মেঘ রোদ্দুরের খেলা-পাঁচ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আতিক তার বেডরুমে চলে যাওয়ার পর রাকিব চেয়ার ছেড়ে লম্বা সোফাটায় গা ছেড়ে বসল। রিমোটে টিভি অন করতেই দেখল, চ্যানেল টুতে ‘দ্য প্যাসন অব ক্রাইস্ট’ সিনেমাটা চলছে। ইস্টার হলিডে বলেই টিভিতে মূলত দিনের এ সময়টায় এই সিনেমাটা দেখাচ্ছে।

রাকিব সিনেমাটা আগেও একবার দেখেছে। যিশুখ্রিষ্টের অদৃশ্য হওয়ার আগের শেষ ১২ ঘণ্টা নিয়ে ছবির কাহিনি। পরিচালনায় মেল গিভসন। চমৎকার পরিচালনা। যদিও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে, বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের খ্রিষ্টানদের কাছে সিনেমাটা বেশ সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু রাকিব দেখেছে, সিনেমাটায় বেশ আর্ট আছে। যিশুখ্রিষ্টের ওপর করা অন্যান্য গতানুগতিক সিনেমার চেয়ে একটু ভিন্ন।

টিভিতে সিনেমা দেখা মানে কিছুক্ষণ পরপর বিরতি। লম্বা লম্বা বিজ্ঞাপন। সিনেমার প্রতি মনোযোগ ধরে রাখা যায় না। আবার বিজ্ঞাপন শুরু হতেই রাকিব টিভি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাইরে তাকাল।

মাঝখানে বৃষ্টিটা একটু ধরে এসেছিল। কিন্তু এখন আবার শুরু হয়েছে। তবে বড় বড় ফোটায় নয়, ঝিরঝির বৃষ্টি। রাস্তার দুই পাশে বৃষ্টিতে ভেজা শীতের পাতাহীন গাছগুলো চিরহরিৎ গাছের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেকটা বিমর্ষ ভঙ্গিতে। বৃষ্টির শব্দের চেয়ে একধরনের ঝিম ধরা শব্দই বেশি।

টিভিতে বিজ্ঞাপনের পর আবার সিনেমাটা শুরু হয়েছে। রাকিব টিভিতে দৃষ্টি দিয়ে পরক্ষণই আবার দৃষ্টিটা বাইরে ফেলল। একটা ক্যাবেজ গাছ রাস্তার ওপাশের একটা ডুপ্লেক্সের সামনে দেখা যাচ্ছে। ক্যাবেজ গাছটা বেশ বড়। গত গ্রীষ্মে ওই ক্যাবেজ গাছটাতে অনেক ফুল ধরেছিল। দুধসাদা ফুল। এখনো গাছটার চিরল পাতার ফাঁকে ফাঁকে শুকনো বাদামি ডাঁটগুলো হা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে।

রাকিব জানে, জীবনে সবুজ দুঃখ বলে একটা কথা আছে। এসব সবুজ দুঃখ হলো ভালোবাসার দুঃখ। এই দুঃখগুলো সূক্ষ্ম, সম্মিলিত ও অগণিত। ক্যাবেজ গাছের সবুজ চিরল পাতার ফাঁকে ফাঁকে হা দৃষ্টির বাদামি ডাঁটগুলোকে মনে হচ্ছে সবুজের দুঃখ। সেই ভালোবাসার দুঃখ!
কাচের জানালায় বৃষ্টির ছাঁট। কাচে বৃষ্টির জলের সরু সরু রেখা। ধূসর-নিস্তব্ধ আকাশ। চারদিকে ধূসর প্রকৃতি। একটা পাতাহীন গাছের ডালে তিনটা চড়ুই ভিজছে। পাশেই একটা শালিক।
রাকিবের মনে পড়ে ছোট চাচি কখনই এক শালিক দেখা পছন্দ করতেন না। বৃষ্টির দিনে কোথাও কোনো গাছের ডালে এক শালিক ভিজতে দেখলে তিনি ঢিল ছুড়তেন। বলতেন, যাহ, দূর হ, অলক্ষুনে কোথাকার!...বলেই তিনি কলকল করে হাসতেন—হি-হি, হি-হি।
রাকিব ভাবল, সেই ছোট চাচি! যিনি তাঁকে বৃষ্টিতে ভিজতে শিখিয়েছিলেন। বিকেলের সূর্য ডোবার গান বাঁধতে বলেছিলেন। তাঁর সঙ্গেই মধ্যরাতে জ্যোৎস্নায় স্নান করতে করতে কোনো একদিন সে কবিতা লিখতে বসেছিল!

‘মধ্যরাতের সবুজ দুয়ারে কপাট খোলা রেখে যে যুবতী
ভরা শ্রাবণের তুমুল বৃষ্টিতে স্নান করে—
আমি তাকে ভালোবাসি।
জ্যোৎস্নার চাদর বিছিয়ে ভরাট ভাদ্রের কোমল উষ্ণতায়
যে রূপসী ফাগুনের গান গায়—
আমি তাকে ভালোবাসি।
আমি তাকে ভালোবাসি ডাহুকের ডাক ভাঙা কষ গিলে
কোনো মধ্যদুপুরের কোনো মধ্যরাতে!’

ছোট চাচিকে নিয়ে তাঁর লেখা প্রথম কবিতা। সে কোথাও ওটা ছাপতে দেয়নি। কাউকে কখনো ওটা সে পড়তেও দেয়নি। তার লেখা শত শত কবিতার মধ্যে এই কবিতাটা একান্ত নিজের করে লুকিয়ে রেখেছে। একান্ত মনের ভেতর। মাঝেমধ্যে সে এই কবিতাটা মনের ভেতর থেকে বের করে নিজের মনে নিঃশব্দে ভাঙচুর করে। বৃষ্টিতে ভেজা বিমর্ষ মসৃণ চিরসবুজ গাছগুলোর মতোই যেন তাঁর ছোট চাচি ছিলেন।
রাকিবের ছোট চাচা ছিলেন সেনাবাহিনীর অস্ত্রগুদামের স্টোর কিপার। লেখাপড়ায় তিনি কখনই তেমন ভালো ছিলেন না। মাধ্যমিক যেমন তেমন একবারে পাস করে গেলেও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করতে তার তিনবার লেগে গিয়েছিল। পরে লেখাপড়ায় আর এগোতে পারবেন না বলে বড় চাচা তাঁর উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা বন্ধুকে ধরে সেনাবাহিনীর অস্ত্রগুদামের স্টোর কিপারের চাকরি দেন।
চাকরি পাওয়ার পরও ছোট চাচার বিয়ে করতে আরও ছয় বছর লেগে যায়। ছোট চাচা লেখাপড়ায় যতই খারাপ হন বা দেখতে যতই মন্দ হন, কাজী বাড়ির ছেলে বলে কথা! ঘর মিলছিল তো পাত্রী মিলছিল না, পাত্রী মিলছিল তো ঘর মিলছিল না!
একদিন হুট করেই ছোট চাচার পাত্রী পছন্দ হয়ে যায়। মুরাদনগরের উত্তরে, প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরে, পেয়ারাকান্দি নামে ভাটি অঞ্চলে পাত্রীর বাপের বাড়ি। পাত্রীর বাবা ছিলেন সেই গ্রামের খুব নাম-ডাকওয়ালা জোতদার এবং রামচন্দপুর বাজারের চালের ব্যবসায়ী।
বিয়ে খুব জাঁকজমকভাবে হয়। বউ তুলে আনা হয় তিন দিন পর। এক মেঘলা বিকেলে ছোট চাচি কাজী বাড়িতে বউ হয়ে আসেন।
রাকিবের খেয়াল আছে, সেদিন সারা দিন খুব বৃষ্টি হয়েছিল। বিকেলের দিকে বৃষ্টি খানিকটা ধরে এসেছিল। সারা দিনের বৃষ্টির কারণে উঠোন ছিল কাদায় থকথকে। উঠোনের স্থানে স্থানে এক-দেড় হাত পরপর দুটি করে ইট বিছিয়ে দেওয়া ছিল।
রাকিব দাঁড়িয়ে ছিল উত্তর ভিটায়। তাঁর দাদির ঘরের বারান্দায়। দাদির ঘরেই বউ তোলা হয়েছিল। সে দেখছিল, ছোট চাচি উঠোনের বিছানো ইটে গুটি গুটি পা ফেলছেন। কাজীবাড়ির চার-পাঁচজন মহিলা তাঁকে ধরে উত্তর ঘরের দিকে নিয়ে আসছে। দরজায় তাঁর দাদি, বড় চাচি ও আরও অনেক আত্মীয়স্বজন দাঁড়িয়ে আছেন। বড় চাচির হাতে কুলো, ধান-দুর্বা। দাদিও কুলোর একপাশ ধরে রেখেছেন।
লম্বা ঘোমটার কারণে ছোট চাচির মুখ দেখা যাচ্ছিল না। কেউ তার হাত ধরে রেখেছিল, কেউ তার বাহু, কেউবা তার পিঠ। উঠোনে কাদার জন্য একজন মহিলা ছোট চাচির শাড়ির কুঁচিটা তুলে ধরে রেখেছিল। এতে তার গোড়ালি সমেত পা দুটি দেখা যাচ্ছিল স্পষ্ট।
রাকিব ছোট চাচির মুখ দেখার আগে প্রথম পা দুটি দেখেছিল। এর আগে বিয়েতে ব্যস্ততার কারণে সে তার মুখ দেখতে পারেনি।
সে দেখছিল, ছোট চাচির উজ্জ্বল শ্যামলা পায়ে লাল টকটক আলতা মাখা। তাঁর জুতোগুলোও লাল রঙের ছিল। হঠাৎই করেই তখন মেঘ ভেঙে রোদ উঠেছিল। পড়ন্ত বিকেলের মেঘ ভাঙা রোদে তার পা দুটিকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিল।
রাকিব ভাবল, সে জীবনে অনেক সৌন্দর্যই উপভোগ করেছে। নিউজিল্যান্ডের প্রতিটা বাঁকই তো সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো। পৃথিবীর ‘ন্যাচারাল বিউটি’ বা ‘গ্রিন হ্যাভেন’ বলতে যা বোঝায় তো এই নিউজিল্যান্ডেই আছে। কিন্তু জীবনের অন্য সব সৌন্দর্যে পেছনে ঠেলে ওই একটা মাত্র সৌন্দর্যই তাঁকে কেন আজও সূক্ষ্মভাবে নাড়া দেয়, সে তা আজও বোঝে না। পড়ন্ত বিকেলের মেঘ ভাঙা টকটকে লাল রোদ! এক জোড়া লাল টকটকে জুতো! আলতা মাখা টকটকে দুটি লাল রঙিন পা! একটা লাল টকটকে বেনারসি শাড়ি!...
ছোট চাচি যখন কাজীবাড়িতে বউ হয়ে আসেন তখন তার বয়স ছিল ১৬ বছর। রাকিবের চেয়ে বছরখানেক বড় ছিলেন। কিন্তু পড়তেন একই ক্লাসে, ক্লাস টেনে।
ছোট চাচি কাজীবাড়িতে বউ হয়ে আসার মাসখানেকের মাথায় মুরাদনগর গার্লস স্কুলে ভর্তি হন। রাকিব তখন মুরাদনগর হাইস্কুলে পড়ে। একটা অপ্রশস্ত খাল, একটা প্রশস্ত খেলার মাঠ ও খালের দুই পাশের সারি সারি মেহগনি গাছের সারি দিয়ে স্কুল দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। যেহেতু একই ক্লাসে পড়া ও একই সময় দুই স্কুল ছুটি হতো, তাই প্রথম থেকেই সে স্কুলে আসা যাওয়ার পথে ছোট চাচির সঙ্গী হয়ে যায়। কিছুদিন পর পড়ার টেবিলেও।
রাকিবের পড়ার রুমে ছিল উত্তর ঘরের পশ্চিম পাশে। মাঝখানে একটা টিনের বেড়া দিয়ে ঘরটা ভাগ করা ছিল। দাদির পালঙ্ক, আলমারি, আলনা ও সিন্দুক সব সরঞ্জাম ছিল ঘরের পুবে। পানদানিতে পান ছেঁচার শব্দ হতো রাত আটটা বাজতেই—ঠক ঠক, ঠক ঠক, কট-কট।
সাড়ে আটটা কী নয়টা বাজতেই দাদি ঘুমে কাত হয়ে যেতেন। ছোট চাচি দাদির পাশেই ঘুমাতেন।
রাকিবের রুমটা ছিল উত্তর ঘরের পশ্চিম পাশে। একটা ছোট্ট খাট, একটা ছোট একটা পড়ার টেবিল এবং একটা নড়বড়ে কাপড়ের আলনা বাদে তার রুমে আর কিছু ছিল না। টেবিলের ওপর অবশ্য একটা বইয়ের তাক ছিল। আর খাট ঘেঁষে টেবিলের পাশে একটা বনেদি আমলের চেয়ার।
রাকিব পড়ার সময় বরাবরই সেই চেয়ারটাতে বসত, ছোট চাচি বসতেন খাটে।
বিয়ের পরপরই ছোট চাচা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে বদলি হয়ে যান। সরাসরি সৈনিকের চাকরি না হলেও ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের চাকরি বলে তাকে ছুটি-ছাটার ব্যাপারে সৈনিকদের সব নিয়মকানুনই পালন করতে হতো। তিনি ছুটি পেতেন দুই-তিন মাস পর পর দুই দিন কী তিন দিন। তিনি বেশির ভাগই আসতেন বৃহস্পতিবার রাতে। চট্টগ্রাম থেকে নাইটকোচ বা ট্রেনে কুমিল্লা। তারপর কুমিল্লা থেকে সরাসরি বাসে মুরাদনগর। শুক্রবার পুরোদিন থেকে শনিবার রাতে বা রোববার ভোরে তিনি আবার চট্টগ্রাম চলে যেতেন।
ছোট চাচা যখন বাড়িতে আসতেন তখন ছোট চাচিকে দেখা যেতো অন্য সাজে। তিনি রঙিন শাড়ি পরতেন। হাতে হরেক রকম চুড়ি। মুখে স্নো-পাউডার মাখতেন। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। তখন তাঁর স্কুল-পড়া বন্ধ থাকত। তিনি রাতে পড়ার টেবিলে আসতেন না।
ছোট চাচা বাড়ি থেকে চলে গেলে ছোট চাচির আবার স্বাভাবিক জীবন শুরু হতো।-স্কুল, পড়া, পড়ার টেবিল, বিকেলের আড্ডা ও ছোটখাটো খুনসুটি।
এভাবে চার বছর।
রাকিব মনে মনে হিসাব করল, শুধু চার বছর নয়। চার বছর দুই মাস তেরো দিন।
রাকিব আরেকটা কথা ভাবল, আচ্ছা, ছোট চাচা যখন বাড়িতে থাকতেন তখন কী সে ছোট চাচির জন্য একাকিত্ব বোধ করত? কিংবা ছোট চাচার প্রতি ঈর্ষা?...
বাইরে বৃষ্টিটা আবার বেড়ে গেছে। বৃষ্টির সঙ্গে হালকা ঝোড়ো বাতাস বইছে। ম্যাপল গাছের ডালে আটকে থাকা আরও কিছু সোনালি পাতা সেই ঝোড়ো বাতাসে বৃষ্টির সঙ্গে শরীর বুলিয়ে ফুটপাতে এসে পড়েছে। ডুপ্লেক্সের সামনের ক্যাবেজ ট্রির সবুজ চিরল পাতাগুলো কাঁপছে বাতাসের তির তির কাঁপুনিতে কখনো মৃদুমন্দ ভাবে। কখনো উথালপাতাল হয়ে।
রাকিব দেখল, কোনো এক যুবতী ম্যাকফার্লেন স্ট্রিটের ফুটপাতের ধরে হাঁটছে। পরনে সালোয়ার-কামিজ। কামিজের ওপর ইয়া মোটা একটা জ্যাকেট। বৃষ্টির কারণে মাথায় একটা ছাতা। ঝোড়ো বাতাসের তোড়ে ছাতাটা বারবার এদিকওদিক হচ্ছে। ছাতার এদিকওদিক হওয়ার সঙ্গে মেয়েটার চেহারাটাও স্পষ্ট-অস্পষ্ট হচ্ছে।
রাকিব ভাবল, এই বৃষ্টির দিনে যুবতীটা এমনভাবে বের হয়েছে কেন? সে যুবতীকে ভালো করে দেখার জন্য সোফা থেকে ঘাড় বাড়িয়ে উবু হয়ে তাকাল। এই নিউজিল্যান্ডে কোনো শ্যামলা মেয়ে যখন শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ পরে ফুটপাত ধরে হাঁটে, তাঁর তখন বেশ ভালো লাগে। সাধারণত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের বেশির ভাগ যুবতী ও নারীরা এখানে শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ পরার সংস্কৃতিটা ধরে রেখেছে। বাঙালি যুবতী বা নারীরা তো নিউজিল্যান্ড বা পশ্চিমা দেশে এসে শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ ছেড়ে সবার আগে প্যান্ট-শার্ট ধরে। কেউ ধরে স্কার্ট বা মিনি স্কার্ট। কারও কারও মিনি স্কার্টের সাইজ এত ছোট হয়ে যায়, দেখতে বেশ দৃষ্টিকটু লাগে।
যুবতী ফুটপাতের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল। ম্যাকফার্লেন স্ট্রিট ধরে কিছুক্ষণ পরপর একটা-দুটি গাড়ি আসা-যাওয়া করছে। গাড়ির আসা যাওয়ায় রাস্তার জমাজলের শব্দ হচ্ছে-চিড়িৎ চিড়িৎ। একটা নাদুসনুদুস বেড়াল একটা বাড়ির ঘাসের লন ধরে বৃষ্টি ভিজতে ভিজতে হেলেদুলে হাঁটছে। রাস্তার ওপাশের এক বাসার বৃদ্ধ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিমগ্ন দৃষ্টিতে বৃষ্টি দেখছে।
রাকিব বৃষ্টির ভেতর দৃষ্টিটা ওঠানামা করতে করতে একসময় নিজের ভেতর নিজেই আবার ক্ষয়ে গেল।-তার ছোট চাচির গায়ের রংও শ্যামলা ছিল। উজ্জ্বল শ্যামলা। তার গোলগাল চেহারায় অদ্ভুত সুন্দর দুটি মায়াবী চোখ ছিল। চুল ছিল ঘন, কোমর অবধি। স্কুল ও কলেজের ইউনিফর্ম বাদে তিনি বাড়িতে শাড়িই বেশি পরতেন। তাঁর প্রিয় পছন্দের রং ছিল টিয়ে রং।
ছোট চাচি টিয়ে রঙের শাড়ি পরে যখন বাড়ির পাশের আমবাগানে কোনো চৈত্রের দুপুরে বা বৈশাখের বিকেলে আনমনে হাঁটতেন, তখন তাঁকে ঠিক টিয়ে রঙের রাজকন্যা বলে মনে হতো।
রাকিব মাঝেমধ্যে ঠাট্টা করে বলত, ছোট চাচি, তুমি কী জানো, ছোট চাচার পাশে তোমাকে কি মনে হয়? মনে হয়, কাকের মুখে আস্ত টকটকে একটা আপেল!...
ছোট চাচি বুঝেও জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, কি?
রাকিব হেসে বলত, আপেল।
—মানে?
—মানে হলো, তুমি আপেল আর ছোট চাচা কাক। কালো কাক। দোড়া কাউয়া!...
ছোট চাচি চোখ রাঙাতেন। বলতেন, দেখ রাকিব, এবার তোর ছোট চাচা আসলে আমি কিন্তু বলে দেব, হ্যাঁ!...
রাকিব হেসে বলত, আমি মিথ্যে বলিনি কিন্তু!
ছোট চাচি চোখ রাঙিয়ে বলতেন, হ্যাঁ, মিথ্যে বলছিস!...বলেই তিনি নাক ফুলাতেন। একটা কৃত্রিম রাগ চেহারায় ফুটিয়ে তুলতেন।
কিন্তু রাকিব বুঝতে পারত, ছোট চাচি রূপের প্রশংসায় মনে মনে খুশিই হতেন। তাই মাঝেমধ্যে কোনো বিকেল হালকা সাজলে বলতেন, হ্যাঁ রে, কপালের টিপটা ঠিক আছে কিনা, দেখতো? কখনো আবার বলতেন, রাকিব দে তো, টিপটা কপালের মাঝে খানে বসিয়ে দে!...তবে তার একটা কাজ করতে সব সময় খুব অসহ্য মনে হতো। ছোট চাচি ক্লাসে যাওয়ার সময় তাড়াহুড়ার দোহাই দিয়ে বলতেন, রাকিব, দেখত, ব্রার হুকটা লাগাতে পারছি না! কী ঝামেলা দেখ, বলেই পিঠটা তার দিকে পেতে দিতেন।
রাকিব তখন বিরক্ত হয়ে বলত, তুমি কী যে করো না ছোট চাচি, এভাবে পিঠ পেতে দিতে তোমার লজ্জা করে না?
ছোট চাচি ধরা গলায় বলতেন, লজ্জা হবে কেন রে? আমি তো তোর মুরুব্বি, তোর ছোট চাচি!...
এভাবে ধরা গলায় গম্ভীর হয়ে বলতে গিয়ে ছোট চাচি কখনো সত্যিকার অর্থে মমতাময়ী একজন হয়ে উঠতেন। তখন তার বয়স অনেক বেড়ে যেত। কখনো চপলতা প্রকাশ করতে গিয়ে এতটুকু ছোট্ট খুকি হয়ে যেতেন। অযথাই হাসতেন হি-হি, হি-হি। কখনো আবার জ্যোৎস্নার মধ্যরাতে ঘরের সামনের পাটাতন গায়ে গা ঘেঁষে বসে অনন্য সুন্দর কোনো রূপসী হয়ে উঠতেন। সম্পর্কের বৈপরীত্য তখন অবান্তর হয়ে যেত!
রাকিবকেও মাঝেমধ্যে মুরুব্বি সাজতে হতো, বিশেষ করে পড়ার টেবিলে। সে বরাবরই ভালো ছাত্র ছিল। ক্লাসে প্রথম বাদে কখনো দ্বিতীয় হতো না।
কিন্তু ছোট চাচি সব বিষয়ে ছিলেন খুব সাধারণ মানের। অঙ্কে তো একবারেই কাঁচা ছিলেন। বাংলা সাহিত্য ভালো বুঝলেও ইংরেজিতে তিনি খুব সাধারণ একটা অনুবাদ করতে পারতেন না। এ জন্য রাকিব তার ওপর অঙ্কে বা ইংরেজিতে বেশ মাস্টারি করার সুযোগ পেত। কখনো কখনো লেখাপড়ার ব্যাপারে এটা সেটা উপদেশ দিতে গিয়ে সত্যি সে মুরুব্বি হয়ে উঠত।
এভাবে চার বছর দুই মাস তেরো দিন!
বাইরে বৃষ্টিটা আবার কমে এল। সঙ্গে সঙ্গে ঝোড়ো বাতাসটাও কমে গেল। গাছ-পাতা জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে টপ টপ, টপ টপ। জানালার কাচে এখন আর বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ছে না। কিন্তু কাচে এক ধরনের ভেজা কুয়াশার হালকা আবরণ পড়েছে।
রাকিব সোফা ছেড়ে উঠে জানালার পাশে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ সে স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
জানালার কাচ কুয়াশায় আরও ঘোলা হয়ে উঠল।
রাকিব স্থাণু ভেঙে জানালার ঘোলা কাচের ওপর ডান হাতটা আস্তে করে রাখল। কয়েক সেকেন্ডে। হাতটা তুলতেই দেখল জানালার কাচে হাতের তালুসহ পাঁচ আঙুলের দাগ পড়েছে।
সে জানালার কাচে আবার হাতটা রাখল। এবার বেশ কতক্ষণের জন্য রাখল। এক ধরনের শীতল স্পর্শ যেন তার হাতের তালু বেয়ে শিরা-উপশিরা দিয়ে সমস্ত শরীরে এসে বিঁধছে। তার চোখের সামনের দৃষ্টিটাও যেন ঘোলা ও অনির্ধারিত ঝাপসা! জীবন ও জীবনের টান! প্রেম ও ভালোবাসা! একটা অনাকাঙ্ক্ষিত অপরাধ! নিয়ম মাফিক দুই-তিন মাস পরপর মাসের এক বা দুই তারিখেই ছোট চাচা বাড়িতেই আসতেন। চারটা বছর এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। কিন্তু এই নিয়মের বাইরে তিনি কি সেদিন সত্যি মাসের মাঝামাঝি এসেছিলেন? নাকি সেদিনের উঠতি সন্ধ্যায় খোলা জানালার পাশে আলো আঁধারির ছায়াটা অন্য কারওর ছিল? তিনি তো ময়নামতির কাছে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান পরদিন সকালে, বাড়িতে আসার পথে? (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: