দখিনে বসন্ত এসে গেছে

নানা বর্ণের বুনো ফুলের সমাহার
নানা বর্ণের বুনো ফুলের সমাহার

ছেলেবেলায় ভূগোল বইয়ে পড়েছিলাম পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলে দিন রাত হয় আর বার্ষিক গতির ফলে ঋতু পরিবর্তন হয়। সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহই দুভাবে ঘোরে। একটা তার নিজের অক্ষে, যেটাকে বলা হয় আহ্নিক গতি। পাশাপাশি পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে। এই ঘোরাকে বলা হয় পৃথিবীর বার্ষিক গতি। সূর্যকে ঘুরে আসতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা। যাকে আমরা বলি এক বছর।

পৃথিবী যখন সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে তখন পৃথিবীর অক্ষরেখা এর কক্ষপথের সঙ্গে পুরোপুরি উল্লম্বভাবে না থেকে একটু হেলে থাকে। এ কারণে কখনো দক্ষিণ গোলার্ধ সূর্যের কাছে চলে যায়, কখনো যায় উত্তর গোলার্ধ। যখন যে অংশ সূর্যের দিকে হেলে থাকে তখন সে অংশ খাঁড়াভাবে বেশিক্ষণ ধরে সূর্যের আলো ও তাপ পায়। ফলে তখন সেই অংশে বেশি গরম পড়ে অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল থাকে। এক অংশ যখন সূর্যের কাছে থাকে বিপরীত অংশ তখন সূর্য থেকে দূরে থাকে। আর দূরে থাকার কারণে সেই অংশে আলো ও তাপ কম পাবে। অর্থাৎ ওই গোলার্ধে তখন থাকবে শীতকাল। আর এ জন্যই বাংলাদেশে যখন গ্রীষ্মকাল থাকে, অস্ট্রেলিয়ায় তখন শীতকাল থাকে। আবার অস্ট্রেলিয়ায় যখন গ্রীষ্মকাল থাকে, তখন বাংলাদেশে থাকে শীতকাল। একইভাবে বাংলাদেশে যখন হেমন্তকাল অস্ট্রেলিয়ায় তখন বসন্তকাল।

নানা বর্ণের বুনো ফুলের সমাহার
নানা বর্ণের বুনো ফুলের সমাহার

প্রথম দিকে ‍অস্ট্রেলিয়াতে আসার পর আত্মীয়-বন্ধুদের বিষয়টি বোঝাতে খুব বেগ পেতে হতো। বাংলাদেশে সকলে যখন প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ, আমরা কেন তখন ভারী জ্যাকেট পরে ঘুরছি—এমন প্রশ্নের সম্মুখীন বহুবার হয়েছি। এখনো অনেকেই জানতে চান, এখানে শীতকালে কেন বৃষ্টি হয়। মাঝে মাঝে শীত আর ‍বৃষ্টিতে অতিষ্ঠ হয়ে আমারও মনে হয়—ইশ্‌, বাংলাদেশের গরমই এর চেয়ে ভালো!’ তবে ভুলে গেলে চলবে না, ‘মেঘ দেখে তুই করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে।’ প্রকৃতির নিয়মে অস্ট্রেলিয়ায় শীতের পরে এসে গেছে বসন্ত। ঠান্ডা ও বৃষ্টির প্রকোপ পুরোপুরি না কমলেও চারদিকে বসন্তের সুবাতাস বইছে। আকাশে-বাতাসে ‍উত্তাপ ছড়াচ্ছে রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। রং বেরঙের ফুলের মৌ মৌ গন্ধে মাতাল হচ্ছে মন।

নানা বর্ণের বুনো ফুলের সমাহার
নানা বর্ণের বুনো ফুলের সমাহার

যারা মনে করেন পশ্চিমারা বাঙালির মতো উৎসব প্রিয় নয়, তাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে এ দেশের মানুষও মেতে উঠেছে বসন্ত উৎসবে। সমগ্র ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়াতে ১২ হাজার প্রজাতির বুনোফুল আছে—যা পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম বুনোফুলের ভান্ডার। প্রতি বছর বসন্তের প্রথম দিনেই (১ সেপ্টেম্বর) কিংস পার্ক আয়োজন করে মাসব্যাপী ঐতিহ্যবাহী বসন্ত উৎসবের। এ উৎসবের মূল আকর্ষণ নানা বর্ণের বুনো ফুলের সমাহার। কিংস পার্কে প্রায় ৩ হাজার প্রজাতির বুনোফুল রয়েছে। অনুষ্ঠানটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও সেসব স্থানে জন্মে এমন বুনো ফুলের আলোকচিত্র যুক্ত করা হয়েছে।

এ ছাড়া পার্থের বিভিন্ন স্থানে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বসন্ত উৎসব উদ্‌যাপিত হচ্ছে। অ্যারালুয়েন পার্কে ১৪ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৪৫ হাজারের ওপরে টিউলিপ প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থীর মনোরঞ্জন করছে। নানা প্রজাতির বুনো ফুলতো আছেই। সোয়ান ভ্যালি, অ্যাভোন ভ্যালি, রটনেস্ট আইল্যান্ড, সমুদ্র সৈকত প্রভৃতি স্থানে বুনো ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে সমগ্র বসন্তকাল জুড়ে দর্শনার্থীদের ভিড় থাকবে। আর এভাবেই দক্ষিণের মানুষ মেতে রইবে বসন্ত উৎসবে।

শর্মিষ্ঠা সাহা: পার্থ, অস্ট্রেলিয়া।