মেঘ রোদ্দুরের খেলা-ছয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জানালার পাশের আলো আঁধারিতে মানুষের ছায়াটার ওপর ছোট চাচিরও দৃষ্টি পড়েছিল। তাই তৎক্ষণাৎ তিনি রাকিবের সান্নিধ্য থেকে ছিটকে সরে গিয়েছিলেন। ছিটকে গিয়ে নিজেকে সামলে কিছুক্ষণ বিব্রত ও বিভ্রান্তের মতো তাকিয়েছিলেন।

মাত্র কয়েক মুহূর্ত, কয়েক সেকেন্ড কিংবা কয়েক মিনিট!
ঘটনার শুরুতে ব্যাপারটা এমন আকস্মিক মোড় নেবে রাকিব মোটেও বুঝতে পারেনি। সেদিন বিকেলেই তাদের কলেজের নোটিশ বোর্ডে তাদের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল টানিয়েছিল। সে অবাক হয়ে দেখে, ছোট চাচি তার মতোই প্রথম বিভাগ পেয়েছেন।
তখনকার দিনে এ রকম মফস্বল কলেজ থেকে মানবিক নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পাওয়া অত সহজ ছিল না। সাধারণত খুব ভালো ছাত্রছাত্রীরাই পেত। কিন্তু ছোট চাচির মতো ছাত্রী, যিনি স্কুল মাধ্যমিক পরীক্ষায় টেনেটুনে কোনোমতে দ্বিতীয় বিভাগ পেয়েছিলেন। তবে এর কৃতিত্ব রাকিবের ছিল। সে সেদিন সন্ধ্যায় যখন প্রথম বিভাগের ফলাফল শোনায়, তখন ছোট চাচি শুধু অবাক হননি, আনন্দে আত্মহারা হয়ে তিনি যেন আয়ত্তহীন, নিজের ভেতর নিজে থাকেননি। সম্পর্কের বৈপরীত্য ভুলে রাকিবকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। বাইরে তখন খুব শান্ত একটা সন্ধ্যা ছিল। এমনই শান্ত ছিল যে, কিছুক্ষণের জন্য উভয় উভয়ের হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনতে পেয়েছিল।
বাসায় রান্না করার মতো কিছু নেই বলে রাকিব ফোনে ডমিনোস পিৎজায় অর্ডার দিয়ে খাবার এনে দুপুরের লাঞ্চটা সেরেছে। ডাইনিং টেবিলের ওপর অর্ধেকটা পিৎজা আতিকের জন্য রেখে সে বিছানায় খানিকটা গড়িয়ে নেওয়ার কথা ভাবল।
তখন প্রায় মধ্য দুপুর।
সকালের বৃষ্টিটা এখন আর নেই। তবে আকাশে মেঘলা-মেঘলা ভাবটা এখনো রয়ে গেছে। টিভি তখনো চালু। সে উবু হয়ে টি-টেবিল থেকে রিমোট নিয়ে টিভিটা বন্ধ করে দিল। একবার লাউঞ্জের সর্বত্র চোখ বুলিয়ে নিজের রুমে ঢুকতে গিয়ে সে দরজা গলে আতিকের রুমে তাকাল। আতিক উপুড় হয়ে বালিশ চেপে ঘোৎ ঘোৎ শব্দে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
রাকিব ভাবল, এ এক আজব মানুষ আতিক। কে বলবে তার জীবনে এত সমস্যা, এত দুঃখ। সে যখন ঘুমাতে যায়, তখন সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটি হয়ে ওঠে। কোনো দুঃখকষ্ট যেন তাকে স্পর্শ করে না।
এই নিউজিল্যান্ডে রাকিব এমনই আরেকজন সুখী মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছে। মতি ভাই। তিনি সোফাতে বসেই কথা বলতে বলতে মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু তিনি সত্যি কী সুখী মানুষ?
মতি ভাই বাংলাদেশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। রাজনীতির কারণে দেশ ছাড়েন। বর্তমানে অকল্যান্ড শহরে ট্যাক্সি চালান। এ দেশে যদিও সব কাজ গুরুত্বপূর্ণ। আদর্শ সমাজব্যবস্থায় সব কাজ সমান মর্যাদার। কিন্তু তারপরও কী মতি ভাই সুখী?
আর সে নিজে? রাকিব মাঝেমধ্যে ভাবে, সে কী খুব নিঃসঙ্গ অসুখী মানুষ নয়?
বিছানায় যাওয়া মানে তার ঘণ্টা দু-একের জন্য গড়াগড়ি করা। একজন দুঃখী মানুষের মতো ঘুমানোর জন্য তাকে স্বপ্নের ফাঁদ পাততে হয়। সুখের কল্পনায় তাকে ছোটখাটো একটা রাজ্য তৈরি করতে হয়। সেই রাজ্যে কখনো সে প্রজা হয়, কখনো সে রাজা হয়। কখনো সে রাজকুমার সেজে কঙ্কাবতীকে খোঁজে। হায় কঙ্কাবতী।
তার ছোট চাচির নামটা খুব সাদাসিধে ছিল। সাদিয়া।
রাকিব আজও বিছানায় শুয়ে জানালার দিকে মুখ করে একটা সুখের কাহিনি বানানোর চেষ্টা করল। একটি নদী। পশ্চিমে চলে যাওয়া কুল কুল শব্দের একটা নদী। পাড় বেয়ে নেমে গেছে সবুজ ঘাস। নদীতে বৈকালিক জোয়ারের টান। জোয়ারের জল যেন পাড়ের সবুজ ঘাস প্রায় ছুঁয়েছে।
নদীটার নাম গোমতী।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

নদীর আইল ধরে পশ্চিমে ভাটি অঞ্চলের কোনো গ্রামে বিকেলের সূর্যটা বাঁশ ঝাড়ের মাথায় স্থির। নদীর আইলে দক্ষিণের বাতাসে ধুলো উড়ছে। আইলের উত্তরে দিগন্ত বিস্তৃত ধানের জমি। ধানের জমিগুলো পেরিয়ে খানিকটা দূরেই কলাগাছ ছাপিয়ে কাজী বাড়ির একেকটা টিনের চাল দেখা যাচ্ছে। জমিতে শ্যালো পাম্প চলছে ঠ্যাট ঠ্যাট ঠ্যাট ঠ্যাট।
পশ্চিম কাজী ঘরের মেজ ছেলে তাঁর দিঘল লিকলিকে শরীরটা নিয়ে নদীর আইল ধরে হাঁটছেন। তিনি হাঁটছেন হেলেদুলে, কুঁজো হয়ে। লুঙ্গিটাকে অর্ধেক ওপরে তুলে। আইলে কারও সঙ্গে দেখা হলেই তিনি অযথা হাসছেন—হে হে, হে হে! কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘কাজী সাব, কই যাচ্ছেন?’ তিনি হেসে লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে জবাব দিচ্ছেন, ‘অন্তুপুর যাব, অন্তুপুর। হে হে, হে হে!’
কাজী বাড়ির মেজ ছেলে কখনই অন্তুপুর যান না। প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের আখাউড়া থানার অন্তুপুর গ্রামে যাওয়ার মতো এতটুকু জ্ঞানবুদ্ধি তার কোনো দিনই ছিল না। তবুও তিনি বলেন। কারণ-অকারণে বলেন।
পশ্চিম কাজী ঘরের মেজ ছেলের নাম কাজী ফরিদ আহমেদ। নামেই তিনি কাজী বাড়ির ছেলে। কিন্তু চলাচলতিতে তিনি ছিলেন উত্তর কাজী ঘর, অদন কাজীর বছর বাঁধা কামলা আলী আকবরের চেয়েও অপাঙেক্তয়। বাড়িতে তিনি ছিলেন ওঁধবোধহীন মানুষ। গ্রামের মানুষের কাছে ছিলেন বেপতার, বে-আক্কেল কাজী।
আক্কেলের কারণে তার পথঘাটের কোনো ঠিকানা ছিল না। তার সর্বদা হাঁটু অবধি পা ধুলোবালিতে ধূসর হয়ে থাকত। পায়ের স্থানে স্থানে ছিল আঁচড়ের দাগ। দাড়িগোঁফ এলোমেলো, অযথাই দাঁতাল হাসি। কাজী বাড়ির এই মেজ ছেলে সারা দিন কোথায় ঘুরে বেড়াতেন, কখন বাড়ি ফিরতেন, কেউ তার খবর রাখত না। এ বাড়ি, ও বাড়িতে গিয়ে দাওয়ায় বসে পড়তেন। কেউ কাজী ঘরের মানুষ বলে সম্মান দিয়ে বসাত। কেউবা সেই সম্মানটুকু দিতেও ভুলে যেত। কারও বাড়িতে একমুঠো মুড়ি বা একবেলা ভাত পেলে তিনি সারাটা দিন সেই বাড়িতে কাটিয়ে আসতেন। রাতে বাড়ি ফিরে বৈঠক ঘরের পশ্চিমে একটা দিঘল চৌকিতে ঘুমাতেন।
সেই মেজ ছেলে একদিন বিয়ে করে। পাঁচ বছর তাঁর সংসারটাও টেকে। তাঁর একটা পুত্রসন্তানও হয়। তারপর বৈশাখের এক সন্ধ্যায় তাঁর বউ তাঁকে ফেলে, তাঁর ছেলেকে ফেলে দক্ষিণ কাজী বাড়ির মোখলেস কাজীর জায়গীর মাস্টারের হাত ধরে চলে যায়।
বউ পালিয়ে যাওয়ার পর কাজী ফরিদ আহমেদ গ্রামের মানুষের কাছে আরও আহাম্মক ও হাবাগোবা হয়ে ওঠেন। প্রায় সন্ধ্যায় তিনি গোমতির দক্ষিণ ঘাটে চলে যেতেন। ঘাটে বসে তিনি নদীর ওপারের দিকে তাকিয়ে বউয়ের জন্য কাঁদতেন—ইঁ-ইঁ-ইঁ-ইঁ।
রাকিব মনে মনে একটা সুখের কাহিনি ফাঁদবে বলে জোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই কাহিনিতে কী এক বিচ্ছিন্ন দুঃখবোধ এসে ভিড় করল। তার জীবনটাও যে তার বাবার মতোই হলো। তার বউ এমেন্ডাও চলে গেল সিরাজ নামের এক বাঙালির সঙ্গে। তার ছোট্ট একটা অনুপস্থিতি ছিল মাত্র! সেও পাঁচ বছর সংসার করেছিল। তার একটা মেয়েও হয়েছিল।
এমেন্ডার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার পর আরও পাঁচটা বছর চলে গেছে। হ্যাঁ, পাঁচটা বছর। রাকিব নিজে নিজে মাথা ঝাঁকাল। এই পাঁচটা বছর সে কী তার বাবার মতো বউ হারানোর কান্না কাঁদেনি? শুধু পার্থক্য একটাই, এখানে গোমতী নদী নেই, আছে ওয়াইকাটো নদী। আর তার বাবা কাজী ফরিদ আহমেদ হাবাগোবা বলে বউ হারানোর কান্না কাঁদতেন প্রকাশ্যে। আর সে কাঁদে ভেতরে-ভেতরে। একান্তে নিভৃতে।
মোবাইলটা ভেজে উঠল।
রাকিব ভাবল, ভদ্রমহিলা আবার ফোন করেননি তো?
সে আস্তে করে বেড সাইড টেবিলের ওপর থেকে মোবাইলটা হাতে নিল। স্ক্রিনে দেখল, তার ছোট ফুফু অস্ট্রেলিয়া থেকে ফোন দিয়েছেন। সে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল।
তার ছোট ফুফু অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থাকেন। সেখানে তিনি প্রায় একুশ বছর ধরে বসবাস করছেন। তার ছোট ফুফা একটা এগ্রি-রিসার্চ ইনস্টিটিউটে বেশ ভালো পোস্টে চাকরি করেন।
ছোট ফুফু জিজ্ঞেস করলেন, হ্যালো রাকিব, আমি তোর ছোট ফুফু।
রাকিব আস্তে করে বলল, তোমার নম্বর তো আমার মোবাইলে সেভ করা আছে।
—আমি জানি।
—আজ তাহলে এত ঘটা করে পরিচয় দিচ্ছ কেন?
—কারণ আছে, হ্যাঁ!
—কি কারণ?
—এখনই বলছি না। আগে বল, তুই কেমন আছিস?
—ভালো, তুমি কেমন আছ?
—আর ভালো? সিজনাল ফ্লুটা মনে হয় অস্ট্রেলিয়াতে সবার আগে আমাকেই খুঁজে পেয়েছে। পুরো পাঁচ দিন ভুগলাম।
—ফুপা কেমন আছে?
—আরে, ওর কথা আর বলিস না। ওরে নিয়েই তো ঝামেলায় আছি। খায়, অফিস যায় আর ঘুমায়। দিন দিন বিশাল আকারের মোটা হচ্ছে। কত বলি, চলো কোথাও থেকে হাঁটাহাঁটি করে আসি। বাসার পাশেই তো পার্ক। বলি, একটু ঘুরে আসতে। কিন্তু না। তার নাকি ঘুম পায়। পঞ্চাশ বছর হয়নি, অথচ এখনই ডায়াবেটিক রোগী। কিডনির সমস্যা ভুগছে। ব্লাড প্রেশার হাই!
রাকিব চুপ।
ছোট ফুফু কথা বাড়ালেন, তোর ফুপা আমাকে কি বলে জানিস, আমি নাকি বুড়ি হয়ে যাচ্ছি! আমি নাকি তার চেয়ে দ্বিগুণ মোটা। আমি শুধু খাই আর ঘুমাই। কেমন ফাজিল দেখ। নিজের দোষ আমার ওপর চাপায়।
রাকিব আবারও চুপ। সে ছোট ফুফুর এসব কথাবার্তার মধ্যে হু-হ্যাঁ পর্যন্ত করে না। সে জানে, মুহূর্তে সে যদি হু-হ্যাঁ করে ছোট ফুফু গল্পটা আরও লম্বা করবেন। সে আর তার কাছে কখনো ইতিবাচক কথাবার্তা পায় না। সব সময়ই হতাশাব্যঞ্জক কথাবার্তা। তার কথা বলার ধরন শুনে যে কেউ মনে করবেন, তিনি যেন কত কী রাজ্যের সমস্যার মধ্যে আছেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তিনি মোটেও কোনো সমস্যায় নেই। বলা যায়, তিনি রানির হালতে আছেন। একটা মাত্র ছেলে। সে নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটিতে মেডিকেল সায়েন্স পড়ে। সিডনির প্যারামাটা সাবার্বে তাদের বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়ি। ছোট ফুপার ভালো চাকরি। ছোট ফুফু নিজেও একটা সুপার মার্কেটের চেক আউটে কাজ করেন। ঢাকাতেও তাদের রমরমা অবস্থা। ঢাকার বনশ্রীতে ডবল ইউনিটের ছয়তলা বিরাট বাড়ি। মিরপুরে তিন-তিনটা দোকান। কিন্তু তারপরও তার হতাশার শেষ নেই। একটা পয়সা খরচ করতেও হিসাব করেন।
ছোট ফুফুর আরেকটা ব্যাপার রাকিবের খুব অপছন্দ। তিনি যার-তার কাছে নিজের বয়স কমান। তার বয়স যে প্রায় সাতচল্লিশ বছর। কিন্তু তিনি লোকজনকে বলে বেড়াতে পছন্দ করেন, তার বয়স নাকি পঁয়ত্রিশ বছর। সময়-সময় তিনি বয়স ত্রিশের নিচেও কমিয়ে ফেলেন। তিনি মাঝেমধ্যে ভুলেই যান, তার যে বিশ বছর বয়সী একটা ছেলে আছে।
রাকিবকে চুপ হয়ে থাকতে দেখে ছোট ফুফু নিজ থেকেই প্রসঙ্গ পাল্টালেন। জিজ্ঞেস করলেন, এই রাকিব, আজ সকালে কারও সঙ্গে কি তোর কথা হয়েছে?
—কার সঙ্গে?
—না মানে, কেউ কি তোকে অস্ট্রেলিয়া থেকে ফোন দিয়েছিলেন?
—হ্যাঁ, এক ভদ্রমহিলা ফোন দিয়েছিলেন।
—তুই তোর মাকে ভদ্রমহিলা বলছিস যে, হি হি, হি হি!
—ছোট ফুফু, তুমি হেসো না। তুমি জানলে কীভাবে?
ছোট ফুফু আবারও হাসলেন, হি হি, হি হি। বললেন, আমি জানব না মানে, আমিই তো তাকে আবিষ্কার করেছি।
সকালে ভদ্রমহিলার ফোন পাওয়ার পর থেকেই রাকিবের মাথায় যে এ ব্যাপারটা ঘুরপাক খায়নি, তা নয়। সে ভেবেছিল, ভদ্রমহিলা তার ফোন নম্বর পেয়েছেন কোথায়? সে একবার ভেবেছিল, নিশ্চয় ভদ্রমহিলা দেশের কারও কাছ থেকে তার ফোন নম্বরটা পেয়েছেন। কিন্তু পরক্ষণই ভেবেছে, দেশেরই কে তাকে ফোন নম্বর দেবে? তার বড় চাচির কাছে তার ফোন নম্বর আছে বলে মনে হয় না। একবার তার ছোট ফুফুর কথাও মনে হয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণ সে ভেবেছে, তিনি যে কৌতূহলী, নিশ্চয়ই ভদ্রমহিলা ফোন দেওয়ার আগে তিনি একবার ফোন দিয়ে ফেলতেন।
ছোট ফুফু বললেন, এ জন্যই তো আজ ঘটা করে ফোনের শুরুতে নিজের পরিচয়টা দিলাম। যদি আবার তোর মার সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলিস! হি হি, হি হি!
রাকিব আবার চুপ হয়ে গেল।
ছোট ফুফু নিজ থেকেই বললেন, রাকিব শুনবি, সে এক ইন্টারেস্টিং ঘটনা। তোকে তো আলী ভাই-শেলি ভাবির কথা অনেক বলেছি। ওই যে, সিডনি থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে, ক্যাম্বেল টাউনে থাকেন?
রাকিব বলল, হ্যাঁ, ওনারা আমাদের কেমন রিলেটিভ হন।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওনারাই।
—ওনারা আবার কি করলেন?
—ওনারা কিছু করেনি তো। ঘটনাটা শোন আগে। পরশু রাতে আমরা ওনাদের বাসায় ইনভাইটেড ছিলাম। ওনাদের ছেলের জন্মদিন। ওখানেই তোর মার সঙ্গে দেখা।
—হুম্ম, তাই?
—হ্যাঁ, আচ্ছা, ওনাকে তোর মা বলছি বলে তুই রাগ করছিস নাতো?
—ছোট ফুফু, তুমি ফাজলামো ছাড়তো!
—হি হি, হি হি! হয়েছে, হয়েছে! মাই গড, এখনই দেখি মা বলতে অজ্ঞান!
—তুমি ঘটনাটা বললে বলো। কথায় শুধু শুধু লেজ লাগাবে না।
—হি হি, হি হি। আচ্ছা শোন, বলছি। আলী ভাইদের বাসায় গিয়ে মহিলারা যেখানে বসেছে সেখানে দেখি, রুমের কর্নারের একটা চেয়ারে এক ভদ্রমহিলা বসে আছেন। যাকে দেখতে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আর ভদ্রমহিলার মধ্যে কী এক আলাদা একটা আকর্ষণ আছে। অঙ্কুরকালে যে তিনি অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন, তা এ বয়সেও বোঝা যাচ্ছিল। এ বয়সেও তিনি সেই সৌন্দর্য ধরে রেখেছেন, রাকিব, তুই বিশ্বাস করবি না, তোর মা যে কী সুন্দরী ছিলেন!
—সুন্দরের গল্পটা পরে শুনব। আগে ঘটনাটা বলো।
—আরে, বলছি তো। এর আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। আচ্ছা, তোর কি তোর মার কথা মনে আছে?
—মনে থাকবে না কেন, এগারো-বারো বছর বয়সী একজন বালক তার মার চেহারা মনে রাখতে পারবে না কেন?
—এগারো-বারো বছর মানে? তোর মা তো চলে গেছেন তোর বয়স যখন চার?
—তারপরও তিনি কয়েকবার এসে আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। শেষবার যখন তিনি আমার সাথে দেখা করেন, তখন আমার বয়স প্রায় বারো বছর ছিল।
—বলিস কী, এই কথা! কিন্তু তুই বাড়িতে তো এসব কথা কখনো বলিসনি?
—তিনি না করেছিলেন। আর ওসব কথা তো বলার মতো কিছুই ছিল না।
—সেই বয়সেই তোর এত বুদ্ধি ছিল?
রাকিব এর কোনো জবাব দিল না। চুপ হয়ে গেল।
টেলিফোনের ওপাশে ছোট ফুফু কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেলেন।
রাকিব রুমের জানালা গলে বাইরে তাকাল।
বাইরে আকাশে মেঘলা ভাবটা প্রায় কেটে গেছে। রোদটা মেঘ সরিয়ে উঠি উঠি করে উঠছে না। কিন্তু চারদিকে মেঘের ছায়ার সঙ্গে রোদের কী এক নরম আভা।
ছোট ফুফু বললেন, আচ্ছা শোন, ঘটনাটা বলি। রুমের একপাশে বসে আমি মাঝেমধ্যে তাঁর দিকে তাকাচ্ছি আর ভাবছি, ভদ্রমহিলাকে এত চেনা চেনা লাগছে কেন? তিনি কে হতে পারেন?...একসময় দেখি, ভদ্রমহিলাও আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ঠিক সেই সময় শেলি ভাবি রুমে এসে আমাদের ডাইনিং টেবিলে খাবারের জন্য ডাকেন। ঠিক তখনই উনি আমার পাশে এসে দাঁড়ান। আস্তে করে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনাদের বাড়ি কি মুরাদনগর?’ আমি বলি, জি। তারপর কথা নেই বার্তা নেই ভদ্রমহিলা আমার হাত চেপে ধরেন!
ছোট ফুফু একটু দম নেওয়ার জন্য থামলেন।
টেলিফোনের এপাশে রাকিবের মধ্যে পিনপতন নীরবতা।
ছোট ফুফু আবার বলতে শুরু করলেন, ভদ্রমহিলা আমার হাত চেপে ধরে টেনে একটু আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘রুনা, তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছ?’ বিশ্বাস কর রাকিব, আমি তখনো তোর মাকে চিনতে পারিনি। তাই কোনো জবাব না দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। ভদ্রমহিলা বলেন, ‘আমি আঁখির মা!’
ফোনের এপাশে রাকিবের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দটাই যেন পড়ছে।
ছোট ফুফু হালকা গলায় হেসে আবার শুরু করলেন, বুঝছিস রাকিব, তোর মা যে তোকে ছোটবেলায় আঁখি নামে ডাকত আমি সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। তাই ভদ্রমহিলার কথায় আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করি, কোন আঁখি? ভদ্রমহিলা একটু থেমে আস্তে করে বলেন, ‘রুনা, আমি তোমার মেজ ভাবি, রাকিবের মা!’
ছোট ফুফু আবারও একটু হালকা হেসে বললেন, রাকিব, এবার বোঝ ঠেলা। তুই বিশ্বাস করবি না, আমি যেন রীতিমতো আকাশ থেকে পড়ি!
রাকিব আস্তে করে সায় দিয়ে বলল, হুম। বলেই সে আবার বাইরে তাকাল।
বাইরে মেঘ কেটে রোদ উঠেছে। শীতের হলুদ রোদ। জানালা গলে এক চিলতে রোদ তার পায়ের কাছেও এসে পড়েছে।
ছোট ফুফু বললেন, বুঝছিস রাকিব, আমি আকাশ থেকে পড়ে থ হয়ে গেলেও তিনি খুব স্বাভাবিক ছিলেন। খুব চতুর মহিলা তো! নয়তো একটা চার বছরের বাচ্চা ছেলে ফেলে কেউ কি লাং ধরে চলে যায়?
রাকিব পায়ের কাছে মুখ থুবড়ে পড়া রোদটা থেকে দৃষ্টিটা সরিয়ে অযথাই এদিকওদিক করল। কোনো কথা বলল না।
ছোট ফুফু বললেন, তোর মাকে খারাপ বললাম বলে তুই আবার রাগ করলি নাতো?
রাকিব বিরক্তির গলায় বলল, ছোট ফুফু, আমি একটু শোব। এখন ফোন রাখি।
ছোট ফুফু তাড়াতাড়ি বললেন, আরে না, না। তোর মার সঙ্গে তোর কি আলাপ হলো, সেটা তো বললি না?
রাকিব বলল, তেমন কোনো কথা হয়নি।
—কেন, তেমন কোনো কথা হয়নি কেন?
—কেন হবে?
—না মানে, এতদিন পর তোদের মা-ছেলের কথা হলো?
রাকিব চুপ হয়ে গেল।
ছোট ফুফু বললেন, কিন্তু তোর মাতো বললেন তিনি নাকি তোর সাথে অনেকক্ষণই কথা বলেছেন?
—অনেকক্ষণ না।
—তাহলে কতক্ষণ?
—ছোট ফুফু, ওটা জানা কি খুব ইম্পর্ট্যান্ট?
—না। ইম্পর্ট্যান্ট না। আবার ইম্পর্ট্যান্টও। আমি তোর ল্যান্ড নম্বর দিলাম। পরে তোর মোবাইল নম্বরটাও দিলাম। তোর মাকে খুঁজে বের করলাম।
—তুমি খুঁজে বের করলে কোথায়? ওটা একটা কো-ইন্সিড্যান্ট ছিল।
-আরে বাব্বা!...আমাকে একটু ক্রেডিট তো দিবি।
-ছোট ফুফু, আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
-ধ্যাত, তুই একটা গাধা।
-আর কিছু?
-শোন, শোন, তোর মার কথা শেষ হয়নি।
-আর কি কথা বলবে, বলো?
-তুই নাকি তাঁর সাথে তেমন একটা কথা বলিসনি?
-তিনি তাই বলেছেন?
-হ্যাঁ, আজ সকাল থেকে না হলেও চারবার ফোন দিয়েছেন।
-তাঁর সাথে কি কথা বলব?
-গাধা, ওটাও কি তোকে বলে দিতে হবে? তিনি তোর মা!
‘মা’! রাকিব মনে মনে শব্দটা একবার উচ্চারণ করল। তার ভেতরেও কী একটা জিনিস যেন নাড়া দিল। সত্যি তো উনি তার মা!
ছোট ফুফু বললেন, জানিস রাকিব, তিনি নাকি জানতেন, তুই অনেক দিন ধরে নিউজিল্যান্ডে। কয়েক বছর আগে তিনি বাংলাদেশ গিয়ে মুরাদনগর গিয়েছিলেন। ওখানে কারও কাছ থেকে তোর খবর জেনেছিলেন। পরে তোর ফোন নম্বরের জন্য ঢাকাতে বড় ভাবির বাসায় পর্যন্ত গিয়েছিলেন। কিন্তু ওখান থেকে তোর ফোন নম্বর বা ঠিকানা কোনোটাই পাননি।
রাকিব কিছুটা অবাক হয়ে বলল, কিন্তু বড় চাচি তো কখনো আমাকে এ কথা বলেননি?
ছোট ফুফু খানিকটা বিরক্তির গলায় বললেন, ওটা মানুষ নাকি? ওটা তো একটা ইডিয়ট, ওটার কথা বলে লাভ আছে?
রাকিব প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে জিজ্ঞেস করল, উনি কত বছর ধরে অস্ট্রেলিয়াতে আছেন?
-তিন মাস ধরে নাকি। আরও ছয়-সাত মাস থাকবেন।
-উনি অস্ট্রেলিয়াতে কেন?
-ওনার ছেলে অস্ট্রেলিয়াতে থাকেন যে?
-ওনার ছেলে?
-হ্যাঁ, তোর ভাই। হাফ ব্রাদার। হি হি, হি হি।
রাকিব গম্ভীর গলায় বলল, ছোট ফুফু, এটা কি হাসির কথা?
ছোট ফুফু হাসি ধরে রেখেই বললেন, হ্যাঁ, হাসির কথাই। তুই তৈরি একটা ভাই পেয়ে গেলি। কপাল! হি হি, হি হি।
রাকিব বলল, ছোট ফুফু, তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমি ফোন কেটে দিলাম।
ছোট ফুফু বললেন, আরে, হয়েছে হয়েছে, তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? আমি তো এমনি বললাম। শোন তাহলে, তিনি মূলত দুবাইয়ে থাকেন। তাঁর ছেলে নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্টে সবে গ্র্যাজুয়েট হয়ে আর্লিস অ্যালুমিনিয়াম নামে এক অ্যালুমিনিয়াম কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে। সেই তার মাকে ভিজিট ভিসায় অস্ট্রেলিয়া নিয়ে এসেছে।
-তিনি দুবাইতে কি করেন?
-তিনি কিছু করেন না। তাঁর স্বামী, মানে তোর...।
রাকিব বলল, ছোট ফুফু, আবার ফাজলামি করবে না।
ছোট ফুফু হেসে বললেন, আচ্ছা, ঠিক আছে। হি হি, হি হি। শোন, তাঁর স্বামী অনেক বছর ধরে ওখানে বিজনেস করেন। দুবাই এয়ারপোর্টে তাদের দোকান আছে। গোল্ডের দোকান। আমি অবশ্য তাকে বলেছি নেক্সটে অস্ট্রেলিয়া আসলে আমার জন্য যাতে গোল্ড নিয়ে আসেন। দুবাইয়ের গোল্ড হি-হি!
ছোট ফুফুর অযথা ন্যাকা হাসিতে রাকিব এবার বিরক্ত হলো না। তার তৎক্ষণাৎ অনেক দিন আগের কিছু স্মৃতি মনে পড়ে গেল। তার মা কাজীবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর যে কয়বার তাকে দেখতে এসেছেন, বরাবরই তিনি মধ্যদুপুরে এসেছেন। এসেই স্কুলের মধ্যবিরতির সময় তাকে নিয়ে মিষ্টির দোকানে চলে যেতেন।
একবার তিনি একটা বাচ্চা ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। তার স্পষ্ট মনে আছে, বাচ্চাটা সেদিন ট্যা ট্যা করে খুব কাঁদছিল। সে মিষ্টির দোকানে মিষ্টি খেতে বসে খুব বিরক্ত হচ্ছিল। পরবর্তীতে এ জন্যই কিনা, ভদ্রমহিলা সেই বাচ্চা ছেলেটাকে আর কখনো সঙ্গে করে নিয়ে আসেননি। এমন কি শেষবার যখন দেখা হয়, তখনো না।
রাকিব ভাবল, সেদিনের সেই ছোট্ট বাচ্চাটাই কি এখন অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস করছে?
ছোট ফুফু জিজ্ঞেস করলেন, কীরে, চুপ হয়ে গেছিস যে? গোল্ডের কথা বললাম বলে আবার রাগ করিসনি তো?
রাকিব বলল, ছোট ফুফু, তুমি করে সিরিয়াস হবে?
ছোট ফুফু হেসে বললেন, মরলে। হি হি, হি হি!
-তুমি মরলেও সিরিয়াস হবে না। দোজখে তো যাবে নিশ্চিত। ওখানে গিয়েও হাসবে।
-হাসি জীবনের মহা ওষুধ। ওটা কি জানিস?
-আমার অত জানার প্রয়োজন নেই। আচ্ছা, একটা কথা বলো, তুমি কি ওনার ছেলেকে দেখেছ?
-হ্যাঁ, দেখেছি তো। আলী ভাইয়ের বাসায় এসেছিল।
-ওনার ছেলেটা দেখতে কেমন হয়েছে?
-তোর মতো কালো না। ফরসা হয়েছে। বলতে পারিস, একদম তোর মার ফটোকপি।
-তাই! বলেই রাকিব ফোনের এপাশে অনির্ধারিত মাথা নাড়ল।
ছোট ফুফু কী ভেবে কৌতুকের গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা রাকিব, একটা কথা। তুই তো ফোনে দুটার বেশি তিনটা কথা বলিস না। আমি ফোন দিলে তুই শুধু হুঁ-হাঁ করিস। কিন্তু আজ এত কথা বলছিস যে?
রাকিব বলল, তুমি আমাকে ফোন রাখতে দিচ্ছ না যে?
ছোট ফুফু বললেন, ও হো, না। বাপধন, একটাকে বলে ব্লাড কানেকশন। মা তো! যত দূরেই থাকুক! (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন