এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের নিয়ে আমার স্বপ্ন

প্রতীকী ছবি। প্রথম আলোর ফাইল ছবি
প্রতীকী ছবি। প্রথম আলোর ফাইল ছবি

বাংলাদেশে এখন এইচএসসি পরীক্ষা একজন শিক্ষার্থীর জন্য চতুর্থ পাবলিক পরীক্ষা। শিক্ষার্থী হিসেবে পাবলিক পরীক্ষার স্নায়ুর চাপ আমরা প্রথম নিয়েছি ১৫-১৬ বছর বয়সে। এখন তারা সেই চাপ জীবনে প্রথম নিয়েছেন পিএসসিতে—৯-১০ বছর বয়সে। সেদিক বিবেচনায় মানসিক চাপ সামলানোতে তারা আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। আজ বাংলাদেশে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এই ফলাফল উচ্চশিক্ষার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা যে জীবনের সব সফলতা নির্ধারণ করে দেবে তা মোটেই নয়। যারা এ প্লাস পাবেন না বা অকৃতকার্য হবেন, তাদেরও জীবনের সব সম্ভাবনা একটুও শেষ হয়ে যাবে না। আবার লাখ বা তার কাছাকাছি এ প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেখে তা অনেকে হেলায় ফেলে দেন। আমার মতো অনেকেই হয়তো এই এ প্লাস, এ গ্রেড, বি গ্রেড বা তার নিচের গ্রেড বা অকৃতকার্য সবাইকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন।

আপনি হয়তো ভাবছেন, আমি এত স্বপ্ন দেখলে কার কী আসে যায়। আমি অনেক স্বপ্নবাজ মানুষ। দিনে-রাতে কারণে অকারণে স্বপ্ন দেখি। নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলি কারণে অকারণে। বহু প্রতিকূলতার মাঝেও ঠিকই ঝামেলা উতরে যাব এই আশায় চেষ্টা করে যাই। কাল বাঁচব কিনা নিশ্চয়তা না থাকলেও পুরো মাসের ছক স্বপ্নে কষে বসে থাকি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, দেশে অশিক্ষিত বেকারের চেয়ে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অনেক বেশি। শুধুই কী তাই, জাতীয় বেকারত্বের হারের চেয়ে শিক্ষিত বেকারের হার তিন গুণ বেশি। কৃতকার্য ছেলেমেয়েরা জাতীয় পর্যায়ে কতটুকু অবদান রাখবেন তার অনেক কিছু দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে। এই কোমলমতি সম্ভাবনাময় ছেলেমেয়েগুলোর মেধাকে কীভাবে পরিচর্যা করা প্রয়োজন, সেই নিয়ে নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট গুণীজনেরা কাজ করে যাচ্ছেন।
আমি অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখি। কতটুকু পূরণ হবে জানি না। তবে দেখতে তো ক্ষতি নেই। প্রথম ও দ্বিতীয়বার অকৃতকার্য হয়েও জীবনে সফল হয়েছেন এমন উদাহরণের অভাব নেই। আবার জীবনের সব পরীক্ষায় সফল হয়ে দেশ-জাতি তথা মানবতার জন্য কত মানুষ কাজ করে যাচ্ছেন এমন সংখ্যাও অনেক। তাই আমার স্বপ্ন সবাইকে নিয়ে।
এ বছর প্রায় ১২ লাখের (১১ লাখ ৬৩ হাজার ৩৭০ জন) শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। এঁদের কেউ বিজ্ঞানী, কেউ রসায়নবিদ, কেউ পদার্থবিদ, কেউ গণিতবিদ, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবেন। কেউ আবার ডাক্তার হয়ে বিনা মূল্যে দরিদ্রদের চিকিৎসা দেবেন। কেউ কেউ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সৎ শিক্ষক হবেন। কেউ আইনস্টাইনের মতো সারা বিশ্বে নাম কুড়াবেন। আইজ্যাক নিউটন, আমাদিও আভোগাদ্রো, আর্কিমিডিস, আলবার্ট আইনস্টাইন, আঁদ্রে মারি এম্পিয়ার, আর্নেস্ট কার্ল অ্যাবে, আলহাজেন-বসরা, আব্রাহাম আলিখানভ, এনরিকো ফের্মি, এর্ভিন শ্র্যোডিঙার, অ্যারিস্টটল—এঁদের মতো কেউ না কেউ তো হবেনই।
এঁদের কেউ আবার জাকারবার্গের ফেসবুকের চেয়েও ভালো কিছু বের করবেন না তার নিশ্চয়তা কে দেবে! এঁদের কেউ একদিন বিল-গেটসের মতো হবেন। নিউটনের পরিচিতি যেমন নিউটনীয় বলবিজ্ঞান, সর্বজনীন মহাকর্ষ, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ক্যালকুলাস, আলোকবিজ্ঞান, দ্বিপদী উপপাদ্য, ফিলোসফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা সর্ব বিষয়ে, ঠিক তেমনি এঁদেরই কেউ একজন হয়ে উঠবেন এমন। বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সঙ্গে বেশ নিগূঢ়ভাবে সম্পৃক্ত থাকবে অনেকের নাম। স্টিফেন হকিংয়ের ব্ল্যাক হোল তত্ত্বের মতো নতুন তত্ত্ব দিয়ে সারা বিশ্বে হইচই ফেলে দেবেন। আবার কেউ কেউ সময়ের সঙ্গে টমাস আলভা এডিসনের মতো হয়ে উঠবেন।
এঁদেরই কেউ নতুনভাবে সত্যেন্দ্রনাথ বসু হয়ে উঠবে। এরাই দেশি-বিদেশি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জগদীশ চন্দ্র বসু, শাহ ফারুক, আনিসুর রহমান, ড. জামাল, মেঘনাদ সাহা, আজম আলী, আবেদ চৌধুরী, আবদুস সাত্তার খানের মতো সারা বিশ্বে জ্ঞানের আলো ছড়াবেন। এঁরা দেশকে ভালোবাসবেন মায়ের মতো, প্রয়োজনে দেশের জন্য প্রাণ দেবেন, সর্বক্ষেত্রে দেশের স্বার্থ রক্ষা করে চলবেন। এঁদের কেউ হবেন পরবর্তী নতুন প্রজন্মের প্রেরণার আশার আলো। হতাশাগ্রস্তকে আশার আলো দেখাবেন, নতুনদের ভালো কিছু করার স্বপ্ন দেখাবেন।
আবার এঁদের অনেকেই দারিদ্র্যতার কশাঘাতে জর্জরিত হওয়া সত্ত্বেও অসৎ উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করবেন না। এদের অনেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে এসে নিত্য নতুন জিনিস শিখে অনেকে দেশকে ভালোবেসে দেশেই ফিরে যাবেন। কেউ আনু মুহাম্মদের মতো অর্থনীতিবিদ হবেন, ড. ইউনূসের মতো হরহামেশাই নোবেল জয় করবেন। প্রফেসর সৈয়দ শফিউল্লার মতো বিজ্ঞানী হবেন, প্রফেসর আবদুল্লাহ আল মামুনের মতো দেশে বসে গবেষণা করেও হাজার দশেকেরও বেশি সাইটেশন থাকবে। অনেকেই সৎ নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে পদে পদে নিপীড়িত হবেন তবু বিপথে যাবেন না।
এঁদের অনেকেই পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হবেন, নিত্য নতুন ধারণা দিয়ে পৃথিবী পাল্টানোর ধারণার দিয়ে অনেকের উত্থানের কথা জানান দেবেন। এমন এক সময় আসবে যখন পৃথিবীর নামীদামি জায়গায় এঁদেরই কারও ১০-১৫ মিনিটের একটি অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য শোনার জন্য সারা বিশ্বের নামকরা বৈজ্ঞানিক, গবেষক বা মানবতাকর্মীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবেন। এঁরাই আমাদের অস্থিমজ্জায় ঢুকে যাওয়া জাতীয় সকল সমস্যা, দারিদ্র্যতা, দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে দেশকে রক্ষা করবেন। এঁদেরই কেউই হয়তো শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান হয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজিয়ে বিশ্বমানের করবেন। তখন ভিনদেশিরা আসবেন আমাদের দেশে আসবেন উচ্চশিক্ষার জন্য। এঁরাই একদিন রাজনীতি থেকে দুর্নীতি, অসততা, অস্বচ্ছতা সমূলে বিনষ্ট করবেন।

লেখক
লেখক

এই ১২ লাখেরই অনেকেই আকাশের চাঁদ বা সূর্যের মতো হয়ে আলো ছড়িয়ে সমাজ, জাতি তথা বিশ্বকে আলোকোজ্জ্বল করবেন। এঁদের কারও কারও উপস্থিতি হয়তো হয়ে উঠবে শত শত তরুণের অনুপ্রেরণার উৎস। এঁরা কখনোই মেধা, মনন, মগজ, নিজস্ব চিন্তা আরেক জনের কাছে বন্ধক রেখে কারও অন্ধ অনুসারী হবেন না। এরা কেউই শিক্ষাজীবনে কলমের পরিবর্তে অস্ত্র বা রড হাতে তুলে নেবেন না। এঁরা কেউই টাকার বিনিময়ে সমাজ বা দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবেন না। এঁরা কেউ জীবনে এক পয়সাও ঘুষ খাবেন না। এঁদের অনেকেই সৎ পুলিশ অফিসার হয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে সাধারণ মানুষের জানমাল রক্ষা করবেন। এই মেধাগুলোর সঠিক পরিচর্যায় এসব কিছুই সম্ভব। আর ততদিনে এই বাংলাদেশের সঙ্গে সেই বাংলাদেশের তুলনা করে আমরাই অবাক হব, ততদিনে বাংলাদের হয়ে যাবে সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ।

*রেজাউল হক নাইম: পিএইচডি শিক্ষার্থী, পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়েষ্ট লাফায়াতে, ইন্ডিয়ানা, যুক্তরাষ্ট্র। ইমেইল: <[email protected]>