয়ে আসেনি। নিউজিল্যান্ডের আবহাওয়ার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই রোদ, এই মেঘ, এই বৃষ্টি। মাঝে মধ্যে রোদবৃষ্টির বড্ড বেশি লুকোচুরি খেলা।
মেঘের ছায়ায় বাসার সামনের পিচঢালা পথটা মাজা ছাই রং ধারণ করেছে। পথের দুই পাশে সারি সারি ম্যাপল গাছ। শীতের আগুনরঙা অসংখ্য ম্যাপল গাছের ঝরাপাতা ফুটপাতের ওপর বিছিয়ে থেকে ফুটপাতকেও করেছে আগুনরঙা। সাধারণত হ্যামিল্টন শহরে কখনো তুষারপাত হয় না। মধ্য শীতে কোনো রাতে তাপমাত্রা শূন্যের নিচে গেলে সকালে লনের ঘাসের ওপর ফ্রস্ট বা হালকা স্তরের বরফ পড়ে। খুব সকালে উঠে জুতো পায়ে এই বরফের ওপর দিয়ে হাঁটতে গেলে কেমন অন্যরকম এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। জুতোর তলায় বরফ ভাঙে মচ ম-য়-চ, মচ-য়-চ, মচ ম-য়-চ!
রাকিব এসব অনুভূতির ভেতর ভাঙে।
তার এই অনুভূতিগুলো একান্তই নিজস্ব অনুভূতি। ছোট্ট থেকে ছোট্টতর, সূক্ষ্ম থেকে অতি সূক্ষ্ম। বরফ ভাঙার এই অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতর আরেকটা অনুভূতি বিচরণ করে। সে শীতের বিকেলে যখন একাকী কোনো ফুটপাত ধরে হাঁটে। বিকেলের মরা রোদে সে শীতের কাপড় পরে ম্যাপল ট্রির ঝরাপাতাগুলো মাড়িয়ে অনেক দূর হেঁটে যায়। ফুটপাতের পর ফুটপাত। এক রাস্তার পর অন্য রাস্তা। ছায়াঢাকা ম্যাকফার্লেন স্ট্রিট, দিঘল গ্রে স্ট্রিট, ওয়েলিংটন স্ট্রিট, কবহাম ড্রাইভ, হ্যামিল্টন গার্ডেন, মেমোরিয়াল ড্রাইভ, কুক স্ট্রিট, স্টিল পার্ক, ওয়াইকাটো নদীর পাথর ভাঙা খাঁজকাটা পাড়।
আতিক টোস্ট করা ব্রেডের স্লাইসগুলো খাচ্ছে বেশ শব্দ করে। অনেকটা পাতলা বরফ ভাঙার শব্দের মতো। মচ মচ, ম-য়-চ ম-য়-চ, মচ-মচ।
রাকিব বাইরে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে আতিকের দিকে তাকাল।
কফি কাপ দুটো থেকে ধোঁয়া উঠছে স্পষ্ট সরু সরু রেখা করে। কফির কাপ দুটোর মাঝখানে এই সপ্তাহের একটা কমিউনিটি নিউজ পেপার। পাশে বাসার বিদ্যুতের বিল ও আতিকের ক্রেডিট কার্ডের বিল। টি-টেবিলের নিচে বেশ কিছু বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনের ফ্লায়ার ও ব্রশিউর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
রাকিবকে চুপ হয়ে থাকতে দেখে আতিক জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার দোস্ত, তুমি খাচ্ছ না যে?
রাকিব মৃদু হাসল। বলল, খেলাম তো, আর খেতে ইচ্ছে করছে না।
—খেলে তো মাত্র একটা ব্রেড। ডিমেরও অর্ধেকটা রয়ে গেছে। ডিম ভাজাটা কি ভালো হয়নি?
—হয়েছে মোটামুটি। ঝালটা একটু বেশি হয়েছে।
—ঝাল বেশি হয়েছে, কী বলো! আমার তো মনে হয় তোমার কামড়ে মরিচ পড়েছে।
—হুম, হয়তো।
—মরিচটা ডেফিনেটলি ধাউন্যা মরিচ। বলে আতিক হি হি হি হি করে হাসতে থাকল।
ধাউন্যা মরিচ। রাকিব মৃদু হাসল। অনেক দিন পর সে এই শব্দটা শুনল। গরম ভাতের সঙ্গে ধাউন্যা মরিচ আর রসুন বাটা ভর্তা তার দাদির খুব প্রিয় খাবার ছিল। তার দাদি দুপুরে গরম ভাতের সঙ্গে সয়ে সয়ে ধাউন্যা মরিচ-রসুন বাটার ভর্তা খেতেন। ছোটবেলায় দাদির সঙ্গে থাকতে থাকতে তারও সেই অভ্যাসটা হয়েছিল। কিন্তু ছোট চাচি আসার পর সেই অভ্যাসটা আর থাকেনি।
আতিকের হাসির প্রতি উত্তরে রাকিব মৃদু হাসল, মুখে কিছু বলল না। সে আবার বাইরে তাকাল।
আতিক তার চার স্লাইস ব্রেড শেষ করে পিরিচে পড়ে থাকা বাকি ডিমটা এখন চামচ দিয়ে নাড়ছে। চামচ আর পিরিচের শব্দ হচ্ছে টুং টাং, টুং টাং। দেয়াল ঘড়িটায় সেকেন্ডের কাটার শব্দ হচ্ছে টিক টিক টিক টিক। কিচেনে ফ্রিজের শব্দ হচ্ছে ওম-ম-ম-ম।
রাকিব বাইরে থেকে দৃষ্টিটা টেনে এনে সেদিকে তাকাল।
আতিক হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, দোস্ত, তোমার কি কোনো কারণে মন খারাপ?
রাকিব তাড়াতাড়ি বলল, নাহ, নাতো!
—না মানে, তোমাকে বেশ অন্যমনস্ক লাগছে তো?
—তাই নাকি?
—হ্যাঁ, তোমার আবার কবিতার ভাব-টাব আসেনি তো?
রাকিব হাসল। একটু শব্দ করেই হাসি। বলল, ভালোই বলেছ। আর কবিতা!
আতিকও সায় দিয়ে হাসল। বলল, দোস্ত, তোমার যুবতীদের নিয়ে কঠিন কবিতাটার কথা মনে পড়ে গেল। কী যেন লাইনগুলো!

‘বুবুদের গতরের উঁচু ভাঁজ
যুবতী নাভির কোষ বেয়ে নেমে যায়
কোনো গভীর অকূল ধারায়, সমুদ্র হয়!’ ...

রাকিব আবার হাসল। তবে শব্দ করে নয়।
আতিক বলল, জব্বর কবিতা।
রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল।
আতিক কফি কাপে চুমুক দিয়ে কী বলতে গিয়ে চেয়ারের পেছনে গাটা ছেড়ে দিতে যায়। ঠিক তখনই চেয়ারটা বিজাতীয় একটা শব্দ করে উঠল ক্যাঁআআত।
ওরা ‘ট্রেড-মি’ ইন্টারনেট অকশন থেকে এসব চেয়ার, ডাইনিং টেবিল, টি-টেবিল, লাউঞ্জ সুইট, এমন কী বেড সুইটগুলো কিনেছে। সেকেন্ড হ্যান্ড। খানিকটা পুরোনো। নড়াচড়া বা একটু বেকায়দা হলেই ওগুলো এমন বিজাতীয় শব্দ করে।
রাকিব জিজ্ঞেস করল, চেয়ারটা আবার ভেঙে পড়ে যাবে নাতো?
আতিক হাসল, হে হে হে হে। বলল, সময় ঘনাইছে।
রাকিব সায় দিয়ে বলল, হুম, ঠিক বলেছ। এবার কিনলে সব নতুন কিনব।
—কি, বিয়েশাদি করবে নাকি?
—তোমাকে বলেছে। আগেরটার ক্ষতই শেষ হয়নি। আবার নতুন করে!
আতিক মাথা ঝাঁকাল। কিছু বলল না।
বাইরে বাতাস বইতে শুরু করেছে। শীতের হিন হিন বাতাস।
রাকিবের দৃষ্টি আবার বাইরে গেল। বৃষ্টি পূর্বক্ষণে মেঘলা আকাশের ছায়া যেমন ঘন ধূসর হয়। বাইরের পরিবেশটা ঠিক তেমনই হয়ে উঠেছে। মেঘের ঘন ধূসর ছায়ায় পিচের রাস্তাকে করেছে আরও ঘন ধূসর। ম্যাক ফার্লেন স্ট্রিট ধরে মাঝে মধ্যে দু-একটা গাড়ি আসা যাওয়া করছে। ফুটপাতের পাশের একটা শীতের পাতাহীন ম্যাপল গাছে কয়েকটা চড়ুই পাখি ওড়াউড়ি করছে। জানালা গলে সেই চড়ুই পাখিগুলোর ডাকার শব্দ আসছে—কিচ কিচ, কিচিরমিচির, কিচিরমিচির, কিচ-কিচ!
চড়ুই পাখিগুলো দেখে রাকিবের তৎক্ষণাৎ বেশ কয়েক বছর আগের একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেল। বাংলাদেশের অনেক পাখিই নিউজিল্যান্ডে চোখে পড়ে না। রাকিব এই দশ বছরে শুধু চড়ুই, শালিক আর দু-একবার ঘুঘু পাখি দেখেছে। একবার এমেন্ডাকে নিয়ে তাওপো শহর থেকে হেস্টিংস শহরে যাওয়ার পথে ডেজার্ট রোডে পাশে বেশ কয়েকটা কাক দেখেছিল। সাদা কাক। অবশ্য এখানে অসংখ্য বন্য বালিহাঁস, বন্য কবুতর আছে।
আতিক হঠাৎ কী ভেবে চেয়ারের পেছন ছেড়ে হাতের কফি কাপটা টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, দোস্ত, তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি।
রাকিব বাইরে থেকে দৃষ্টি এনে আতিকের দিকে সরাসরি দৃষ্টিতে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, কি?
আতিক বলল, এক ভদ্রমহিলা তোমাকে খুঁজছেন। কাল বিকেলে একবার ফোন দিয়েছিলেন। সন্ধ্যার পর আরেকবার। হয়তো রাতেও দিয়েছিলেন। আমি তো কাজে চলে গিয়েছিলাম।
রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হুম।
—তোমার সাথে কি কথা হয়েছে?
—হ্যাঁ, হয়েছে।
—ভদ্রমহিলা মনে হয় অস্ট্রেলিয়া থেকে ফোন দিয়েছিলেন।
—আমি জানি।
—ভদ্রমহিলা কে? তোমার ছোট ফুফু না। আমি তো তার গলা চিনি। তার সঙ্গে আমার বেশ কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে।
—আমার মা।
—তোমার মা?
—হ্যাঁ, আমার মা।
—অস্ট্রেলিয়ায় তোমার মা থাকেন? বলো কী!
রাকিব কিছু বলল না।
আতিক অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, তোমার কেমন মা?
রাকিব বলল, কেমন মা মানে? বায়োলজিক্যাল মা।
—বায়োলজিক্যাল মা মানে?
—বায়োলজিক্যাল মা মানে আমার আপন মা। আমার জন্মদাত্রী মা।
আতিক কিছুটা বিরক্ত হলো। বলল, দোস্ত, তোমাকে আর ট্রান্সলেট করে বলতে হবে না। আমি জানি, বায়োলজিক্যাল মা মানে জন্মদাত্রী মা।
রাকিব চুপ হয়ে গেল।
আতিক মাথা নাড়ল। বলল, তোমার জন্মদাত্রী মা আছেন?
—কেন, থাকতে নেই নাকি?
—না মানে। ও কথা বলছি না। দোস্ত, তুমি তো একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলে, তোমার মা নেই। তোমার বয়স যখন পাঁচ কী ছয় বছর, তখন থেকে নেই। মারা গেছেন।
রাকিব বলল, আমি কখনো কাউকে বলিনি আমার মা মারা গেছেন। বলেছি, নেই। আমার মা নেই।
আতিক জিজ্ঞেস করল, কথাটা কি এক বোঝায় না?
—না, এক বোঝায় না।
—তাহলে কি?
—কারও চলে যাওয়া আর মারা যাওয়া এককথা নয়। আমি হয়তো বলেছি, তিনি চলে গেছেন।
—থাক ওই কথা। আচ্ছা দোস্ত, আমরা একে অপরকে চিনি প্রায় পাঁচ বছর হলো। এই পাঁচ বছরে তুমি তোমার বাবার কথা অনেক বলেছ। কিন্তু কোনো দিন তো তোমার মার প্রসঙ্গ টানোনি?
—প্রসঙ্গ আসেনি, হয়তো তাই।
—এর আগে তো ওনাকে কোনো দিন ফোন দিতেও শুনিনি?
—আমার ফোন নম্বর জানতেন না, তাই।
—এখন তিনি জানলেন কীভাবে?
—তা কী করে বলব, আমি জানি না।
—উনি অস্ট্রেলিয়াতে আছেন কত দিন?
—তা-ও জানি না।
—স্ট্রেঞ্জ! ব্যাপারটা একটু অ্যাবসার্ড মনে হচ্ছে না?
রাকিব কিছু বলল না।
বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি। রাকিবের দৃষ্টিটা তৎক্ষণাৎ বাইরে গেল। মুহূর্তেই পিচের রাস্তাটা ভিজে গেছে। ধূসর ফুটপাত, সবুজ ঘাস, ফুটপাতের পাশের বাড়িগুলোর রং করা টালির ছাদ, দূরের বাস শেল্টার এবং পাতাহীন শীতের সারি সারি ম্যাপল গাছগুলো ভিজতে ভিজতে কেমন বিমর্ষ যুবতীর রূপ ধারণ করল। ম্যাপল গাছের সারিতে এলোমেলো কয়েকটা চিরহরিৎ গাছ। বৃষ্টির সঙ্গে পাতার তাড়নায় চিরহরিৎ গাছগুলো অনবরত মাথা নাড়ছে শীতের কাঁপুনি দিয়ে—তির তির, তির তির।
বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়েছে সামনের ব্যালকনিতে, কাচের জানালায়। জানালার ফাঁক গলে লিভিং রুমে বৃষ্টি ভেজা শীতের হিন হিন বাতাস ঢুকছে।
রাকিব উঠে দাঁড়াল। শরীরের আড়মোড়া ভেঙে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে জানালার পাটগুলো বন্ধ করে দিল। তারপর ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসতে বসতে কী ভেবে একবার মাথা নাড়ল। আতিকের দিকে তাকিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে জিজ্ঞেস করল, এবার তোমার কথা বল।
—আমার কোন কথা?
—ওই যে, কতক্ষণ আগে কিচেনে বলছিলে, ব্লন্ডিগার্ল...।
—ও আচ্ছা! আতিক শব্দ করে হেসে ফেলল। ও তো গতানুগতিক কথা। নিউজিল্যান্ডের সাদা চামড়া সব মেয়েরাই তো ব্লন্ডি।
—না মানে, মাউরি মেয়েও তো আছে?
—ওরা কি মেয়ে নাকি? একেকটা হাতি।
—নাহ, ওদের অনেকে বেশ সুন্দরী আছে। একজন মেয়ে মোটা হলেই অসুন্দর হবে, ওটা তোমাকে কে বলেছে?
আতিক মৃদু হাসল। বলল, না কেউ বলেনি। আচ্ছা, ও কথা বাদ দাও দোস্ত। এখন কেন জানি ওই সব কথা আলাপ করতে মুড আসছে না।
রাকিব মাথা ঝাঁকাল। এমনি বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে। ওই সব আলাপ করার দরকার নাই। অন্য প্রসঙ্গে আলাপ করি।
—অন্য কি প্রসঙ্গ?
—তুমি কি আমার মার প্রসঙ্গটা নিয়ে আলাপ করতে চাও?
—তোমার যদি ইচ্ছে হয়?
—এ মুহূর্তে আমার আসলেই ওই প্রসঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছে করছে না। আমি নিজেও একটা বিভ্রান্তির মধ্যে আছি। এ প্রসঙ্গে তোমার সঙ্গে আরেকদিন আলাপ করব।
—আচ্ছা, ঠিক আছে।
—চল দেশের প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করি। তোমার মার শরীরের অবস্থা এখন কেমন?
—ওই আগের মতোই। বোঝই তো, ক্যানসারের রোগী। সমস্যা এখন আমার বাবাকে নিয়েও হয়েছে।
—তোমার বাবার আবার কি হয়েছে?
—মার অসুখের খরচ টানতে টানতে নিজেই অসুস্থ হয়ে গেছেন। তিনি নিজেও তো হার্টের রোগী। রিটায়ার্ড পারসন। শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও তিনি খুবই ভেঙে পড়েছেন। বোঝই তো, বেসরকারি হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন, রিটায়ারমেন্টের পর পেনশন বলতে কিছুই পাননি। সারা জীবনের জমানো টাকার পুরোটাই মার চিকিৎসার পেছনে খরচ করে ফেলেছেন। এখন আমাদের জমি-জমার ওপর হাত পড়েছে।
—তুমি নিজেও তো ওসব উল্টাপাল্টা খরচ না করে টাকাপয়সা একটু বেশি করে পাঠাতে পার।
—উল্টাপাল্টা খরচ কি আমি খুব বেশি করি, রাকিব?
—বেশি না করলেও যতটুকু করো, তা না করলেও পার।
—ওসব কি আর শখে করি? মনে শান্তি নাই, ওজন্যই করি। মনের অস্থিরতা কাটানোর জন্য করি।
—আমি জানি আতিক। আমি বুঝতে পারি।
আতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা ঝাঁকাল। খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে কফির কাপটা নাড়তে শুরু করল। অযথাই কফি কাপে আঙুলের টোকা মারল, টুং-টুং, টুং-টুং। একবার বাইরে তাকাল। তারপর দৃষ্টিটা ভেতরে এনে বলল, রাকিব, ক্যানসারের রোগের কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা আছে? যত দিন মা বাঁচবেন শুধুমাত্র আয়ুর জন্য বাঁচবেন। চিকিৎসা করানোটা একটা সান্ত্বনা মাত্র। কেমো নিচ্ছেন। কিন্তু দোস্ত, আমাদের পরিবারে আরও বড় ধরনের নতুন সমস্যা এসে ভিড় করেছে।
রাকিব জিজ্ঞেস করল, কি সমস্যা?
—আমার ইমিডিয়েট ছোট বোনটার স্বামী, তার মাথায় নিউজিল্যান্ড আসার ভূত চেপেছে।
—নিউজিল্যান্ড আসতে পারলে তো ভালোই। এতে সমস্যা কোথায়?
—কী যে বলো না, সে কী তার নিজের টাকায় আসবে?
—ও, তাহলে?
—আরে, সে গত কয়েক মাস ধরেই আমাদের পরিবারের ওপর চাপাচাপি করছে। মাসখানেক হলো আমার বোনকে তার দুই সন্তানসহ আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন আমার অসুস্থ বাবা-মাকে হুমকি দিচ্ছে, তাকে যদি নিউজিল্যান্ড নিয়ে আসার ব্যবস্থা না করি, তাহলে সে আমার বোনকে আর তুলে নিয়ে যাবে না। প্রয়োজনে ডিভোর্স দেবে!
—তোমার বোন জামাই কি করে?
—আমাদের বাড়ির কাছাকাছি রামচন্দ্রপুর বাজারে সার ও কীটনাশকর ডিলারশিপ ছিল। বছরখানেক আগে কী কারণে যেন তার সেই ডিলারশিপ বাতিল হয়ে যায়। আসলে আমার বোন জামাইটা একটা অপদার্থ টাইপের মানুষ। জীবনে সে অনেক কিছুতেই হাত দিয়েছে। ব্যবসার নাম করে আমাদের পরিবার থেকে বেশ কয়েকবার টাকাপয়সাও নিয়েছে। কিন্তু কোনো কিছু সে দাঁড় করাতে পারেনি।
—তাহলে তো খুবই সমস্যা।
—হ্যাঁ, বিরাট সমস্যা।
—এখন কি করবে ভাবছ?
—জানি না। আচ্ছা, তুমিই বলো, আমি কি করতে পারি? আমার দ্বারা কি সম্ভব, কোনো দালাল ধরে পনেরো-বিশ লাখ টাকা খরচ করে তাকে নিউজিল্যান্ডে নিয়ে আসা? কাজ করি তো একটা একটা সার্ভিস স্টেশনে। আমার বেতনই বা কত? এমনিতেই মাসে মাসে মায়ের চিকিৎসার জন্য দশ-বিশ হাজার টাকা যা পারি পাঠাই!
রাকিব সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকাল। তার হয়তো আতিকের মতো এ রকম পরিস্থিতি নেই। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার মতো কোনো কারণও নেই। তবুও সে জানে, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষগুলোর বিশ্বাস, নিউজিল্যান্ড বা এসব উন্নত দেশগুলোতে টাকাপয়সা গাছে ধরে বা বাতাসে ওড়ে। শুধু ধরতে পারলেই হয়। কিন্তু ওরা জানে না, এখানে একেকজন মানুষ কী রকম পরিশ্রম করে এবং কী কষ্ট করে একটা একটা ডলার সঞ্চয় করে!
আতিক জিজ্ঞেস করল, দোস্ত, এখন কি করি বল তো?
রাকিব বলল, তোমার বোনের স্বামীকে ভালো করে বোঝাও।
আতিক দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে মাথা নেড়ে বলল, দোস্ত, এটাই তো সমস্যা। একজন সম্পূর্ণ অশিক্ষিত মানুষকে কোনো কিছু বুঝিয়ে বলা যায়। কিন্তু যারা লেখাপড়া জানা আধাশিক্ষিত, তাদের কোনো কিছু বোঝানো যায় না। এ রকম আধা শিক্ষিতরা চোখ খোলা রেখে ঘুমায়, চোখ খোলা রেখে স্বপ্ন দেখে।
আতিকের যুক্তিতে রাকিব মনে মনে হাসল। কিন্তু সে মনের হাসিটা ঠোটে টেনে আনল না। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ডকোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইলঃ <[email protected]>