ঘুরে এলাম পাল পিট রক

পাল পিট রকের চূড়ায় পর্যটক
পাল পিট রকের চূড়ায় পর্যটক

আমি বর্তমানে স্বামীর কর্মসূত্রে স্তাভাঙ্গের অবস্থান করছি। স্তাভাঙ্গের নরওয়ের অন্যতম নগরী। এর অবস্থান পাল পিট রক থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে। স্বল্প সময়ের অবস্থানকালে চেষ্টা করছি যতটুকু পারা যায় আশপাশের দ্রষ্টব্য স্থানগুলো দেখে নিতে। তখন মে মাস ছিল। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, এখনই পাল পিট রকে হাইকিংয়ের উপযুক্ত। পুরো হাইকিং প্রায় ৮ কিলোমিটারের মতো পথ যাওয়া আসাসহ সময় লাগবে প্রায় চার ঘণ্টা।

পাল পিট রকের চূড়ায় স্বামীর সঙ্গে লেখিকা
পাল পিট রকের চূড়ায় স্বামীর সঙ্গে লেখিকা

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, হাইকিং করতে হলে কিছু প্রস্তুতি দরকার। যেমন হাইকিংয়ের উপযুক্ত জুতো বা কেডস পরতে হবে। সেই সঙ্গে আরামদায়ক কাপড় পরিধান করতে হবে। হাইকিং করার সময় অনেক গরম লাগবে। আবার ওপরে পৌঁছে বাতাসের জন্য অনেক ঠান্ডা লাগবে। তাই আমি বলব, যদি কেউ হাইকিং করেন, তিনি পাতলা জামা পরে সঙ্গে পানি ও বাতাসরোধক জ্যাকেট রাখতে পারেন। এ ছাড়া সঙ্গে হ্যাট, রোদ চশমা, পানি, খাবার ও টিস্যু, এগুলো রাখতে হবে।
এবার পাল পিট রক সম্পর্কে একটু বলি। পাল পিট রকের জন্ম প্রায় ১০ হাজার বছর আগে বরফ যুগের শেষের দিকে। এটি একটি ক্লিফ বা উঁচু খাঁড়া পর্বত। যার উপরিভাগ সমতল চারকোনা। এটাকে প্লাটু বলে ও আকারে প্রায় ২৫ বর্গ কিলোমিটার। এই জায়গাটি নরওয়ের রগাল্যান্ড কাউন্টিতে ফরসান্দ পৌরসভার অন্তর্গত। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ৬৫০ মিটার উঁচুতে এর অবস্থান। নিচে বইছে নীলচে সবুজ পানির ল্যসেফেওরদ। নরওয়ের অন্যতম ফেওরদ (সমুদ্রের একটা অংশ যখন মূল ভূখণ্ডের ভেতর ঢুকে যায়, তখন তাকে এখানে ফেওরদ বলে)। পাল পিট রকের ওপরে প্রথম হাইকিং করে ওঠেন অ্যাথলেট থমাস পিটার রান্ডালফ। ১৮৯৬ সালে। এর আগ পর্যন্ত পর্যটকেরা কেবল ল্যসেফেওরদ পরিভ্রমণ কালেই নিচে থেকে পাল পিট রকের সৌন্দর্য উপভোগ করতেন। এখন প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পর্যটক এখানে আসেন। সিএনএন গো ও লোনলি প্ল্যানেট একে পৃথিবী অন্যতম দৃষ্টিনন্দন দ্রষ্টব্য স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

পাল পিট রকের চূড়ায় উঠছেন পর্যটকেরা
পাল পিট রকের চূড়ায় উঠছেন পর্যটকেরা

এক সুন্দর ঝকঝকে সকালবেলা শুরু হলো আমাদের যাত্রা। আমাদের গন্তব্যস্থল পাল পিট রক বা যাকে স্থানীয়রা প্রিক্সতলেন বলে থাকে। আমাদের হাইকিং শুরু হবে পাল পিট রকের পাদদেশের প্রেইকেস্তলেন পার্কিং লজ থেকে। স্তাভাঙ্গের ফেরি ঘাট থেকে লজ পর্যন্ত যেতে লাগে এক ঘণ্টা। আমরা প্রথমে ফেরিতে তাও নামক শহরে পৌঁছালাম। এরপর বাসে করে একদম সেই পার্কিং লজে। এই জায়গাটিও অনেক সুন্দর। এখানে খাবারের রেস্তোরাঁ ও টয়লেটের সুবিধা রয়েছে।

পাল পিট রকের চূড়ায় ওঠার পথে বিশ্রামের ব্যবস্থা
পাল পিট রকের চূড়ায় ওঠার পথে বিশ্রামের ব্যবস্থা

আমরা হাইকিং শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পরপর লাল রঙের তীর চিহ্নের সংকেত পাথরের গায়ে আঁকা রয়েছে, যাতে পথ হারিয়ে না যায়। কিন্তু আমার মন গুনগুন করে গাইছে—‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে...’। আমরা বড়, ছোট বিভিন্ন পাহাড় ভেঙে ওপরে উঠতে শুরু করলাম। আমাদের সহযাত্রী অনেক। অনেকে গোটা পরিবার নিয়ে যাত্রা শুরু করেছেন। বুড়োবুড়ি, তরুণ-তরুণী ও শিশু—কেউ বাদ নেই। দেখে অবাক লাগল একদম ছোট বাচ্চাদের মায়েরা ব্যাকপ্যাকসহ পিঠে বহন করে হাইকিং করছেন। বেশির ভাগ নরওজিয়ান ছোটবেলা থেকেই হাইকিংয়ের সঙ্গে অভ্যস্ত।

লেখিকা
লেখিকা

তখন মে মাস চলছিল। তাই বরফ প্রায় সবই গলে গেছে। কিছু কিছু স্থানে সেই বরফগলা পানি জমে ছোট্ট সরোবরের মতো তৈরি হয়েছে। ফেরার সময় দেখেছি অনেককে সেই পানিতে গা ভাসিয়েছে ক্লান্তি দূর করতে। আমাদের চলার পথে অনেক নাম না জানা পাখি দেখলাম। কিছু ছোট ছোট ঝরনাধারাও দেখলাম। পথ চলতে চলতে মনে হয়েছে কখন এই পথ শেষ হবে। চূড়ার কাছাকাছি যতই আসছি, চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য যেন আর মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠছে। নিচে ফেওরদের নীলচে পানি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা অনুভব করছি। একসময় পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্থানে। মনে হলো পৃথিবীর শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি। এত উঁচু থেকে নিচে তাকানোটা আমার কাছে অনেক কঠিন মনে হলো। কিন্তু এই সৌন্দর্যকে অবহেলা করা যায় না।

লেখিকা
লেখিকা

ক্রল করে কিনারে গিয়ে নিচে তাকালাম। মনে হলো আমাকে যেন চুম্বকের মতো টানছে নিচের পানি। অনেক ছবি তোলা হলো। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক আমরা চূড়াতে অবস্থান করি। তারপর শুরু করি ফেরার যাত্রা। ফিরতে ফিরতে মনে হলো পাল পিট রকের সৌন্দর্য মনের মণিকোঠায় অনেক দিন জ্বলজ্বল করবে।

তামিমা আলম: স্তাভাঙ্গের, নরওয়ে।