যে যন্ত্রণা আমার চিরসঙ্গী

লেখিকা
লেখিকা

হিথ্রো বিমানবন্দরে এক ছেলেকে দেখি বাচ্চার মতন ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

—কি ব্যাপার?
—আমার মা অসুস্থ, তাঁকে দেখতে পাই কিনা সন্দেহ।
ছেলেটিকে সান্ত্বনা দিই।
—ইনশা আল্লাহ তুমি দেখতে পাবে।
তাঁর সঙ্গে হ্যান্ড লাগেজ। ঋণ করে টিকিটের টাকাটা জোগাড় করেছে। মাকে শেষ দেখা দেখতে যাবে কয়েক হাজার মাইল পেরিয়ে! তার চোখে দুনিয়াদারি ও ঝকমারির চেয়ে মা চাই আগে।
জীবনে কিছু অপরাধবোধ সবারই কম-বেশি থাকে। আমারও আছে। সেই বোধ মাঝে মাঝে ভিমরুলের মতন হুল ফোটায়। ব্যথার স্থানে হাত বুলাই। অনেক বছর আগের কথা। দেশে মা ক্যানসারের রোগী। খবর পেয়ে ছুটে যাই কোলের ছেলেকে নিয়ে। দুই সপ্তাহ ঢাকায় থাকি। হাসপাতালেই বেশির ভাগ সময়। কিন্তু পুরো সময় থাকতে পারি না ছেলের জন্য। তাকে দেখার কেউ নাই। সেও তার দাদির কাছে থাকতে চাইত না বেশি সময়। ঘুরে ফিরে মাকে খুঁজত।
হাসপাতালে আমার মাকে আমি ভাত মেখে খাওয়াই। তিনি ভীষণ খুশি। হেসে বলেন, তোর হাতের মাখা ভাত খেতে ভালো লাগে। মায়ের সঙ্গে বসে থাকি। পুরোনো গল্প করি। তাঁকে তীব্র ব্যথার ওষুধ দিয়ে বেশির ভাগ সময় ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। তাঁর ঘুমের সময় শ্বশুর বাড়িতে এসে ছেলের দেখাশোনা করি। মনে শান্তি নেই, আরও বেশি সময় যদি থাকতে পারতাম মায়ের সঙ্গে!
এদিকে দুই সপ্তাহের ছুটি শেষ। চলে আসতে হবে। বড় বোন হজে যাবেন। কথা দিই তিনি যখন থাকবেন না, তাঁর অবর্তমানে আমি আম্মার দেখাশোনা করব। অর্থাৎ মাস দু-এক পরে আবার ঢাকায় ফিরে যাব।
মা বারবার বলছেন, তুই যাইস না। আমার সাথে থাক।
কানাডাপ্রবাসী ভাই। তাঁকেও কাজে ফিরে যেতে হবে! আমরা হেল্পলেস হয়ে ফিরে এলাম একজন লন্ডন, আরেকজন টরন্টো। আসার পরই নিজের ক্যানসারের অস্তিত্ব টের পেলাম। সঙ্গে আর্থিক বেসামাল অবস্থা। দেশে যেতে পারলাম না। কাউকে জানাতেও পারছি না, কী বাজে অবস্থায় আছি! সে আরেক গল্প।
বাসার ড্রাইভার ও বুয়া আম্মাকে দেখাশোনা করে। হাসপাতালের নার্স ও ডাক্তারতো আছেই! একদিন মার ইন্তেকালের খবর পাই। মা চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর শেষ সময়ে তাঁর পাশে কথা দিয়েও থাকতে পারিনি। এই যন্ত্রণা আমার চিরসঙ্গী হলো।
সময়টা বৈরী ছিল বা ইচ্ছা শক্তি নিয়ে যেতে পারতাম ছেলেকে যদি লন্ডনে তার বাবা দেখতেন। তিনি নিরুৎসাহিত করলেন। এত ছোট ও, ওকে আমি রাখতে পারব না! এখন এক-দুই মাসের পরিকল্পনায় পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় ছুটে যেতে পারি। কিন্তু মা তো আর অপেক্ষা করে নেই!
কয়েক দিন আগে আমার অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বান্ধবী নাহিদের শ্বশুর মারা গেলেন। তাঁর কথা শুনে আমি তাঁর অনুমতি নিয়ে এই লেখা লিখতে বসেছি। প্রায় আট মাস আগে তাঁর শ্বশুর ভর্তি হলেন ঢাকার এক নামি হাসপাতালে। প্রথমে কিডনি সমস্যা। পরে তা ক্যানসারে রূপান্তরিত হওয়া। সঙ্গে হার্টের অসুখ ও পারকিনসন রোগসহ বিভিন্ন জটিলতা।
বাবার অসুস্থতার খবর শুনে তাঁর স্বামী চাকরি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। আট মাস বাবার সঙ্গে থাকেন। আমার বান্ধবীও চলে আসেন। জমানো টাকা দিয়ে ব্যয়বহুল চিকিৎসা চলে দেশে-বিদেশে। একসময় জমানো টাকা শেষ হয়ে যায়। বাবা মারা যাবেন জেনেও নিজের এক বাড়ি বিক্রি করে বাকি চিকিৎসার টাকা জোগাড় করেন। শেষমেষ তাঁর বাবা মারা গেছেন। অভিনন্দন আমার বান্ধবী ও তাঁর স্বামীকে। জীবনে তাঁদের একটা স্বস্তি থাকবে। সবকিছু উজাড় করে বাবার পাশে থাকতে পেরেছেন। বিদায়ী বাবাকে ধরে রাখার জন্য সর্ব চেষ্টা করেছেন।
ঢাকায় বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের বাবা-মায়েরা মারা যান, সব সন্তানেরা তাকে ঘিরে থাকে শেষ সময়টুকু পর্যন্ত। এই খবর শুনে স্বস্তি বোধ করি। মা যখন হাসপাতালে, তখন নার্সদের কাছ থেকে জানতে পারি, হাসপাতালে এক ভদ্রলোক তিন মাস ধরে কোমায় আছেন। আমেরিকাপ্রবাসী ছেলে মাঝে মাঝে ফোন করে, কিন্তু চিকিৎসার খরচ কেউ দেয় না। গুলশানে তাঁর ফ্ল্যাট। কেউ নেই চিকিৎসার খরচটা চালাবে বাড়ি বিক্রি করে।
হাসপাতালে সেই অচেতন রোগীর কথা ভাবতাম—সব আছে তোমার, আবার কিছুই নেই। পরিচিত আরেকজনের খবর জানি, যিনি পিএইচডি করতে লন্ডনে এসেছিলেন। ফাইনাল পেপার জমা দেওয়ার আগে শোনেন মা হাসপাতালে। সব ছেড়ে চলে যান দেশে। আর ফেরেননি। স্কলারশিপ বাতিল হয়ে যায়। পরে বেশ কয়েক বছর পরে অন্য দেশ থেকে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
এই যে সঠিক সময়, এই সময়টাই প্রবাসীরা কেউ বাবা-মায়ের শেষ সময়ে থাকতে পারেন, কেউ পারেন না। আমরা যারা পারিনি আমাদের কাছে ওই সময়টা ফ্রিজ হয়ে আছে। যারা পারেন শত ঝামেলায়, তাদের স্যালুট।