শ্যামলা মেয়ে বোদি

লেখিকা
লেখিকা

আমার শৈশবটা কেটেছে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এক গ্রামে। গোয়ালন্দ শহর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পশ্চিমে। শহরের কোলাহল থেকে দুরে নির্জন এক গ্রাম—কাটাখালী। গ্রামের আঁকাবাঁকা মাটির রাস্তা দিয়ে তখন গরু আর ঘোড়ার গাড়িই যাওয়া আসার একমাত্র বাহন ছিল! তবে ভাঙাচোরা রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া চলাচল খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। তাই বেশির ভাগ লোকই পায়ে হেঁটে চলাফেরা করত। তবে সেটাও কম ঝক্কি ঝামেলার ছিল না! আঁকাবাঁকা মেঠো পথটুকু পেরোলেই সবুজে ঘেরা আমাদের সেই চিরচেনা গ্রামখানি। যেখানে বিকেলের সোনা রোদ সত্যি সোনার মতোই ঝলমল করত। রাতের আকাশে খই ফোটার মতো তারারা ফুটে থাকত। সেটা যে কত নয়নাভিরাম হতে পারে, তা অবলোকন না করলে অনুভব করা দুরূহ।

চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। আনাচকানাচে লতাপাতা আর ফুল পাখি! তার ফাঁকে ফাঁকে পাতায় মোড়ানো টুনটুনি পাখির বাসা! দিঘির জলে থরে থরে ফোঁটা পদ্ম আর শাপলা। আকাশ ছোঁয়া তাল নারকেল গাছ দাঁড়িয়ে! বট হিজলের ছায়াতলে রাখাল বালকের মিষ্টি বাঁশির সুর! সবকিছু মিলিয়ে ভালো লাগার এক স্বপ্নপুরী! একদিন এক জোছনা ঝলমলে রাতে সেই স্বপ্নপুরিতে পা রাখল বোদি নামের এক কিশোরী বধূ।

ডুবো ডুবো সূর্যের লাল আভায় রাঙানো গোধূলি বিকেল। থরে থরে ফুটে থাকা কলমি আর কস্তুরি ফুলের মনোরম দৃশ্য! সেই বিকেলে দল বেঁধে চুল বাঁধার ধুম পরতো গায়ের কিশোরী মেয়েদের! রং বেরং এর ফিতা দিয়ে ফুল তুলে, কলা বেণি করে বেঁধে দিত, বোদি নামের সেই মেয়েটি। বোদি সবেমাত্র নতুন বউ হয়ে এসেছে আমাদের গ্রামে। তখন তার বয়স বড় জোর পনেরো কী ষোলো হবে। সেও আমাদের মতোই কিশোরী। আমি তাকে বোদি বলেই ডাকতাম, যদিও আমি তার চেয়ে বয়সে ছোট। মনে হয় খুব একটা ছোট না! অনেকটা কাছাকাছি বয়স ছিল আমাদের! ছোট বড় সকলেই ওকে বোদি বলেই ডাকত। সেই সময় আমার মনে হয়েছে হিন্দুদের বউদি থেকেই হয়তো সকলে ওকে বোদি বলে ডাকে! বোদি যে ওর আসল নাম, সেটা আমি অনেক পরে জানতে পারলাম!

মফস্বল শহরে বড় হওয়া বোদি। খুব হাসিখুশি ও চটপটে স্বভাবের। সেজেগুজে পরিপাটি থাকতে সব সময় পছন্দ তার। আমাকে খুব আদর করত। তাই প্রতিদিন বিকেলে ওর কাছে যেতাম চুল বাঁধতে। অন্য কারও চুল বাঁধা আমার পছন্দ হতো না। সব সময় মনে হতো, দুটো বেণি সমান হয়নি। তাই মাঝে মাঝে আমার চুল, দুই থেকে তিনবার খুলে বাঁধতে হতো তাকে। বোদিকে তাতে কখনো বিরক্ত হতে দেখিনি। বলত, তোর চুল তিনবার কেন, পাঁচবার খুলে বাঁধতে হলেও আমি বেঁধে দেব। ওর শাশুড়ি মাঝে মাঝে একটু বিরক্ত হতেন। উনি মনে করতেন, বড় ঘরের মেয়েদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা ভালো নয়। তাই তার ছেলের বউকে সেভাবে পরামর্শ দিতেন। তবুও বোদি আমাদের সঙ্গে খুব মিশতে চাইত। কাজে-কর্মে ওর তুলনা ছিল না। পুরোনো কাপড় কেটেকুটে নিজের ব্লাউজ, পেটিকোট, নিজেই সেলাই করে ফেলত। খুবই করিতকর্মা মেয়ে ছিল সে।

যখন ওর বিয়ে হয়, তখন ওর বর ছোটখাটো ব্যবসা করত। দিন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা! রাস্তার ওপর সরকারি জায়গায় থাকত ওরা। বোদি বউ হয়ে আসার পর, ওদের দারিদ্র্যতা আস্তে আস্তে ঘুচতে থাকে। দিনে দিনে তার স্বামী ছুন্নাত ভাইয়ের ব্যবসাপাতি বেশ ভালো হয়ে উঠতে থাকল। ইতিমধ্যে তাদের বাড়িতে নতুন টিউবওয়েল বসেছে। কিন্তু কলের পানি ভালো না হওয়ায়, বোদি রোজ বিকেলে আমাদের বাড়িতে আসত, খাবার পানি নিতে।

পড়ন্ত বিকেলের সোনালি আভায়, বড় রাস্তা থেকে আমাদের বাড়িতে ঢোকার পথটা, আরও সুন্দর হয়ে উঠত। দুধারে সবুজ গাছপালা, তার পাশ ঘেঁষে সবুজ ঘাসের বিছানা। রোদ ঢোলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে, আমরা সকলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তার ধারে সবুজের ছায়াতলে বসতাম। সেখান থেকে অনেক দূরের রেল গাড়ি যাওয়া আসা দেখা যেত। কত রকমের হাসিঠাট্টায় যে মেতে উঠতাম, তা অভাবনীয়। সেই মনোমুগ্ধকর পরিবেশে সদ্য বিবাহিত বোদি, খুব সুন্দর করে সেজেগুজে, মাটির কলস কাঁখে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসত। আমার দাদা-দাদি ওকে খুব ভালোবাসতেন। সম্পর্কে নাতবউ। তাই দাদা ওকে দেখলেই ঠাট্টা মশকরা করতেন অনেক। আর দাদি ওকে কাছে ডেকে বসিয়ে, অনেকক্ষণ গল্প করতেন। ও বলত, দাদিগো এখন যাই। দেরি হয়ে গেলে আমার শাশুড়ি রাগ করবে। আমি ওকে বলতাম, তোর শাশুড়িকে আমার মোটেও পছন্দ না। ও হা-হা করে হাসতে থাকত। আর খুব তড়বড় করে ঘন-ঘন কথা বলত। দাদি বলতেন-ওই ছুন্নাতের বউ, মুখে লাগাম দে! নতুন বউ এইভাবে হাসে আর কথা কয় না। বোদি মিষ্টি করে হেসে দুষ্টামি করে বলত, দাদি, এই যে দেখ, মুখে জিপ মারলাম। তুমি কিন্তু আমারে আর ডাকবা না। আর বলবা না তোমার কাছে বসতে, পানির বাটি মাইজা ঝকঝকা কইরা পানি ভইরা দিতে। আমার দাদির একটা অভ্যাস ছিল। বাড়িতে যে কেউ এলেই বলতেন, কতক্ষণ কল চেপে ফেলে তারপর তাকে ঠান্ডা পানি খাওয়াতে।

লিকলিকে লম্বা আর শ্যামলা চেহারার বোদিকে আলতা রাঙানো পা, আর মেহেদি রাঙানো হাতে, কী যে সুন্দর লাগত সেটা বলার মতো নয়। মনে পড়ে আমার ছোট চাচিও ওই সময় বউ হয়ে এলেন আমাদের বাড়ি। তিনিও রাজবাড়ির মেয়ে। তাই বোদির খুবই ইচ্ছা ছোট চাচির সঙ্গে বন্ধুত্ব করা। কিন্তু ওর শাশুড়ির কড়া নির্দেশ, বড় বাড়ির বউদের সঙ্গে কীসের এত আলাপ খাতির? আমি ওর শাশুড়িকে ডাকতাম কাকি বলে। কাকিও আমাকে খুব আদর করতেন। ছোটবেলায় আমাকে নাকি ওনারাই কোলে কাঁখে করে মানুষ করেছেন। আমি একবার কাকির ওপর খুব রাগ করেছিলাম। বলেছিলাম-তোমাদের বাড়িতে আসলে তুমি বোদিকে সব সময় একাজ ওকাজের তাড়া দাও কেন? এই জন্য আমার চুল বাঁধা ঠিক হচ্ছে না। দুই তিনবার চুল খুলতে হলো! তুমি জানো, এই সময় আমি ওর কাছে রোজ চুল বাঁধতে আসি। দাঁড়াও! আমি মায়ের কাছে বলব। তুমি চাও না আমি তোমাদের বাড়িতে আসি! এই বলে আমি চুল না বেঁধেই সেবার রাগ করে বেরিয়ে এসেছিলাম।

কাকি তো ভয়ে অস্থির! তিনি জানেন, আমি আমার মায়ের কাছে গিয়ে অনেক কিছু বলব! তাই কাকি আমাদের বাড়ি এসে মাকে বলেছিলেন, ভাবি, ডিনা চুল না বাইধা রাগ কইরা চইলা আইছে! ও ভাবি, আমারে ভুল বুইঝেন না। বোদি এমনিতেই শহরের মাইয়া, তার ওপর আইছে গরিব ঘরের বউ হইয়া। আপনাগের শানশওকত দেইখা যদি ওর মন বিগড়ায়া যায়! তহুন? আমরা হলাম গরিব মানুষ, আমাগো বউগের এত ফুরুত ফারুত ভালো না। ও ভাবি, ও জানি চুল বাঁধতে যায়। মা হেসে ওনাকে বললেন, ওর রাগ তো তোমাদের অজানা না। তুমিই ওরে কও? ডানপিটে আর কড়া মেজাজের সেই মেয়েটির কথা অন্য একদিন হবে।

সেও আজ কত যুগ আগের কথা। ভাবতে গেলে মনে হয় এই সেদিনের কথা। কখন যে সে সময় পার হয়ে গেল। সময় বড়ই নিষ্ঠুর। সময়ের সঙ্গে দৌড়াতে-দৌড়াতে শরীর মন আজ ক্লান্ত। আবেগাপ্লুত হৃদয়ে ফেলে আসা সবকিছু শুধু কড়া নেড়ে চলেছে মনের অজান্তেই। ও সবকিছু এখন শুধুই স্মৃতি। রাতের আকাশে সুখ তারা খুঁজে পাওয়ার প্রাণপণ চেষ্ট। বাড়ি বাড়ি হারিকেনের আলোয় পড়া মুখস্থ করার সুর। সেটা আজও হৃদয়ের মণিকোঠায় নির্জনে। একাই বেজে চলেছে দিনরাত। ঘুটঘুটে অন্ধকারময় ঝোপঝাড়। জোনাকি পোকার পুচ্ছের আলপনা আঁকা রাত। ঝিঁঝিপোকার অবিরাম সুর। সেটা আজও বন্দী রয়েছে। সেই একই মনের মণিকোঠায়। লক্ষ তারা গুনে-গুনে ক্লান্ত চোখে, এখন আর ঘুম নেমে আসে না। জোছনা রাতে উঠোনে মাদুর পেতে, গোল ধরে বসে, নানারকম গল্প-কিচ্ছা শোনা। শুনতে-শুনতে ঢুলুঢুলু চোখে কোটি তারাদের আনাগোনা, সেটাও আজ আর নেই। এখন শুধু তা স্বপ্নেও ভেসে বেড়ায়।

যাদের কথা এখানে উল্লেখ করেছি, তাদের অনেকেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে, আজ পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। সেই ভালোবাসার মুখগুলো আজও আমার মনের মাঝে উঁকি দিয়ে বেড়ায়! তারা আজ চলে গেছেন না ফেরার দেশে। সেই প্রিয় বোদিকেও খুব অল্প বয়সে চলে যেতে হয়েছে পরলোকের দেশে। আজ যুগের হাওয়া পাল তুলে উড়তে লেগেছে লাগামহীন! গ্রাম আর আজ গ্রাম নেই! শহরের বাতাস এখন গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে! এটাই সত্যি! যুগে যুগে বোদিরা আসবে, আবার বোদিরা চলেও যাবে! কিন্তু শ্যামল গায়ের সেই কমল মনের বধূকে কি আর কখনো দেখা যাবে?

ডিনা চৌধুরী: মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।