ভেঙে মোর ঘরের চাবি...

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

সেদিন সকাল থেকেই নানবিধ ব্যস্ততায় বার চারেক বাসার ভেতর-বাহির করতে হয়েছিল আমায়। প্রতিবারই কন্যা আমার সঙ্গে ছিল, কেবল শেষবার ছাড়া। আর ঘটনাটি ঘটল তখনই; রাত পৌনে নয়টার দিকে। বাসায় ফিরে তড়িঘড়ি করে আবার বেরিয়ে যাই এক প্রতিবেশীর বাসায়। মেয়ে যেতে চাইল, না বলেই তাকে একা রেখে চলে গেলাম তাড়াতাড়ি ফিরব বলে। আমার ফিরতে দেরি দেখে কন্যা আমার অন্য আরেক প্রতিবেশীর বাসায় গিয়ে হাজির আমায় খুঁজতে।

বাসার মালকিন তো ওকে দেখেই চক্ষু চড়ক গাছ! মেয়ে তখনো একা একা কোনো বাসায় যাওয়ার সাহস ও অনুমতি পায়নি। এ দেশের আইনে ১২ বছরের নিচের শিশুদের একা চলাচল আইনত নিষিদ্ধ। (এই বয়সী কোনো শিশু একা চলাফেরা করলে প্রতিবেশীও পুলিশকে জানিয়ে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে পুলিশ শিশুর লিগ্যাল গার্ডিয়ানকে জবাবদিহি করতে পারে)। এ কারণে গৃহকর্ত্রী আমার কন্যাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন কোথাও কোনো একটা গন্ডগোল আছে; তাই তিনি প্রথমেই আমাকে জানানো কর্তব্য মনে করলেন এবং যথারীতি আমায় ফোন দিলেন। একবার, দুবার, তিনবার, না বারবার ফোন কল করেও তিনি আমায় পেলেন না। এরপর তাঁর দুশ্চিন্তারা যারপরনাই ডালপালা মেলে চরমে পৌঁছাল। এদিকে আমার মেয়েও কাঁদছে, সে তার মাকে হারিয়ে ফেলেছে! অবস্থা তখন চরমে। বেচারী কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।

ঠিক তেমনই অস্থির মুহূর্তে আমিও কী মনে করে সেই বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। আর টের পেলাম আমি কীসের মধ্যে পড়েছি! আমার সেই মহা দুরবস্থা নিরীক্ষণ করে হার্টের বিট দু-একবার ধপাস করে আবার নিশ্চুপ হয়ে রইল। শেষবার বাইরে বেরোনোর সময়ে ফোন, ঘরের চাবি কিচ্ছুই নিয়ে বের হইনি। মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, আম্মু তুমি কি লক করেছিলে? মেয়ে বলল, হ্যাঁ লক করেছি, তবে চাবি তো নেই! এবার সমস্যা চূড়ান্ত! আমরা সেই রাতে লকড আউট!
এদিকে ততক্ষণে ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী আমার গদ্যময়। পেটের মধ্যে বিড়াল-কুকুরের ছানারা সব দৌড়াদৌড়ি করছে। তখন চাবি খোঁজার কোনো ইচ্ছেশক্তিই নেই আমার দেহে-মনে। আগে আমার পেট শান্ত করা দরকার। তাই চক্ষুলজ্জার বালাই ফেলেই বললাম, ভয়ানক ক্ষুধা পেয়েছে, এসব যন্ত্রণা ভালো লাগে এখন? আমি এখন কি খাব, আর খাবই বা কোথায়? এ যেন নিজেরই সঙ্গে বলা, আবার কাউকে শুনিয়েও বলা। আমার এমন নির্লজ্জ স্বগতোক্তি শুনে সাধ্য কার যে মুখ ফিরিয়ে নেবে? অতঃপর গৃহকর্ত্রী আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। খাওয়া শেষ করেই আমি চলে গেলাম আমার পতিদেবের কর্মস্থলে; বাসা থেকে ছয়-সাত মিনিটের হাঁটা পথ। তার কাছ থেকে চাবি নিয়ে ঘরে ফিরলাম। রাত তখন ১১টা। সারা দিনের ক্লান্তির পরে, আহ কী শান্তি! যেন যুদ্ধজয় করেই ঘরে ঢুকতে পারা…। বেঁচে থাক বাবা পতিদেব।
বাবার হোটেলে যখন ছিলাম তখন এই গুণপনার জন্য বকুনির অন্ত ছিল না। কত দিন মন খারাপ করে না খেয়ে কাটিয়েছি, প্রতিজ্ঞা করেছি এমন ভুল আর করব না, নাহ, তবু বদলায়নি আমার স্বভাব। আমারই কারণে আলমিরার তালা, দরজার হ্যাজবল ভাঙা আর নতুন তালা কেনা এ ছিল প্রায় প্রতি মাসের নিয়মিত বাজেট। প্রতিবারই রাগারাগি করতেন বাবা আর বলতেন, ‘খাসিলত যায় না মইলে, আর ইল্লত (ইজ্জত) যায় না ধুইলে।’
পরবর্তীকালে স্বামীর হোটেলে এসেও একই অবস্থা; আমার গুণের কোনো উন্নতি হলো না। যাকে বাবা ক্ষমা করেননি তাকে কী করে স্বামী ক্ষমা করবেন? কপালে তাই ঝাঁটাপেটাই বরাদ্দ! করবে না-ই বা কেন? পুরুষেরা কি এমন লক্ষ্মীছাড়া বউ চায়? তাঁরা তো একটু আরাম-আয়েশের জন্যই বিয়ে করে, নাকি? যার বউ নিত্য এমন কাণ্ড ঘটায় তার মাথা কীভাবে ঠিক থাকে?
টরন্টো এসে এ যাবৎ কত দিন লকড আউট হয়েছি তার হিসাব নেই। চাবি হারাই, আর ফোন করে বলি, আজ চাবি বানিয়ে না আনলে কাল থেকে ঘরে ঢোকা বন্ধ, আর তিনিও বাড়তি দুই-এক সেট বেশি বানিয়ে আনেন। এভাবেই চলে আমার চাবি হারানো-বানানোর জীবন!

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

চাবি হারিয়ে আরও একটি উপায়ে আমি ঘরে ঢুকি, আমার অ্যাপার্টমেন্টের অফিসের সাহায্যে। হ্যাঁ, অফিস আওয়ারে প্রোপার্টি অফিসে গিয়ে আমার অ্যাপার্টমেন্ট নম্বর বললেই ‘মাস্টার কি’ দিয়ে ওরা আমার ঘর খুলে দিয়েছে। এমন অনেক দিন হয়েছে, ঠিক গেটের কাছে এসেই ব্যাগে হাত দিয়ে দেখি ব্যাগে চাবি নেই। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, প্রতিবারই কোনোরূপ বিরক্তি প্রকাশ ছাড়াই কিংবা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই এই অফিসের লোকজন মাস্টার কি দিয়ে দিয়েছে আমায়।
আমাদের দেশের মতো প্রাইভেট রিয়েল এস্টেট কোম্পানির অ্যাপার্টমেন্ট আছে এখানে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, অল্প কিছু আছে ব্যক্তিমালিকানাধীন। অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসায় এখানেও সার্বক্ষণিক একটি ম্যানেজমেন্ট অফিস আছে। যারা দিবারাত্র ভাড়াটেদের গঞ্জনা সহ্য করার জন্যই প্রস্তুত থাকে। কারণ, এখানকার ভাড়াটেরা আমাদের মতো কুঁকড়ে থাকেন না, এরা বেশ পাওয়ারফুল! আর তাঁদের এই পাওয়ার দিয়ে ক্ষমতায়িত করেছেন প্রাদেশিক সরকার!
এখানে ‘টেনান্ট অ্যাক্ট’ নামে প্রাদেশিক যে বাড়িভাড়া আইন রয়েছে তার আওতায় ভাড়াটেদের অধিকার সংরক্ষিত হয়েছে। পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, লিফট চলাচল, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ (গ্রীষ্ম ও শীতকালে এসি ও হিটিং), চিঠিপত্র বিলি এবং সর্বোপরি বহিরাগতদের প্রবেশাধিকার সংরক্ষণ করাই হলো তাদের দৈনন্দিন রুটিন কাজ। বাসা ভাড়া দেওয়ার সময়ে একটি চুক্তি হয় যথারীতি, সঙ্গে প্রয়োজনীয় একগোছা চাবি ধরিয়ে দেবে আপনাকে, যার একটি কপি তাদের কাছেই থাকে। আপনি ভাড়া থাকাকালে কোনো দিনই তারা আপনার অনুপস্থিতে কিংবা বিনা অনুমতিতে সেই চাবির সদ্ব্যবহার করবে না। তবে, সেই মাস্টার কি বিপদে-আপদে আপনারই যে কল্যাণে নিয়োজিত থাকবে, তা নিশ্চয়ই আমার ওপরের গল্প পড়ে বুঝতে পেরেছেন।
টেনান্ট অ্যাক্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো আপনার নিরাপত্তাবিধান ও আপনার প্রাইভেসি সংরক্ষণ করা। এই নিরাপত্তার ভেতরে আপনার শারীরিক-মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন; পোকা দমন (তেলাপোকা, পিঁপড়া, ছারপোকা), হিটিং-কুলিং ম্যানেজমেন্ট, নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নকরণ, ময়লা পরিষ্কার, অনাকাঙ্ক্ষিত লোকজনের অনুপ্রবেশ; এসব বিষয়ে কোনো সমস্যা দেখা দিলে ম্যানেজমেন্টকে জানানোর পরে সমাধান না হলে আপনার অধিকার আছে মামলা করার। চুক্তি অনুযায়ী প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট হারে বাড়িভাড়া বাড়বে, যা কিনা এলাকাভেদে ভিন্ন হতে পারে, তবে একই মানের বাড়ির জন্য একই এলাকায় সাধারণত একইরকম ভাড়া হবে। অর্থাৎ, একই ধরনের সুবিধাদির জন্য দুই-এক শ ডলারের বেশি এদিক সেদিক হবে না। বাড়িভাড়াও বাড়বে একটি নির্দিষ্ট হারে, এর অন্যথা হলে আপনি মামলা করতে পারেন। আপনি ভাড়া দিতে অপারগ হলেও বাড়িওয়ালা আপনাকে উচ্ছেদ করতে পারবেন না কিংবা কোনোরূপ হুমকিও দিতে পারবেন না। দিলে আপনি মামলা করতে পারবেন। আর সেই মামলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আপনিই জিতে যাবেন। সে ক্ষেত্রে ভাড়া না দিয়েও আপনি সেই বাড়িতে থাকতে পারবেন কিংবা সরকার আপনার বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে সরকারি হাউজিংয়ে বসবাসের ব্যবস্থা করতে পারে। কারণ, এ দেশের সকল আইন আবর্তিত হয় মানবাধিকারকে কেন্দ্রে রেখেই।
আমাদের দেশেও বাড়িভাড়া আইন আছে শুনেছি, তবে স্বচক্ষে কোনো দিন তার প্রয়োগ দেখিনি। একটা বাড়িভাড়া চুক্তিও হয় ভাড়াটেদের সঙ্গে, তবে তা সর্বপ্রকারেই বাড়িওয়ালার স্বার্থ সংরক্ষণ করে থাকে। ব্যক্তিমালিকানাধীন বাসায় মালিকেরা ভাড়াটেদের সঙ্গে রাস্তার ফকিরের মতোই আচরণ করেন। মালিকদের দৌরাত্ম্য, দুর্ব্যবহার, সভ্যতা-ভব্যতার সীমা লঙ্ঘন করলেও বেচারী ভাড়াটেকে মুখ বুঁজে সব সহ্য করতে হয় কিংবা অন্য বাড়িতে ভাড়া খুঁজতে হয় সে যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচতে। সেসব ক্ষেত্রে আইনের কোনো সহায়তা পেয়েছেন কেউ এমন গল্পও শুনিনি।

লেখিকা
লেখিকা

একবার মে মাসে নতুন বাসায় উঠেছিলাম। চুক্তি অনুযায়ী এক বছর পরেই ভাড়া বাড়বে পাঁচ শ টাকা। কিন্তু ডিসেম্বর মাসেই বাড়িওয়ালার কাছ থেকে ছাপানো একখানা প্রেমপত্র পেলাম, জানুয়ারি থেকেই পাঁচ শ টাকা বাড়িয়ে দিতে হবে মর্মে। জিজ্ঞেস করলাম কেন? জবাব পেলাম, এই বিল্ডিংয়ের সবারই ভাড়া বেড়েছে, আপনি তো আলাদা নন, আপনার কেন বাড়বে না? আবারও প্রশ্ন করলাম তাহলে এই যে চুক্তি করলাম, তার মানে কি? আবারও জবাব পেলাম, ওটাতো এক বছর পরের কথা, তখন তো বাড়বেই। আপনার যেমন বেতন বাড়ে জানুয়ারিতে, এটাও তাই, বেতনের সঙ্গে সবকিছুরই দাম তো বাড়ে জানেন। সুতরাং, চুক্তি থাকলেও বাড়িওয়ালারা যা মনে করেন তাইই বাস্তবায়িত হয়, সেসব দেখার কেউই নেই।
আসলে আইন লঙ্ঘন তথা আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে চলা যখন আমাদের জাতিগত স্বভাব, তখন সমাজের সকল খাতে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, অন্যায়, অত্যাচারই আমাদের জীবনের প্রতিদিনের সঙ্গী! আর এসবই আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। এর আগে আমরা দেখেছি বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে, সরকার তদন্ত কমিটির নামে আই ওয়াশ করেছে। সরকার মহাশয় গভর্নরকে সরিয়ে দিয়ে আপাত সমস্যার সমাধান করলেন। আমরা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থেকেছি, সেই সমস্যার সত্যিকারের সমাধান হয়তো হবে এমন ভাবতে ভাবতেই তার চেয়েও বড় অঘটন এসে আমাদের পুরোনো শোককে ম্লান করে দিয়েছে। এখন দেখছি, গভর্নর চলে গেলেও তার ভূত এসে সত্যিই ব্যাংকের ভল্টে গচ্ছিত সোনাকে তামায় রূপান্তরিত করে আবারও জনগণের ঘাড় মটকে দিল! এই ভূতেরা চিরদিনই ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থাকবে, কোনো সুবিচার আমরা পাব না।
এভাবে অন্যায়-অরাজকতার এক দুষ্ট চক্রে পড়ে অন্ধতমসায় তলিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশ-সমাজ। লাগামহীন ঘোড়ার মতো ছুটে চলেছে আমাদের প্রিয় শহর ঢাকা, একটি অতিরিক্ত ভারবাহী যন্ত্রদানব ট্রাকের মতো ছুটছে দেশও! আর আমরা সেই ট্রাকে সওয়ার করে আছি সব্বাই! কখন জানি পড়বে ভেঙে পুরোটা! বাইরেটা ঝা চকচকে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন বইছে তরতর করে, এতে কোনো সন্দেহ নেই, কেবল ভেতরগত অবক্ষয় ঝাঁজরা করে দিয়েছে সব। সততা, আইনের শাসন, ন্যায়পরায়ণতা, আদর্শ এসব এখন উইপোকার দখলে। দেশ এখন একটা উইপোকার ডিবি। এর থেকে পরিত্রাণের সহজ কোনো উপায় আছে কি আমাদের? থাকলে সেই স্বপ্নলোকের চাবি কার কাছে আছে আমার জানা নেই। জানলে বলতুম...ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে...ও বন্ধু আমার!
...

সঙ্গীতা ইয়াসমিন: টরন্টো, কানাডা।

ধারাবাহিক এ রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: