জাদুর শহর-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কবির নামটা ভুলে গেছি। কিন্তু কবিতার লাইন দুটি এখনো মনে আছে। ‘বলল ডেকে দিঘির কালো জল,/ আমরা সবাই না ঘুমানোর দল।’

মাধ্যমিকের কোনো এক ক্লাসের বাংলা পাঠ্যবইয়ে পড়েছিলাম যত দূর মনে পড়ে। বুয়েটে সুযোগ পেয়ে ছয় মাস বসে থাকার পর যখন আমাদের ক্লাস শুরু হলো তখন আমাদের ক্লাসের প্রতি তেমন মনযোগ ছিল না। তার চেয়ে বেশি মনযোগ ছিল এই আজব শহরের প্রতি। দিনেরবেলায় প্রতিদিনই সেই চিরচেনা দৃশ্য—ট্রাফিক জ্যাম, কালো ধোঁয়া, মানুষের চেষ্টা সময়ের চেয়ে দ্রুত চলার। সোজা কথায় পুরোপুরি যান্ত্রিক এক শহর। যার মধ্যে প্রাণের কোনো অস্তিত্বই ছিল না।
আমরা যারা মফস্বল থেকে এই শহরে এসেছিলাম তাদের কাছে ব্যাপারটা অনেকটা বনের পাখিকে খাঁচার মধ্যে ভরার বৃথা চেষ্টার মতো মনে হতো। মফস্বলে কোনো কিছুই রুটিন মাফিক করতাম না। পড়াশোনাতো বটেই। তাই বুয়েটের গৎবাঁধা জীবনে আমরা কয়েক দিনেই হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। সেখানে সপ্তাহ শেষের দুই ছুটির দিন শুক্রবার ও শনিবার মরুর বুকে এক পশলা বৃষ্টির মতো আনন্দ বার্তা নিয়ে হাজির হতো। আমি আর পাভেল থাকতাম রশিদ হলে। জ্যাক আর সুদীপ্ত থাকত আহসান উল্লাহ হলে। বৃহস্পতিবার রাতে আমরা সবাই বুয়েটের যেখানে ওভারব্রিজ আছে তার নিচে তখন একটা ট্রাফিক আইল্যান্ড ছিল, সেখানে মিলিত হতাম রাত ১০টার দিকে। অবশ্য তখনো ওভারব্রিজটি তৈরি হয়নি। এখন তার শুধু বেদিটা আছে কিন্তু ছাদটা নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফজলে রাব্বি হল থেকে আমরা ডেকে নিতাম হিটু আর চয়ন ভাইকে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল থেকে যোগ দিত আমাদের আরেক পাভেল। আর মাঝেমধ্যে এসে আমাদের একমাত্র আর্মি বন্ধু ক্যাপ্টেন রঞ্জু এসে যোগ দিত আমাদের সঙ্গে।
রাত ১২টা পর্যন্ত চলত আড্ডা। তারপর বকশীবাজার মোড়ের ময়ূরী হোটেল বা আরও একটা হোটেল ছিল এখন নাম মনে আসছে না অথবা চানখাঁরপুল মোড়ের মিতালি বা সোহাগে গিয়ে পরোটা আর ডিমের সঙ্গে কালা-ভুনা দিয়ে ভূরিভোজ সেরে সেই গলি দিয়েই প্রথম দিকে পুরান ঢাকায় ঢুকে পড়তাম। এরপর এই গলি সেই গলি করে উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটি চলত রাত ৩টা-৪টা পর্যন্ত। পরের দিকে অবশ্য নতুন ঢাকার দিকেও যাওয়া শুরু হয়েছিল। তারপর আবার এসে সেই ট্রাফিক আইল্যান্ডে বসতাম আমরা। আবার শুরু হতো আড্ডা। চলত ভোর সাড়ে ৬টা পর্যন্ত। কারণ ভোর সাড়ে ৬টা থেকে চানখাঁরপুল মোড়ের মিতালি হোটেলে পাওয়া যেত ভুনা খিচুড়ি আর পরোটা অথবা নান সঙ্গে নিহারি। এই আইটেমটা সকাল হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফুরিয়ে যেত। একেকদিন একেকটা খাওয়া হতো।
খেয়ে আবার এসে সেই ট্রাফিক আইল্যান্ডটাতেই বসতাম আমরা। তারপর আরও কিছুক্ষণ চলত আড্ডা। এরপর আমি আর পাভেল আমাদের হলে আর জ্যাক ও সুদীপ্ত ওর হলে ফিরে যেত। চয়ন ভাই ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাভেলও তাদের নিজ নিজ হলে ফিরে যেত। এভাবেই চলেছিল প্রায় দ্বিতীয় বছরের দ্বিতীয় টার্ম পর্যন্ত। এরপর সবাই যার যার পড়ালেখায় মনোযোগী হয়ে গেল। প্রত্যকের নিজের নিজের ডিপার্টমেন্টের বন্ধুমহল তৈরি হলো, তখন সবাই তাদের নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। যদিওবা কখনো রাতে আসা-যাওয়ার পথে দেখা হয়ে যেত, সামান্য কুশল বিনিময় ছাড়া আর কিছু হতো না। অবশ্য ওরা নিজেদের নতুন মহল নিয়ে হাঁটাহাঁটি করত না, পড়াশোনাই বেশি করত।
এর মধ্যে একবারের ঘটনা এখনো আমাদের মনে দাগ কেটে আছে। রাজশাহী থেকে বন্ধু শাহেদ, সৌরভ আর মান্না এসেছে। আমরা মাঝরাতে মিতালি হোটেল থেকে পরোটা আর ডিম খেয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক মিলনকেন্দ্রের তেমাথার ক্যানটিনটার পাশের উঁচু জায়গাটার মাঝে অবস্থিত ইটের গোলাকৃতি বসার জায়গাটার ওপর কেউ শুয়ে, কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম। প্রচণ্ড গরমের সময় হওয়াতে আমাদের কারও গায়েই কোনো কাপড় নেই। হঠাৎ একটা পুলিশের গাড়ি এসে আমাদের পাশের রাস্তায় থামল। সেখান থেকে জনা দশেক পুলিশ দৌড়ে এসে আমাদের ঘিরে ধরে দাঁড়াল তারপর কর্কশ গলায় বলল, স্যার আপনাদেরকে গাড়িতে ডাকে।
আমরা সবাই কাপড় পরে গাড়ির কাছে গেলাম। গাড়ির সামনের সিটে বসা অফিসার আমাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। আমাদের সবার পরিচয় জানার পর তিনি বললেন, আপনারা সবাইতো ভালো ছাত্র। এত রাতে এখানে কি করেন। উত্তরে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাভেল বলল, স্যার রাজশাহী ও কুষ্টিয়া থেকে বন্ধুরা এসেছে তো, তাই ওদেরকে আপ্যায়ন করে এখানে এসে বিশ্রাম নিচ্ছি। উত্তর শুনে পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, জানেনই তো এখন তত্ত্বাবধায়কের সরকারের সময়কাল। তাই নিয়মকানুন একটু বেশিই কড়া। আপনারা সবাই নিজ নিজ হলে ফিরে যান বলে তিনি চলে গেলেন। তিনি চলে যাওয়ার পরও আমরা আরও বেশ কিছুক্ষণ থেকে সকলে নিজ নিজ হলের দিকে রওনা দিলাম। হলে ফেরার পথে সলিমুল্লাহ হলের গেটের পাশ থেকে আরও একদল পুলিশ গতিরোধ করে দাঁড়ায়। তখন আমরা বললাম ভাই, আমাদের একবার ধরেছিল। উত্তর শুনে একজন পুলিশ হাসতে হাসতে বলল, ও আচ্ছা যান তাহলে।
যা হোক, আমি আমার বন্ধুদের মতো হতে পারলাম না। আমি প্রায় প্রতি রাতেই পাভেলের কক্ষে একবার করে উঁকি দিতাম। যদি কখনো সে বলে, চলো আজ হাঁটতে যাওয়া যাক। না, তা আর হয়ে ওঠেনি। তখন আমি বিকল্প সঙ্গী সন্ধান শুরু করলাম। ঠিক এ সময়ই আমার রুমের সিনিয়র ভাইয়ের ম্যারাথন থাকা শেষ হওয়াতে একটা সিট ফাঁকা হলো। সেই সিটে উঠল ফরহাদ নামে একজন। প্রথমদিকে তাকে আঁতেল বলেই ভুল করছিলাম। কারণ অবশ্য ছিলই। তার অগোছালো চেহারা ও চোখে চশমা, আঁতেল উপাধি পাওয়ার যোগ্য ছিল। কিন্তু খুব দ্রুতই বুঝতে পারলাম, এই ছেলে আমার ক্যাটাগরির। পার্থক্য একটা আছে। সেটা হলো, আমি আমার ভাব প্রকাশ করতে পারি না। কিন্তু ওই ছেলের ভাব খুবই সুন্দর এবং সে প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করতে পারত। কারণ তার ছিল চমৎকার কাব্যপ্রতিভা। আমাদের নতুন জুটি দ্রুতই জমে উঠল। পরে আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিল আমাদের ফ্লোরেরই আরেক কবি তারিক।
সারা দিন টিউশনি শেষে আমি আগে ফিরলে তাদের জন্য অপেক্ষা করতাম আর তারা আগে ফিরলে আমার জন্য অপেক্ষা করত। ফরহাদের সঙ্গে থেকে থেকে আমি আমার শৈশব-কৈশোরের সেই দিনগুলোতে যেন ফিরে গেলাম। রাতে হলের গাছ থেকে আম চুরি, হঠাৎ বৃষ্টি এল, তখন রাত যতই হোক দুজনে মিলে বৃষ্টিতে ভিজি। বিশেষ করে শীতকালের শীত নামানো বৃষ্টিতো কোনোভাবেই মিস করতাম না। এই বৃষ্টির একটা আলাদা সৌন্দর্য ছিল। শহীদ মিনারে ঘুমানোটা একসময় খুবই প্রিয় কাজে পরিণত হলো। এমনই একদিন আমরা প্রথম আবিষ্কার করলাম, শহীদ মিনারের পেছনে পলাশ ফুলের গাছ আছে। কৃতিত্বটা অবশ্য ফরহাদের। ওর ছোট বাথরুম পেয়েছিল। শহীদ মিনারের পেছনের জায়গাটাতে গিয়ে ও খেয়াল করে যে গাছে থোকায় থোকায় পলাশ ফুল ফুটে আছে। তারপর আর যায় কোথায়। গেছো আমি বরাবরের মতোই গাছে উঠে গেলাম ফুল পাড়তে। অবশ্য সফলকাম হতে পারিনি সেই দিন। পরে তলা থেকে কুড়িয়েই নিজেদের সান্ত্বনা দিয়েছি।
চারুকলার গাছগুলোতে অনেক আম ধরত। একদিন শাহবাগের দিকে হাঁটার সময় ফরহাদ বলল, ভাই দেখেন কত আম! আর যায় কোথায়, ঢিলাও। অনেকক্ষণ ধরে ঢিলায়ে ঢিলায়ে দুই-তিনটা পাড়লাম। এভাবে সফল না হয়ে আমি গাছে চড়ার রাস্তা খুঁজতে শুরু করলাম। পেয়েও গেলাম। দেখি একটা সোডিয়াম লাইটের খাম্বা আমের গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আলো দিচ্ছে। সেটা বেয়ে উঠে গিয়ে অনেক আমি অনেক আম পেড়েছিলাম সেই দিন। সব আনতে না পেরে বাকিগুলো গার্ড মামাকে দিয়ে এসেছিলাম।
ঢাকা শহরে রাতে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে আমরা জীবনের অন্য একটা পিঠের সঙ্গে পরিচিত হই, যেখানে দুবেলা দুমুঠো ভাতের জন্য মানুষ তার সর্বস্ব বিকিয়ে দিচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের শহীদ মিনারের পাশের গেটের রাস্তার ঠিক বিপরীত পাশেই একজন ভাসমান যৌনকর্মী তার খদ্দেরদের নিয়ে রাস্তার পাশের নিচু জায়গায় হারিয়ে যেতেন। শামসুন্নাহার হলের সামনের ত্রিকোণাকৃতি জায়গাটাতে যেখানে বড়বড় গাছ আছে তার মধ্যে একজন যৌনকর্মী থাকতেন। আমি সাধারণত হাঁটার সময় ডানেবামে না তাকিয়ে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতাম। কিন্তু চয়ন ভাই একবার শামসুন্নাহার হলের সামনে এক যৌনকর্মীকে খদ্দেরের সঙ্গে দেখে ফেলেন। এরপর তিনি হলে এসে বমি শুরু করে দেন। আর বারবার বলতে থাকেন এ আমি কী দেখলাম, কেন দেখলাম। তিনি নিজেই ডাক্তারিতে পড়তেন তাই নিজের ওষুধ হয়তো নিজেই একসময় খুঁজে নিয়েছিলেন। আমার সঙ্গে পরে একদিন দেখা হলে বলেছিলেন, আমি আর হাঁটতে যাব না।
পৃথিবীর চিরায়ত নিয়মেই দিনের পরে রাত আসে। কিন্তু রাতের সৌন্দর্য হচ্ছে রাত নিতান্ত পরিচিত জায়গাকেই অনেক রহস্যময় করে তোলে। দিন-রাত হিসেবে মানুষের জীবনের অর্ধেক সময় হলো রাত। তাই আমার কাছে মনে হয় একজন মানুষ যদি রাতেরবেলা শুধু ঘুমিয়েই কাটায় তাহলে সে জীবনের অর্ধেক সৌন্দর্য দেখা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করল। সেই জন্যই আমরা বন্ধুরা মিলে রাতে এভাবে হাঁটতে বেরিয়ে পড়তাম। অবশ্য রাতের সৌন্দর্য দেখার পাশাপাশি এর অন্ধকার রূপটাও আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হতো। কারণ অন্ধকারই সব অপরাধের মূল উৎস। আজ এত দিন পরে এসে যখন সেই স্মৃতিগুলো হাতড়ে বেড়াই, তখন নিজেকে অনেক বেশি সৌভাগ্যবান মনে হয়। পাভেল এখন আমেরিকাতে। সুদীপ্ত আর আমি অস্ট্রেলিয়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাভেল দুবাইয়ে। রঞ্জু, জাকির, হিটু, চয়ন ভাই, শাহেদ, মান্না, সৌরভ, রুমমেট ফরহাদ আর পাশের রুমের তারিক দেশেই আছে। আমাদের নিজেদের এখন আলাদাভাবে সংসার ছেলেমেয়ে আছে। তাই স্বভাবতই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগটা কমে এসেছে। কিন্তু তবুও কখনো আলাপ করতে গেলে কোনো এক জাদুর কাঠির স্পর্শে ঢাকা শহরের রাতেরবেলা বদলে যাওয়া স্মৃতি নিয়ে আমরা বিভোর হই। কারণ একজীবনে সুখী হওয়ার জন্য এমন কিছু সুন্দর স্মৃতিই যথেষ্ট।
...

মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>