ক্যালগেরি স্ট্যামপিড

মেলায় দর্শকদের একাংশ
মেলায় দর্শকদের একাংশ

বাসা থেকে বের হতে হয়েছে সকাল সকালই। তা না হলে উপায় আছে? সেদিন যে রোববার, বন্ধের দিন। বানের জলের মতো লাখো মানুষের ঢল নামবে নিশ্চিত। ‘দ্য গ্রেটেস্ট আউটডোর শো অন আর্থ’ বলে কথা। বাদবাকি দুনিয়া জানুক বা না-জানুক, কানাডীয়রা বিশেষ করে ক্যালগেরিয়ানরা এভাবেই বলেন। শতাব্দী ধরে বলতে বলতে একটা ব্রান্ড হয়ে গিয়েছে নামটি। ক্যালগেরি স্ট্যামপিড শতাব্দী-প্রাচীন মেলা। মেলা কিন্তু আমাদেরও আছে—বৈশাখী মেলা, বাণিজ্য মেলা, কৃষি মেলা আরও কত! আড়ং শুনলেই রাজা চক্করে চড়তে ইচ্ছে করে। দেশের আনাচকানাচে বিভিন্ন পার্বণে নানারকম মেলার সমাহার রয়েছে। কিন্তু ক্যালগেরি স্ট্যামপিডের আমেজই আলাদা। ভাষায় বর্ণনা করে এর পুরো পরিচয় দেওয়া কঠিনই আসলে।

ক্যালগেরি স্ট্যামপিড শতাব্দী-প্রাচীন মেলা
ক্যালগেরি স্ট্যামপিড শতাব্দী-প্রাচীন মেলা

শুধু কানাডা নয়, সারা বিশ্বেই কম-বেশি পরিচিত স্ট্যামপিড। তাই পৃথিবী অনেক দেশ থেকেই পর্যটক হুমড়ি খেয়ে পড়েন ক্যালগেরিতে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে। এক শ বছর পার হয়েও মেলা এখনো চির যৌবনের মতো। দিন দিন এর জৌলুশ আরও খোলতাই হচ্ছে। আগের ছয় দিনের কর্মযজ্ঞ এখন বাড়তে বাড়তে দশ দিনে গিয়ে ঠেকেছে। তারপরও মানুষের ঢল বাড়ছে। বছর দুই আগে সব মিলিয়ে পনেরো লাখ দর্শনার্থী ছিল মেলায়। সেবার প্রিন্স উইলিয়াম আর তার বউ কেট এসেছিলেন। তাই মেলার প্রথম দিনের ঐতিহ্যবাহী প্যারেড দেখতেই সোয়া চার লাখ মানুষ এসেছিলেন। অথচ পুরো ক্যালগেরির লোকসংখ্যাই ১২ লাখ। স্ট্যামপিডের মাহাত্ম্যই এমন।
বের হয়েছি পায়ে বুট, ব্লু জিনস, চেক শার্ট আর মাথায় হ্যাট দিয়ে। কাউবয় হওয়ার চেষ্টা। স্ট্যামপিডের আবহই এ রকম—ওয়েস্টার্ন মুভির সেই ক্লিন্ট ইস্টউডিয় সাজ। অবশ্য এই মেলার সঙ্গে কৃষিটাও জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গিভাবে। তাই কাউবয় আর কৃষিপণ্য প্রদর্শনী স্ট্যামপিডের মূল থিম। বর্তমানে এর মধ্যে বাণিজ্য ঢুকে গিয়ে নানারকম পসরা চলে এসেছে। মূল অনুষ্ঠান স্ট্যামপিড প্যারেড, ঘোড় দৌড়, কৃষির পসরা তেমনি আছে। অধিকন্তু স্টেজ শো, কনসার্ট, মিডওয়ে যোগ হয়েছে।

নাশতার কর্মযজ্ঞ
নাশতার কর্মযজ্ঞ

বোধ করি মিডওয়েই এখন সবচেয়ে জনপ্রিয়। মিডওয়ে ব্যাপারটা ঠিক খোলা রাস্তার পাশে টং আয়োজনের মতো। নানারকম স্থানীয় খাবারের দোকান, বিভিন্ন কার্নিভাল গেম, থিম পার্কের সব অ্যামিউজমেন্ট রাইড, আরও অনেক কিছু আছে এই মিডওয়েতে। দুঃসাহসিক মোটরসাইকেল চালানো প্রদর্শনী দেখলে গায়ের রোম সব দাঁড়িয়ে যায়। মেলায় কানাডিয়ান সামরিক বাহিনীর জন্যও একটা এলাকা বরাদ্দ আছে। সেখানে বিমান-ট্যাংক-মিসাইল-সাঁজোয়া যান নিয়ে তারা মাতিয়ে রাখেন দর্শকদের।

নাশতার জন্য লাইন
নাশতার জন্য লাইন

মনোমুগ্ধকর প্রদর্শনী দেখেছি কানাডার আদিবাসী গোষ্ঠীরও। তারা হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য-লালিত সংস্কৃতি চমৎকার করে ফুটিয়ে তোলেন দর্শকদের কাছে। আদিবাসী সংস্কৃতি যে কত সমৃদ্ধ, কত পরিপূর্ণ, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। মিউজিক আর নৃত্যের তালে তালে একটার পর একটা সমৃদ্ধি-সম্ভার প্রদর্শন করেন তারা। আমরা যারপরনাই মুগ্ধ, বিমোহিত।

স্ট্যামপিড আউটফিট
স্ট্যামপিড আউটফিট

না খেয়েই বের হয়েছিলাম সকালে। ফ্রি নাশতা আছে যে! মাগনা পেলে আমরা আলকাতরা খাই। আর এত সুস্বাদু প্যানকেক। গোটা তিনেক নিয়ে নিলাম ঝটপট। সঙ্গে ম্যাপল সিরাপ। খাদ্য হিসেবে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেখানে-সেখানে যখন-তখন যা কিছু খেতে পারি না। যেমন মাগনা হলেও এদের বিফ সসেজটা আমাদের জন্য নিষিদ্ধ। সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য যাই হোক, হালাল ব্যাপারটা মেনে চলার দায় আছে আমাদের। তবে আমরা আশ্চর্য অন্যখানে। প্রায় তিরিশ হাজার দর্শনার্থীকে মাগনা নাশতা খাওয়াল। লম্বা লাইন ধরে ঘণ্টা পার করে নাশতার প্লেট হাতে নিয়ে তাজ্জব হলাম। এতগুলো মানুষকে খাওয়াচ্ছে অথচ কোনো বিশৃঙ্খলা নেই।
মেলার ছন্দে আনন্দ-হর্ষে দিন পার। তবে দিন শেষে উপরি হিসেবে দুটো উপার্জন—দুর্মূল্যে পকেট খালি আর সারা দিনে হাঁটতে হাঁটতে পা টনটন।

আবু সাইদ লিপু: ক্যালগেরি, আলবার্টা, কানাডা