কবে যে আমরা বাঙালি থেকে মানুষ হব!
আমরা যারা বিদেশে থাকি, তারা দেশের খবরাখবর পাই মূলত সংবাদপত্রের অনলাইন আর ফেসবুকের মাধ্যমে। গত কিছুদিন ধরে একের পর এক কিছু খবরে আমার মনে হচ্ছে এই দেশেই আমি ছিলাম তো? এই দেশেই আমি বড় হয়েছি তো? এটাই আমার শেকড় তো?
পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষক লাঞ্ছনা, কোটা নিয়ে আন্দোলন, সড়কে হত্যা—এই যে এত কিছু ঘটছে, তাতে কারও কী কিছু এসে যাচ্ছে?
নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন দেখেছিলাম। খুব পরিষ্কার মনে করতে না পারলেও এটা মনে আছে, বাবা যেতেন আন্দোলনে যোগ দিতে ময়মনসিংহ শহরে। বাসায় এলে দেখতাম কী ভীষণ উত্তেজিত। সংবাদপত্রে পড়তাম কী ঘটছে। ডা. মিলনের মৃত্যুর খবরও পড়েছিলাম মনে করতে পারি। তখন আমরা আওয়াজ তুলেছিলাম সমস্বরে।
এখন আমার মনে হয় এর চেয়ে ভালো কি আমরা আছি? বোর্ড কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যে ফাঁস হতে পারে, আমাদের সময়ে আমরা তা কখনো ভাবতেও পারতাম না। আর এখন সেই প্রশ্নপত্র ফেসবুকে পাওয়া যায়। এই দায় নাকি শিক্ষামন্ত্রীর নয়! তিনি পদত্যাগ করবেন কেন? ওনার তো পদ দরকার। পদ যদি ত্যাগই করবেন তাহলে তিনি কী নিয়ে থাকবেন! বিবেক নামক ব্যাপারটা আসলে তারও নেই, আমাদেরও নেই। না হলে আমরা কেন তাঁকে পদচ্যুত করতে পারি না? সেই শক্তি আমাদের কোথায়!
অর্থমন্ত্রী শিক্ষকদের বলেন শাট আপ। কোনো এক সাংসদ শিক্ষককে কানে ধরাতে বাধ্য করেন সবার সামনে। আমরা তারপরও তাঁদের আমরা কিছু বলি না। জাতির বিবেক তখন কিন্তু চুপ। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষক তো না। শিক্ষকদের মেরুদণ্ড থাকতে নেই। শিক্ষকেরা তো আর সমাজের বাইরের কেউ না। যে সমাজে বাকি সবাই চুপ করে থাকে, সেই সমাজে শিক্ষকদের এত ব্যাটাগিরি দেখানোর কী আছে!
এরপর এল বিসিএসে কোটা নিয়ে আন্দোলন। আরে যে দেশে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী নিজে বলেন, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা ঠিক না, সেখানে কি নিয়ে কোটা? এমনকি তিনি এও বলেছেন এমন ব্যক্তিও মুক্তিযোদ্ধা, যিনি কিনা মুক্তিযুদ্ধের সময় চার বছর বয়সী ছিলেন। পাকিস্তানের কিছুসংখ্যক সহযোগী আর হাতেগোনা চিহ্নিত রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাদ দিলে পুরো দেশই কি মুক্তিযুদ্ধ করেনি? আমার বাবা যিনি কিনা মুক্তিযুদ্ধের সময় পিএইচডির জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। তিনি কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়োজনে সাহায্য করেছিলেন নিজের স্টাইপেন্ডের টাকা দিয়ে। চাঁদা তুলে দেশে পাঠিয়েছিলেন। দেশে ফিরেছিলেন ধার করে। তাঁরা কি মুক্তিযোদ্ধা নন?
উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী কোটা অনুসরণ করতে হবে নিয়োগের সময়। আমি উচ্চ আদালতের রায়কে সম্মান জানাই দেশের একজন অনুগত নাগরিক হিসেবে। কিন্তু একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার প্রশ্ন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কারা? মুক্তিযোদ্ধার সাংবিধানিক সংজ্ঞা কি? এর সঠিক তালিকা কি? যে ব্যাপারটাই এখন ধোঁয়াটে আর অস্পষ্ট সেটা নিয়ে কে সমাধান দেবে। এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাণিজ্য (কিছু মানুষের) আর কত দিন?
বরাবরের মতো আমরা এবারও চুপ। আমাদের কাজ হচ্ছে বহু টিভি সিরিয়ালের মতো এসবও দেখে যাওয়া। আমাদের চুপ থাকা যেন যে কাউকে যা কিছু করার অনুমতি দিয়ে দিচ্ছে। বাসে নারীরা ধর্ষিত হবে, বেশির ভাগ ধরা পড়বে না। বাসের রেষারেষিতে সাধারণ মানুষের হাত-পা কাটা পড়বে, চালকের কিছু হবে না। বাসচালক-সহকারী মিলে জীবন্ত মানুষকে মেরে-থেঁতলে সেতুর ওপর থেকে ছুড়ে ফেলে দেবে, কেউ দেখেনি তো। বাসের রেষারেষিতে চাপা পড়ে বাচ্চারা মারা যাবে কী এসে যাবে কার?
বাস শ্রমিক নেতাদের নেতা মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় তখন নির্মল হাসিমুখে পরিসংখ্যান দিতে ব্যস্ত, যেন খুব স্বাভাবিক কিছুই ঘটছে। শুধু তাই না কেউ কেউ বলবেন, মন্ত্রী মহোদয়ের উত্তরগুলোও বড়ই সংবেদনশীল ছিল বলা যায়!
অন্যান্যবারের মতো এবারও রাস্তায় নেমেছে মানুষ। অনেকে বলছেন তারুণ্য। অনেকে বলছেন ১৮। কিছুতেই কী কিছু এসে যাচ্ছে? একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীর গাড়ি উল্টো পথে আসায় শিক্ষার্থীরা থামিয়ে দিয়েছে, সঠিক পথ যেতে বাধ্য করেছে। অবশ্য তাঁর বক্তব্য, কোমলমতি শিশুদের কাছে তিনি নিজে থেকেই গিয়ে কথা বলেছেন।
আজকে বাচ্চারা রাস্তায় নেমে চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা করছে। সবাইকে আইন শেখাচ্ছে। এটা কি তাদের কাজ? তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কোথায়? প্রজাতন্ত্রের টাকায় যে তাদের আমরা লালন পালন করছি, দেশের প্রতি তাদের দায়িত্ব কোথায়? লাইসেন্স, ফিটনেস, ট্রাফিক আইন, বিজিপ্রেস, সচিবালয় আমাদেরই মতো মানুষজন সবখানে। তারা তো সব সরকারের সময়ই এক। শুধু তাই না মাছ-মাংস-তরকারি-ফল-অটো কোথায় নেই দুর্নীতি? তাদের বিবেক জাগ্রত হবে কবে? আমাদেরই বা বিবেক জাগ্রত হবে কবে?
একজন ঘুষখোর সদর্পে টাকার গরম দেখিয়ে বেড়ান দেশে। তারা সন্তানদের লাগাম ছাড়া টাকা হাতে দেন যাচ্ছেতাইভাবে খরচের জন্য। প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী কে কত টাকা বেতন পেতে পারেন সবারই জানা। আর এই অতিরিক্ত অর্থের জোগানটাও কীভাবে আসে সেও আমাদের অজানা নয়। আর আমরা তাদের কিছু না করলেও থুতুও দিই না তাদের সামনে সব জানার পরও।
আমদের এই চোখ বন্ধ করে রাখার দুর্নীতি বন্ধ করব কবে? আমাদের সম্মানিত মন্ত্রীরা তো চরম লজ্জাশীল। আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন, ক্ষমতা নির্লিপ্ত ভিন্নগ্রহের বাসিন্দা। তারা নিজেদের কী ভাবেন আর আমাদেরই বা কী ভাবেন বড়ই জানার ইচ্ছে আমার। তবে প্রতিদিনের সংবাদপত্র আর ফেসবুকের খবরাখবর পড়ে আমার মনে হয়, এই দেশেই কী আমি ফিরছি কিছুদিনের মাঝেই? এ রকম কিছু কী চেয়েছি থাকার জন্য, বসবাসের জন্য? দেশের জন্য কিছু করার ইচ্ছে, আশা সবই এখন টালমাটাল। আসলে ইচ্ছের থেকে বড় কথা সুযোগটা হবে তো? কবে যে আমরা বাঙালি থেকে মানুষ হব, কবে যে নিজেদের পরিশুদ্ধ করব, কবে যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করব! এভাবে কি একটা সমাজ চলতে পারে? এভাবে কি একটা দেশে বসবাস করা যায়? চলছি তো...বসবাসও করছি তো...তাই না?
পূর্বা ইসলাম: পিএইচডি রিসার্চ ফেলো, দ্য ইউনিভার্সিটি অব নটিংহাম, যুক্তরাজ্য।