জীবন যেমন

লেখিকা
লেখিকা

আমরা তখন কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় থাকি। ১৯৯৩ বা ৯৪ সালের কথা। সংসারের বিভিন্ন খাত থেকে বাঁচানো টাকা দিয়ে আব্বা মনস্থির করলেন এবার একটা টিভি কিনবেন। কথাটা শুনে আমার মনের মধ্যে আনন্দের বন্যা বললে ভুল হবে, আমার মনের মধ্যে যেন একই সঙ্গে ঝড়, তুফান, সাইক্লোন, টর্নেডো সব বয়ে গেল। আমি কিছুতেই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, সত্যি আমাদের ঘরে টিভি আসবে। বিশ্বাস–অবিশ্বাসের দোলাচলে আগের রাতে ভালো করে ঘুমাতে পর্যন্ত পারিনি। আজও মনে আছে, আবেগ ও আনন্দে একটু পর পর আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সেই রাতে।

অতঃপর যথারীতি আব্বা বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, মঙ্গলবার দুপুরে কুষ্টিয়া গিয়েছিলেন টিভি কিনতে। নতুন টিভির পরিষ্কার-ঝকঝকে ছবির মতো এখনো আমার চোখের সামনে সেদিনের দিনলিপি জ্বলজ্বল করে। সারা বিকেল আব্বার অপেক্ষায় ঘর ছেড়ে বাসার সামনের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। সন্ধ্যা নেমে এল কিন্তু আব্বা এলেন না। মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকে গেল। তবে কী আব্বা টিভি কিনতে পারলেন না। কিনতে পারলেন না, এই ‘না’ শব্দটা আমি কোনো ভাবেই ভাবতে পারছিলাম না।
ভাবব কী করে! আমি কী তখন আমার মধ্যে আছি। আমি আছি স্বপ্নরাজ্যে। স্বপ্ন কী আর একটা–দুইটা দেখেছি, হাজারটা স্বপ্ন দেখেছি। নিজ ঘরে বসে টিভি দেখব। শুধু কী বসে—বসে, শুয়ে, দাঁড়িয়ে, হেঁটে হেঁটে কতভাবে টিভি দেখব। রিতু আপুদের বারান্দার জানালা দিয়ে টিভি দেখতে খুব কষ্ট হয়। সাইড থেকে দেখার কারণে টিভির মানুষগুলোকে কেমন যেন চিকন দেখায়। একটুও শান্তি পাই না দেখে। তা ছাড়া, জেসমিন ফুপুদের ঘরে টিভি দেখতে গেলে একটু কথাও বলা যায় না। মুখে কুলুপ এঁটে টিভি দেখো।
আমার এসব কষ্ট কী আর ঘরের লোক জানে। জানে না। অতএব এটা খুব সহজেই অনুমেয়, টিভি নিয়ে হাজারটা স্বপ্ন কেবল আমিই দেখেছি। যেহেতু, এসব স্বপ্ন আমি ছাড়া আর অন্য কেউ দেখেনি, তাই সবার চেয়ে আমার ভাবনাটাও ছিল বেশি। আহ! কী শান্তি। লুকিয়ে লুকিয়ে আর রিতু আপু, জেসমিন ফুপুদের ঘরে যেতে হবে না। ঘরে বসে টিভি দেখার এত সুখ আমি তখনো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
সে যা হোক, মূল কথা হলো হেলাফেলায় দিন রাত, সপ্তাহ, মাস, বছর চলে যায় অথচ কী অদ্ভুত ব্যাপার, সেদিনের দিনটা যেন সবকিছু ছাপিয়ে আমার জীবনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দিন হিসেবে জায়গা করে নিল। অবশেষে সূয্যি মামা ডুবল, দিনটি আমার ফুরাল। সন্ধ্যা ছয়টা, সাতটা, আটটা কুষ্টিয়া থেকে পায়ে হেঁটে রওনা দিলেও তো এতক্ষণ চলে আসার কথা। আব্বা কেন আসছে না এটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছিল না। দামদর নিয়ে আব্বা খুব ঘ্যান্তাগারি করেন জানি। তাই বলে টিভির দোকানে গিয়েও একই কাজ করছেন এটা ভেবে খুব রাগ হচ্ছিল।
অবশেষে আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ঠিক সাড়ে আটটায় ১৪ ইঞ্চি সাদাকালো ফিলিপস টিভি নিয়ে আব্বা বাসায় এলেন। মিথ্যে বলব না, এত ছোট টিভি দেখে প্রথমে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই ‘মাদার ইন ম্যানভিল’ না পড়েও আমার দশ বছর বয়সে নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম, সাইজ দাজ নট ম্যাটার। ঘরে বসে টিভি দেখব এটাই তো বড় কথা।
এ রকম হাজারটা স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার জীবনে। পাওয়া না পাওয়া নিয়ে। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি সাংসারিক পরিমণ্ডলে আব্বা–মায়ের খুঁটিনাটি হিসাব-নিকাশ। আমাদের বিনোদনের জন্য সেখানে এক টাকাও বরাদ্দ থাকত না। আমাদের ঘরে কোনো শখের খেলনা ছিল বলে আমার মনে পড়ে না। আমার কথা না হয় বাদই দিলাম, আমার ছোট দুই বোনের জন্যও ঘরে কোনো দিন খেলনা আসেনি।
জীবনটা এত এত না পাওয়ায় ভরা ছিল যে, একটা সময় মনে হতে থাকল, ‘আরে এটা ওটা পাওয়ার কী আছে। এই না পাওয়াটাই তো জীবন।’ তারপর থেকে এই না পাওয়া জীবনের সঙ্গে এমনভাবে বন্ধুত্ব হয়ে গেল যে, আজ অবধি সেই সব না পাওয়া দিনের স্বভাবগুলোকে বদলাতে পারিনি। তারই ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত কোনো কিছু কিনতে গেলেও প্রথমে ভাবি এটা কী আসলেই আমার দরকার আছে, নাকি নিতান্তই বিলাসিতা। সাত-সতেরো ভাবতে গিয়ে মোটের ওপর বিলাসিতাকে বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই আমার অনেক সময় করা হয়ে ওঠেনি বা করা হয়ে ওঠে না।
এর জন্য অবশ্য মনের মধ্যে কোনো আক্ষেপও নেই। আমি চাই, আমার মেয়েটাও ঠিক আমার ছেলেবেলার মতো মানুষ হয়ে উঠুক। চাইলেই যে সে সব সময় সবটা পাবে এমনটা আমি কখনো করি না। জীবনে ‘না’ কে গ্রহণ করতে শিখলে যেকোনো পরিবেশে যেকোনো পরিস্থিতিতে সে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। এতে করে আর একটা সুবিধা হবে, আর যা হোক সে অল্পে তুষ্ট থাকবে। আমার বিশ্বাস, এমন সহজ-সরল জীবনযাপন করতে পারলে পৃথিবী নামক গ্রহে আমরা মাথা উঁচু করে আজ যেমন বেঁচে আছি, বাকি জীবনটাও থাকব ইনশা আল্লাহ।

লাভলী ইয়াসমীন: গজফোর্ড, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া।