জাদুর শহর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সর্বপ্রথম যেদিন বন্ধুদের সঙ্গে ঢাকা শহরে আসার জন্য এসবি সুপার ডিলাক্স বাসের টিকিট কেটে বাসে চড়ে বসলাম, সেদিন সত্যিকার অর্থেই ভয় লাগছিল। যদিও সঙ্গেই আমার বন্ধুরা ছিল। এর আগে একবার শুধুমাত্র বাসে বা ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা ছিল এবং বমিও করেছিলাম। তাই এবার আবার বমি হয়ে যাবে কিনা সেই আতঙ্কে জানালার পাশের সিটে গিয়ে বসলাম। সারা রাস্তায় আর কোনো ঝামেলা হলো না। হয়তো বা প্রথম ঢাকা আসার উত্তেজনায় বমির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। বাসটা দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরি পার হয়ে যেইমাত্র গাবতলীতে ঢুকল ভয়ংকর একটা পচা গন্ধ এসে নাকে লাগল। সেই গন্ধে পেটের ভেতরের নাড়িভুঁড়ি শুদ্ধ বের হয়ে আসার উপক্রম হলো। বাসে বসেই আমি আমার বন্ধুদের বললাম, আমি এই দুর্গন্ধযুক্ত শহরে এক মুহূর্তের জন্যও থাকতে পারব না। তোরা আমাকে ফিরতি বাসের টিকিট কেটে কুষ্টিয়া পাঠিয়ে দে।

তারপর বাস থেকে নেমে রিকশা করে হাতের আঙুল দিয়ে শক্ত করে নাক চেপে ধরে মোহাম্মদপুরের কাঁটাসুরে বন্ধুদের মেসে পৌঁছালাম। তারা আগে থেকেই ওখানে থেকে কোচিং করত। আমি শেষ সময়ে এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম শুধুমাত্র মডেল টেস্ট দেওয়ার জন্য। কিন্তু দুটি মাত্র প্রি-মডেল টেস্ট দিয়েই আমি আবার কুষ্টিয়া ফিরে গিয়েছিলাম। কারণ, পরীক্ষাগুলোয় নম্বর পেয়েছিলাম খুবই কম। তাই ভাবলাম ভর্তি পরীক্ষার আগে এই মডেল টেস্ট দিয়ে আত্মবিশ্বাস কমানোর কোনো মানে হয় না। প্রথম ধাক্কায় আমি সর্বসাকল্যে মাত্র কয়েকটা দিন ঢাকাতে থেকেই ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু কে জানত সৃষ্টিকর্তা এই শহরেই আমার ভাগ্য লিখে রেখেছেন। একদিন এই শহরের জন্যই আমার মন কাঁদবে। যে শহরে প্রথম পা দিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, সেই শহরই একসময় প্রাণের শহর হয়ে উঠেছিল। তাই চিরকুট ব্যান্ডের জাদুর শহর গানের অনেক আগে থেকেই ঢাকাকে আমি বলি জাদুর শহর। আজ সেই বিবর্তনের হাজারো গল্প থেকেই দু-একটি শোনাব আপনাদের।
বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পরের ধাপ হচ্ছে কোর্সের রেজিস্ট্রেশন। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে শিক্ষককে ঠিক করে দেওয়া হয়। যিনি বুয়েটে পড়া অবস্থায় সেই শিক্ষার্থীর সমস্ত ভালোমন্দের দেখভাল করবেন। সোজা কথায় সেই শিক্ষক হচ্ছেন সেই শিক্ষার্থীর স্থানীয় অভিভাবক ও তাদের বুয়েটের ভাষায় বলা হত অ্যাডভাইজার। আমার অ্যাডভাইজারের নাম পড়ে দেখলাম ড. হাসিব এম আহসান। যত দূর মনে পড়ে বুয়েটের সিভিল বিল্ডিংয়ের চার তলার অফিসের বাইরে শিক্ষকদের ছবিসহ নামের তালিকা টানানো থাকত। আমি নাম দেখে দেখে যে ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, সেটা একজন পুরোদস্তুর স্মার্ট ভদ্রলোকের ছবি। চোখে মোটা রিমের চশমা। চুলগুলো পরিপাটি করে আঁচড়ানো। ক্লিন শেভড। ছবির নিচেই স্যার যে কক্ষে বসেন সেই নম্বর লেখা। নম্বর ধরে স্যারের কক্ষের সামনে গিয়ে দেখি একজন পুরোদস্তুর দাঁড়িওয়ালা ভদ্রলোক বসে আছেন। আমি তাঁকে স্যারের নাম বলে জিজ্ঞেস করলাম, আমি তাঁকে খুঁজছি। তিনি বললেন, তিনিই সেই ব্যক্তি। তখন বুঝলাম স্যারের দাঁড়ি রাখার পর বোর্ডের ছবিটা আর বদলানো হয়নি। তাই আমার মনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। কলেজজীবনে আতিয়ার স্যার যেমন শিক্ষক থেকে আমার অভিভাবকের স্থান করে নিয়েছিলেন, হাসিব স্যারও তেমনি ঢাকা শহরে সত্যিকার অর্থেই আমার অভিভাবক ছিলেন।
স্যারের সঙ্গে কোর্স রেজিস্ট্রেশন বিষয়ক কাজ সেরে আমি আমার আর্থিক অবস্থার কথা খুলে বললাম। স্যার মনযোগ দিয়ে শুনে বললেন, সবাই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেয় না। তাই তুমি এটা নিয়ে ভেবো না। আবারও তিনি সেই একই কথা বলে আমাকে অভয় দিলেন, যেটা আমার মা আমাকে সব সময় বলতেন, যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছেন। এরপর বুয়েটের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষক হয়েও স্যার আমার জন্য যা করেছিলেন, সেটা একপ্রকারের ব্যতিক্রমই বলা চলে। কোনো এক অলিখিত কারণে বুয়েটের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে একটা অহংবোধের সম্পর্ক বিদ্যমান। সামান্য কোনো ইস্যু হলেই শিক্ষকেরা যেমন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করেন আবার শিক্ষার্থীরাও কোনো সুযোগ পেলেই এমনভাবে ভাঙচুর করেন যে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলে। হাসিব স্যার আমাকে কয়েক দিনের মধ্যেই হলের গার্ড দিয়ে ডেকে পাঠালেন। আমি তাঁর কাছে যাওয়ার পর বললেন, তোমার জন্য একটা টিউশনি ঠিক করেছি। বলে টিউশনির বিস্তারিত আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। সেই টিউশনিটা অবশ্য আমার দোষেই বেশি দিন টিকল না। তখন স্যার বললেন, টিউশনি নিয়ে ভেবো না। আমিও খুঁজছি আর তুমিও খুঁজতে থাক।
এরপর স্যার একসময় আমাদের আবাসিক হল ড. এম এ রশিদ হলের প্রভোস্ট হয়ে এলেন। তিনি তার এই বাড়তি দায়িত্বে যোগ দেওয়ার পরই একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর সামনে যাওয়ার পর হলের কেয়ারটেকারকে দেখিয়ে বললেন, ওর কাছ থেকে একটা দরখাস্ত ফরম নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পূরণ করে হল অফিসে জমা দিয়ে দাও। আমি নিজের কক্ষে ফিরে সেই দিনই দরখাস্তটা পূরণ করে জমা দিয়ে দিলাম। এরপর থেকে প্রতি টার্মের শুরুতেই আমি হলের পক্ষ থেকে উপবৃত্তি পেয়েছি। আমি তখনই প্রথম জানতে পেরেছিলাম, হলের গরিব ছাত্রদের পড়াশোনায় সহযোগিতা করার জন্য একটা তহবিল আছে।
এরপর থেকে আমার যেকোনো প্রয়োজনে স্যারই ছিলেন আমার শেষ ভরসা। আমি অনেক সৌভাগ্যবান, হাসিব স্যারই আবার আমার থিসিস সুপারভাইজারও ছিলেন। তাই বুয়েটের শেষদিন পর্যন্ত এই মানুষটা ছিলেন একই সঙ্গে আমার শিক্ষক ও অভিভাবক। এমনকি বুয়েট থেকে পাস করার পরও স্যারের সঙ্গে যোগাযোগটা ছিল। আর আমাকে দেখলেই সেই দরাজ গলায় জিজ্ঞেস করতেন, এই তোমার কি খবর। একবার এমনই এক সাক্ষাতে স্যারের প্রশ্নের উত্তরে বললাম, স্যার, বাংলা লিংকে চাকরি করছি। শুনে স্যার বললেন, তাই নাকি! আমার ভায়রা বখতিয়ারও তো ওখানে চাকরি করে। কাকতালীয়ভাবে আমি বখতিয়ার ভাইকে চিনতাম বুয়েট জীবনের শুরু থেকেই। তারপর একই কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে সেই সম্পর্কটা আরও দৃঢ় হয়েছিল। যদিও তিনি সরাসরি আমার রিপোর্টিং বস ছিলেন না।
বুয়েট জীবনে প্রথম কয়েকটা টিউশনি থেকে বাতিল হয়ে যাওয়ার পর যে টিউশনিতে থিতু হয়েছিলাম, সেটা ছিল মগবাজারে। আমার খালাতো ভাই সাত্তার ছিল সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের দপ্তরি। আমি তাঁকে আগে থেকে চিনতাম না। আমার মোট দশ জন খালা আর তিনজন মামাদের মধ্যে আমি হাতেগোনা দু-এক জনকেই চিনতাম। তাই সাত্তার ভাইকেও চিনতাম না। কিন্তু আমি বুয়েটে চান্স পেয়েছি শুনে সাত্তার ভাই একদিন আমার হলে এসে আমাকে নিয়ে গেলেন মগবাজারে টিউশনির বাসাতে। ওনার কলেজেরই এক স্যারের মেয়েকে পড়াতে হবে।
মগবাজার দিলু রোডের একটা বহুতল ভবনের সাত তলার একটা ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলেন সাত্তার ভাই। দরজা খোলার পর সাত্তার ভাই ফ্রক পরা একটা মেয়েকে দেখিয়ে বললেন, ওর নাম তিথি, ওই তোমার ছাত্রী। আমি মনে মনে ভাবলাম, এতটুকু পুঁচকে একটা মেয়ে সে আবার ক্লাস টেনে পড়ে। একটু পর ছাত্রীর বাবা এলে টিউশনির শর্তাবলি ঠিক করে সেদিনকার মতো বিদায় নিয়ে চলে আসলাম। এরপর দিন থেকে তাকে পড়ানো শুরু করলামভ। কিন্তু টিউশনির শর্ত অনুযায়ী যে কয় দিন পড়ানোর কথা ছিল, আমার ছাত্রী মোটেও সে কয় দিন পড়বে না। আমি টিউশনি হারানোর ভয়ে তাকে আর কিছু বললাম না। এভাবে এক মাস ২৩ দিন পার হয়ে যাওয়ার পর একদিন ছাত্রীর বাবা এসে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়াকুব মাস হইলে জানিও। আমি ওনার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম এবং তখন বুঝলাম আমি যেহেতু টিউশনির শর্ত অনুযায়ী দিন গুনে আসিনি, তাই উনি আমাকে এই প্রশ্ন করেছেন। যা হোক, এরপর থেকে বেতন নিয়ে আর কোনো বিভ্রান্তি তৈরি হয়নি। তবে একদিন ছাত্রীর বাবা এসে আমাকে বললেন, একটু বেশি সময় দিয়ে পড়িও। এটা শোনার পর ছাত্রী ভীষণ রেগে গেল। সে কোনোভাবেই বেশিক্ষণ পড়বে না। তাই তখন ছাত্রী একটা উপায় বের করল। আমরা প্রথম একটা ঘণ্টা কোনোমতে পার করে দেওয়ার পর আড্ডা দিতাম বাকি সময়টা। সেই আড্ডাতে রাজনীতি থেকে শুরু করে সাহিত্য সবকিছুই আসত।
ইতিমধ্যেই আমার মেজো ভাইটা কুয়েটে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে পড়াশোনা শুরু করে দিয়েছে। খুলনাতে টিউশনির তেমন একটা সুযোগ না থাকায় তাঁকে মাসে মাসে টাকা পাঠাতে হতো। এমনই এক মাসে ওকে টাকা পাঠাতে হবে, কিন্তু টিউশনিতে তখনো মাস শেষ হয়নি। এই কথাটা কথায় কথায় আমার ছাত্রীকে বলে ফেললাম। শুনে আমার ছাত্রী বলল, স্যার আপনার কত টাকা লাগবে? উত্তরে আমি বললাম আপাতত দেড় হাজার হলেই এযাত্রা উদ্ধার পাব। শুনে ছাত্রী বলল, আপনি একটু বসেন আমি আসছি। ভেতরের ঘর থেকে একটু পরে ও ফিরে এল দুই হাত মুঠি করে ধরে। আমার সামনে এসে টেবিলে দুই হাতের মুঠি খুলে দিলে, একগাদা জড়ানো অথচ একেবারে নতুন টাকার নোট টেবিলের ওপর ছড়িয়ে পড়ল। তারপর ছাত্রী বলল, স্যার গোনেন। আমরা দুজনেই সেই ভাঁজ হওয়া নোটগুলো মোটামুটি সোজা করে গুনতে শুরু করলাম। সেখানে পাঁচ টাকা থেকে শুরু করে এক শ টাকা সব রকমের নোটই ছিল। আমার ছাত্রী আমাকে বলেনি সে টাকাটা কোথায় পেয়েছে, কিন্তু দেখে বুঝলাম বিভিন্ন সময়ে সালামি ও উপহার হিসেবে টাকাগুলো সে পেয়েছিল। কারণ, প্রত্যেকটা টাকার নোট ছিলই নতুন। এভাবে দেড় হাজার পর্যন্ত গুনে বাকিটা ওকে ফেরত দিয়ে দিলাম আর বললাম তোমার বাবা বেতন দিলেই ফেরত দিয়ে দেব।
ঢাকা শহরে আসার আগে একটা কথা প্রায়ই শুনতাম, সেটা হলো ঢাকার বাতাসে টাকা ওড়ে। কিন্তু ঢাকায় আসার পর বুঝেছিলাম বাস্তবতাটা ঠিক এর উল্টো। সেখানে একজন কিশোরী মেয়ে আমাকে এরকম নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করছে, ব্যাপারটা আমার মনে দাগ কেটেছিল। আমি ওই কিশোরী মেয়েটার কাছ থেকে যে আচরণ পেয়েছিলাম, তারপর ঢাকা শহরের মানুষের অনেক দুর্ব্যবহার আমি হাসিমুখে মেনে নেওয়ার শক্তি পেয়েছিলাম। কারণ, আমি জানতাম এই শহরেও অনেক নিঃস্বার্থ পরোপকারী মানুষ আছে। এরপর আমি সেই ছাত্রীর ছোট দুই বোনকে পড়ানো শুরু করি একসময়। পরে ঢাকাতে আরও অনেক টিউশনি করেছি। কিন্তু ওই কিশোরী মেয়েটার সেদিনের আচরণ আজও ভুলিনি। সেই কিশোরী মেয়েটা এখন দুটি ফুটফুটে মেয়ের গর্বিত জননী। আমি আশা করে আছি একসময় আমার ছাত্রী ও তার দুই মেয়ের সঙ্গে দেখা হবে। তখন আমি তাদের বলব তারা কতখানি সৌভাগ্যবান যে, এমন মা পেয়েছে তারা।

মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>