দেশের সেই কোলাহলটাই মিস করি

ওয়াশিংটন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরম ক্যাম্পাস। চূড়ায় বরফ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাউন্ট সেন্ট হেলেন এই ক্যাম্পাসকে দিয়েছে অপরূপ সৌন্দর্য
ওয়াশিংটন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরম ক্যাম্পাস। চূড়ায় বরফ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাউন্ট সেন্ট হেলেন এই ক্যাম্পাসকে দিয়েছে অপরূপ সৌন্দর্য

ভৌগোলিকভাবে আমাদের দেশের ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থিত বলে আমেরিকার বেশির ভাগ জিনিসই আমাদের থেকে ভিন্ন। প্রথম প্রথম যাই দেখতাম অবাক হতাম আর চিন্তা করতাম আমরা এখনো কোথায় পড়ে আছি। যা হোক। উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে আমেরিকা আসার প্রায় এক বছর হয়ে গেল। শুরুর দিকে অস্বস্তি আর দম বন্ধ মনে হলেও ধীরে ধীরে সবকিছুর সঙ্গেই মানিয়ে যাচ্ছি। ভাবলাম আমেরিকান জীবনে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার আগেই কিছু লিখে ফেলি।

প্রথমে এসেই এদের অতি আধুনিক ট্রাফিক সিস্টেমের সঙ্গে পরিচয়। ট্রাফিক সিগনালে আমাদের দেশের মতো নেই কোনো পুলিশ। অটোমেটিক বিভিন্ন লাইট জ্বলে আর গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। পথচারী রাস্তা পার হতে গেলে সিগনাল টিপে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কিছুক্ষণ পরে পথচারী পারাপারের সিগনাল জ্বলে আর ডিসপ্লেতে রাস্তার প্রশস্ততা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হয়। ওই সময়ের মধ্যেই রাস্তা পার হওয়া লাগে। এখানে সচরাচর কেউ নিয়ম ভঙ্গ করেন না। ভঙ্গ করলে নিজেরই বিপদ। অন্য দিকের গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ছোট ছোট যেসব রাস্তায় সিগনাল নেই, সেখানে পথচারীই পথের রাজা। পথচারী পার হবে দেখলে অনেক দূর থেকেই গাড়ি থেমে যায়। মাঝে মধ্যে নিজেই বিব্রত অনুভব করি, যখন দেখি আমার গতিবিধি দেখে আমি রাস্তার কাছাকাছি যাওয়ার আগেই একজন গাড়ির গতি কমিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আবার যেখানে ফুটপাথ নেই, সেখানে পথচারী থেকে অনেক বেশি দূরত্ব বজায় রেখে গাড়ি পার হয়। এমনকি পথচারীর যেন সামান্য ঝুঁকিও না থাকে তার জন্য লেন পরিবর্তন করে অন্য লেনে চলে যায়।
চিরসবুজ দেশ বলে আমরা সব সময় গর্ব করলেও এদের সবুজ দেখলে মনটা ছোট হয়ে যায়। এখানে বিশাল বিশাল সবুজ মাঠ, গাছের সারি, আর ঘন বন দেখা যায়। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কেউ গাছ কাটে বলে মনে হয় না। তবে এদের সবুজ রং অনেক বেশি আকর্ষণীয় হলেও সেটা চিরসবুজ নয়। আমি যে শহরে আছি সেখানে বছরের বেশির ভাগ দিনই সূর্য দেখা যায় না। গ্রীষ্মের তিন মাস বাদে বাকি বেশির ভাগ সময়ই আকাশ মেঘলা থাকে, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়। মাঝে মাঝে অল্প সময়ের জন্য সূর্য উঁকি দিয়ে যায়। আমার সৌভাগ্য যে, আমি এসেই গ্রীষ্মের তিন মাসের অন্তত শেষ মাসটা পেলাম। ফলে শীতে পাতা ঝরা বা তুষারাবৃত হওয়ার আগেই আমেরিকার সৌন্দর্য দেখা হলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথে লেখক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ক্যাম্পাসের একটি ভ্যাঙ্কুভার শহরে। আকারে ছোট হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় এর মনোরম ক্যাম্পাসের জন্য
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথে লেখক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ক্যাম্পাসের একটি ভ্যাঙ্কুভার শহরে। আকারে ছোট হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় এর মনোরম ক্যাম্পাসের জন্য

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ওয়াশিংটন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়। ভ্যাঙ্কুভার নামক ছোট শহরের শাখা ক্যাম্পাসটি অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য আকর্ষণ করে ছাত্রছাত্রীদের। ক্যাম্পাস থেকে দুই অঙ্গরাজ্যের দুই পর্বত মাউন্ট সেন্ট হেলেন আর মাউন্ট হুড দেখা যায়। সারা বছরই এই পর্বত দুটির শীর্ষে বরফ জমে থাকে যা ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যে যোগ করেছে অনন্য মাত্রা।
দেশের মতো এখানে গলির মাথায় সাব্বির ভাইয়ের দোকান কিংবা খাজা বাবার হোটেল নাই। সব বড় বড় সুপারশপ। যেখানে খাদ্য দ্রব্য, গৃহস্থালি থেকে শুরু করে জামা কাপড়, আসবাবপত্রও পাওয়া যায়। বাসার কাছে এমন সুপারশপ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। জায়গার অভাব নেই বলে এ দেশে সবকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। টং দোকানে চা খেতে খেতে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ নেই এখানে, বেশির ভাগ রেস্টুরেন্টেই খেতে হবে বদ্ধ পরিবেশে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দল বেঁধে কাউকে আড্ডা দিতেও দেখা যায় না।
কেনাকাটার ক্ষেত্রে রাউন্ড ফিগার বলতে কিছু নেই। সবকিছুর দামই ভগ্নাংশে দেওয়া থাকে। ঠিক আমাদের দেশের মোবাইলের কলরেটের মতো। যেমন শাক এক আঁটি ১ দশমিক ৯৯ ডলার। ফুলকপি একটা ২ দশমিক ৯৭ ডলার। মুরগি ৩ দশমিক ৯৯ ডলার। এরা কেজিতে হিসাব করে না, করে পাউন্ডে। ফুট, ইঞ্চি, মাইল এসব একক ব্যবহার করে। সারা বিশ্ব যে নিয়মে চলে তারা একটু ব্যতিক্রম চলার চেষ্টা করে সম্ভবত।
এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা আবার মাইলে বলে না, বলবে এত মিনিট ড্রাইভিং। আমাদের শহরে গণপরিবহন একটা বাসই। আধা ঘণ্টা পরপর বাস আসে। একদম ঠিক সময়েই। ৬টা ২৬ মিনিট বললে ৬টা ২৬ মিনিটেই আসে। বাসে যাত্রী থাকে একজন বা দুজন। আমরা বাসার তিনজন একসঙ্গে উঠলে ধরে নেই বাস গমগম করছে যাত্রীতে। হা–হা।
আমেরিকার মানুষ সম্পর্কে যে ধারণা নিয়ে এসেছিলাম এই ভ্যাঙ্কুভার শহরে এসে একদম ভিন্ন রূপ দেখলাম। এত সহযোগী মনোভাব আমাদের দেশে আশাও করি না আমরা। কোনো কিছু জানতে চাইলে এত খুশি হয় যেন কারও উপকার করার সুযোগ পেয়ে ওরাই কৃতজ্ঞ। কথায় কথায় ধন্যবাদ দেওয়া এদের অভ্যাস। ভবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে পেছনে কেউ থাকলে তার জন্য দরজা ধরে রাখা সাধারণ ভদ্রতা। বাংলাদেশের মতো সবার সঙ্গে গলায়-গলায় ভাব না থাকলেও রাস্তায় হাঁটার পথে পরিচিত অপরিচিত সবাইকেই হাই–হ্যালো করে। প্রথম প্রথম দেশ ছেড়ে এসে ভুল করলাম ভেবে বেশি মন খারাপ হলেও এখন একটু সান্ত্বনা পাই। অন্তত ভালো কিছু শেখার বা দেখার জন্য হলেও এখানে একবার আসা দরকার ছিল। পড়ালেখার মান, উন্নত প্রযুক্তি, নিরপেক্ষ গ্রেডিং সিস্টেম আর গবেষণার সর্বোচ্চ সুযোগ একবার অন্তত চেখে দেখা উচিত।
এত কিছুর পরও সব সময় মন পড়ে থাকে সেই যানজটের শহরে, শত সমস্যা সংকীর্ণ আমার দেশেই। ঢাকায় হাঁটার জন্য ফুটপাথ পেতে কষ্ট হতো। কিন্তু এখানের মানুষবিহীন ফুটপাথে হাঁটলে দেশের সেই কোলাহলটাই মিস করি। এখানে রাস্তায় তেমন যানজট নেই। কিন্তু যানজট পেরিয়ে ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার আনন্দ নেই। দিন শেষে, সপ্তাহ শেষে এমনকি বছর শেষেও পরিবার আর বন্ধুদের দেখা কী পাওয়া যাবে?

হাশেম মোহাম্মদ: গবেষণা সহকারী, ওয়াশিংটন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়, ভ্যাঙ্কুভার, ওয়াশিংটন, যুক্তরাষ্ট্র।