প্রকৃতির কোলে

তাঁবুর ছাদটা ছিল মশারির নেটের মতো
তাঁবুর ছাদটা ছিল মশারির নেটের মতো

অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল খোলা আকাশের নিচে শুয়ে তারা দেখব। ছোটবেলায় গ্রামে বেড়াতে গিয়ে দুই-একবার আকাশ ভর্তি তারা দেখেছি খরের গাদায় হেলান দিয়ে। ভীষণ সুন্দর। তারা দেখতে হয় অন্ধকার জায়গায়। যত গভীর অন্ধকার, রাতের আকাশের সৌন্দর্য ততই মনোরম। সে সুযোগ যে এভাবে এসে যাবে ভাবিনি।

এক বড় ভাই অনেক দিন ধরেই ক্যাম্পিংয়ে যাওয়ার কথা বলছিলেন। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। এ বছর স্যাক্রামেনটো আমেরিকান বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশনের (SABAA) উদ্যোগে আয়োজিত ক্যাম্পিংয়ে গিয়ে মনে হলো অনেক আগেই আসলে আসা উচিত ছিল। প্রকৃতির সঙ্গে এভাবে মিলে মিশে যাওয়ার সুযোগ, প্রকৃতির কোলে নিজেকে সঁপে দেওয়ার আনন্দ অতুলনীয়।

আমরা যদিও অনেকগুলো পরিবার মিলে গিয়েছিলাম, কিন্তু সবাই যে যার মতো আলাদাভাবেই ওখানে পৌঁছেছি। ক্যাম্পিং স্পটে পৌঁছানোর পনেরো-বিশ মিনিট আগেও বুঝতে পারিনি এমন নির্জন জঙ্গল আছে কাছেই। পৌঁছে দেখি গাছপালায় ঘেরা জঙ্গল। বড় বড় গাছের ছায়ার কারণে গরমও লাগছে না একদম।

আমাদের সেই বড় ভাই প্রধান আয়োজক। তিনি সপরিবারে পৌঁছে গেছেন আগেই। অনেকে তাঁবু টাঙাচ্ছে। আমরা এর আগে কখনো তাঁবু টাঙাইনি। এ অভিজ্ঞতা প্রথম। বড় দেখে একটা গাছের নিচে তাঁবু টানানো হলো। তাঁবুর ছাদটা মশারির নেটের মতো। ওপরে একটা ঢাকনা দেওয়া যায়। আমার মাথায় তখন বুদ্ধিটা এল, শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখার এই সুযোগ। তাই ঢাকনাটা আর টাঙালাম না।

অনেকগুলো তাঁবুর মাঝে একটা চাপ কলের মতো কল। পানি বেশ ঠান্ডা। তিন-চারটা বেঞ্চ পাতা আছে এক জায়গায়। মাঝখানে ক্যাম্প ফায়ার করার জায়গা। পাশে আরও দুই-একটা লম্বা টেবিলের মতো। বিকেলের নাশতা ও গল্প আড্ডার মাঝেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। আর রাত নামার সঙ্গে সঙ্গেই আসল আনন্দটা পাওয়া গেল।

ইলেকট্রিসিটি নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। কিছু হ্যারিকেনের মতো বাতি জ্বালানো হয়েছে। আমাদের অনেকের হাতেই ছোট ছোট টর্চ লাইট। সেই টর্চ আর হারিকেনের আলোয় খিচুড়ি খেলাম ডিম ভুনা আর আচার দিয়ে। মনে হচ্ছিল অমৃত। ছোটবেলায় দাদির বাড়িতে গেলে যেমন লাগত—একদম সেরকম লাগছিল।

শীতকালে যেমন ঠান্ডা কম লাগার জন্য খরকুটো পোড়ানো হয়, একইভাবে ক্যাম্প ফায়ার জ্বালানো হয়েছে। আলো থাকতে থাকতে ছোট বড় সব সাইজের বাচ্চারা জঙ্গল থেকে কাঠ কুড়িয়ে এনেছে। সেই আগুনের আলোতে বসে বসে গান শুনলাম। সঙ্গে আনা ছোট চুলায় বেশ বড় ডেকচিতে চা বানানো হলো। বাসায় থাকলে শহুরে আরাম আয়াসে অভ্যস্ত আমরা, কখনো বুঝতেই পারি না এক কাপ চা বানাতেও কতখানি কাঠ খর পোড়াতে হয়।

আগুনের স্বল্প আলোয় বসে চা খেতে খেতে বারবার আকাশের দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল। রাতের আকাশের সেই রূপ বর্ণনা করার ভাষা আমার নাই। অবাক লাগছিল। একই তো আকাশ। অথচ এই আকাশ আমার প্রতিদিনের আকাশের চেয়ে কত আলাদা। এখানে অগণিত তারার আসর বসেছে। খালি চোখেই অনেক তারা চেনা যায়। মজার ব্যাপার হলো, ক্যাম্প ফায়ারের আগুন একটু কমে গেলে আকাশের চেহারা মুহূর্তে বদলে যায়। মিল্কি ওয়েটা পরিষ্কার দেখা যায়। আকাশ দেখতে দেখতে আমার নেশা ধরে যাচ্ছিল। এমন পরিবেশে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে গান—রবীন্দ্র সংগীত।

ক্যাম্প ফায়ার
ক্যাম্প ফায়ার

অনেক রাতে যখন শুতে গেছি, মাটিতে বাতাস দিয়ে ফোলানো গদিতে শুয়ে আকাশ দেখছিলাম মুগ্ধ হয়ে। সঙ্গে ঝিঁঝি পোকার ডাক। আমার বর ঘুমানোর আগে টর্চ জ্বেলে ভালো করে তাঁবুর চারদিকে দেখে নিল সাপ আছে কিনা। শোয়ার আগে সবাই দলবেঁধে টর্চের সরু আলোয় পথ দেখে কিছুটা দূরের বাথরুমে গেলাম। গ্রামে যেমন বাবাকে ডাকতাম বাড়ির বাইরে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য—সেরকম। শুয়ে শুয়ে তারার মেলা দেখছি আর শুনছি কত অজানা প্রাণীর ডাক, পোকার শব্দ।

ধীরে ধীরে তাঁবুর বাইরে রাত জাগা বন্ধুদের আসর ভাঙল। একদম গা ছমছম করা নীরবতা। শুনেছি এ অঞ্চলে নাকি একটা মা ভালুক তার বাচ্চাদের নিয়ে গভীর রাতে খাবার খুঁজতে আসে। তাই আমরা আমাদের সব খাবার গাড়িতে তুলে ফেলেছি। রেঞ্জাররাও গাড়ি নিয়ে টহল দিচ্ছে একটু পর পর। মশার কামড় খেয়েছি দু–একটা, তাই সর্বাঙ্গে মশা তাড়ানোর ওষুধ লাগানো হয়েছে। আকাশ দেখতে দেখতে আমার মনে হচ্ছিল, এ এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা। আমি কী আসলেই পৃথিবীতে আছি? আমার যান্ত্রিক জীবনের সঙ্গে এই পৃথিবীর কোনো মিল নেই।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। সকালে এক পাখির তারস্বর ডাকে ঘুম ভাঙল। চোখ মেলে দেখি, একি কাণ্ড। মাথার ওপরে সবুজ গাছের ডালপালা, তার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে নীল আকাশ। অদ্ভুত শান্তি। প্রকৃতির কোলে নিজেকে তুলে দিতে পারলে, সে জানে কীভাবে মানুষকে শান্তি দিতে হয়। শুয়ে শুয়েই ঘুম ভাঙা মানুষের একটু–আধটু শব্দ শুনছি। উঠে দেখি সেই গ্রামের মতোই সবাই কাঁধে গামছা আর হাতে ব্রাশ নিয়ে বাথরুমের দিকে যাচ্ছে ধীরে সুস্থে। কোথাও কোনো তাড়াহুড়ো নেই। আগের রাতের মতোই ডেকচিতে চা বসানো হয়েছে। কয়েক ডজন ডিম ফাটানো হয়েছে। ডিম ভাজির প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এই ক্যাম্পিংয়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক ছিল নারীদের বাচ্চা দেখা ছাড়া যাবতীয় দায়দায়িত্ব থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। যেটা আমাদের জন্য একটি অত্যন্ত স্মরণীয় ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজন।

সকালের নরম রোদ পোহাতে পোহাতে সকালের নাশতা শেষে আমরা দলবেঁধে হাঁটতে বেড়িয়েছি। নির্জন রাস্তা লেকের চারপাশ ঘিরে। লেকের পানির রং নীলাভ সবুজ। রাস্তার দুই ধারে নাম না জানা কত গাছ। কিছু গাছের ফল দেখে মনে হলো চেনা ফল। দুই–একজন অতি উৎসাহী খেয়েও ফেলল সেই ফল। যদিও আমেরিকায় বড় হওয়া আমাদের বাচ্চারা আমাদের বারবার নিষেধ করছিল। আমাদের দলে পঞ্চাশ পেরিয়ে যাওয়া সদস্য আছে, আবার তিন বছরের শিশুও আছে। সবাই আঁকা বাঁকা অসমান রাস্তায় হাঁটছে। কারওরই উৎসাহের কমতি নেই। একদম নির্জন এক তীরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসতেই কিশোর কিশোরীরা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাদের জলকেলিতে যোগ দিল বড়রাও। রোদের তাপ বেড়ে যেতে ফিরে আসা হলো ক্যাম্পে। কয়েক মাস আগে কুষ্টিয়ার এক গ্রাম ঘুরে এসেছি। হাঁটার রাস্তাটা মনে হচ্ছিল গ্রামের বাড়ির পেছনের পথ—শুকনো পাতা, ডাল, পালা, সে রকমই অগোছালো।

দুপুরে গ্রিলে পুড়িয়ে বার্গার, হটডগ এসব খাওয়া হলো। অনাড়ম্বর আয়োজন। কিন্তু কারও উৎসাহের শেষ নেই। সেইসঙ্গে মিষ্টি তরমুজ আর ফল প্রাণ জুড়িয়ে দিল। বিকেলে আরেক দফা চা আর মুড়ি মাখা খেয়ে আবার সবাই রওনা হলো লেকে। সকালে যারা সাঁতার কাটেনি তারা সাঁতার কাটবে। হরেকরকম প্লাস্টিকের নৌকা ফুলিয়ে তৈরি করা হলো। রোদের তাপ কমে এসেছে। আরামদায়ক তাপমাত্রায় কেউ মৃদু উষ্ণ পানিতে সাঁতার কাটছে, কেউ নৌকা চালাচ্ছে। কেউ বা শুধু তীরে বসে দৃশ্য উপভোগ করছে। সূর্যের আলো কমার সঙ্গে সঙ্গে লেকের পানির রং বদলাচ্ছে, ধীরে ধীরে গাঢ় নীল হচ্ছে। এমন চিন্তা ভাবনাহীন সময় কাটানোর সুযোগ শহুরে জীবনে হয় না।

সূর্য গড়ানোর আগেই আমরা ফিরে এলাম ক্যাম্পে। বাচ্চারা মহা উৎসাহে কাঠ খুঁজতে চলে গেছে। আজ ক্যাম্প ফায়ারে মার্শমেলো পুড়িয়ে এক ধরনের বিস্কুট বানানো হবে, এটাই নাকি ক্যাম্প ফায়ারের বিশেষ আকর্ষণ। সে কী উৎসাহ তাদের। আজও রাতের খাওয়া হলো হ্যারিকেনের আলোয়। ভুট্টা পুড়িয়ে, মাংস ঝলসিয়ে বেশ মজা করেই খাওয়া হলো। অনেক রাত পর্যন্ত চলল বিভিন্ন ধরনের খেলা আর আড্ডা। আমার মন পড়ে আছে আকাশের তারায়। তাই চুপিসারে এক ফাঁকে চলে এসেছি তাঁবুতে। এমন রাত কী আমার জীবনে আর আসবে? অসংখ্য তারা দেখতে দেখতে এক সময় ঘোর লাগে। মনে হয় আকাশটা নেমে এসেছে কাছেই। হাত বাড়ালে ছোঁয়া যাবে ওই জ্বলজ্বলে সব নক্ষত্র। মনে হয় এই বিশাল মহাকাশটা আমার নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। ক্লান্ত শরীরে কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না। ঘুমের ঘোরেই ভয়ংকর এক ধরনের ডাক শুনলাম, সেই সঙ্গে কুকুরের ডাক। আবার ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছি।

সকালে উঠে শুনলাম ভালুক এসেছিল একটু দূরেই। রাতের সেই শব্দটা ছিল ওদেরই। ভয় পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কেন যেন ভয় লাগেনি। মনে হচ্ছিল মায়ের কোলে এসেছি, প্রকৃতি মা, যেখানে আমি সবচেয়ে নিরাপদ।

প্রকৃতির দেওয়া এই দুই রাতের অকৃপণ আতিথেয়তাকে রেখে আবার শহুরে যান্ত্রিক জীবনে ফিরে চললাম। পেছনে পড়ে রইল গাছপালা, লেকের স্বচ্ছ পানি, ঝিঁঝির ডাক, ভালুক মা আর তার পরিবার। পড়ে রইল নিকষ কালো আঁধার রাতে হাজার তারার অপরূপ রূপ মাধুরী, বাতাসের কানে কানে শুকনো পাতার ফিসফিস কথা। তবে সঙ্গে নিয়ে গেলাম সেই উষ্ণ আতিথেয়তার অমূল্য স্মৃতি।

তামান্না ইসলাম: ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।